তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪
চতুর্থ পর্বের শেষাংশ:
উজির সাহেব সব সদাই গুলো বাজারে রেখে চলে এসেছে। তাই আর পয়সার কেনা সদাই গুলো আনা হলো না। কী আর করা! যাই দরবারে। হিরা চললো রাজদরবারের দিকে।
প্রহরীর সাথে কথা বলে হিরা যাচ্ছে রাজদরবারে। হিরা’র পিছনে পিছনে গেইটের প্রহরীও গেইট ফেলে রেখে দরবারের দিকে ছুটলো। প্রহরীর উদ্দেশ্য উজির আর ছেলের বাজারের কাহিনী শোনার জন্য। আর উজির সাহেব তো আগেই দরবারে এসে রাজার কাছে হিরা বিষয়ে সব বৃত্তান্ত খুলে বলেছে। উজিরের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে রাজাও একটু দুশ্চিন্তায় আনমনে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, আর ভাবছিল।
এমন সময় হিরা রাজদরবারে এসে হাজির। পিছনে পিছনে গেইট প্রহরীও। হিরা’কে দেখেই উজির জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘এই যে হুজুর বাটপারটা এসেছে। মনে হয় আবার পয়সা তিনেক নেওয়ার জন্যই দরবারে এসেছে। দিবেন না হুজুর, দিবেন না। আর একটি পয়সাও দিবেন না। আপনি পয়সা দিলেন সদাই কেনার জন্য। আপনার দেওয়া সেই পয়সা দিয়ে জিলাপি কিনে খায়। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়। রূপবান গানের ড্যান্স দেখে বকশিস দেয়। কাকে যে সদাই আনতে দিলেন হুজুর, এটা আমার মাথায় কিছুতেই খেলছে না। শেষপর্যন্ত আমাকে থাপ্পড় মারার বিচারটাও করলেন না, হুজুর।’ এই বলেই উজির হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। রাজা উজিরকে শান্তনার সুরে থামতে বললেন।
এরপর রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, এই ছেলে, ‘আমার উজির যা বলেছে, তা কি ঠিক?’ হিরা বললো, ‘হ্যা, রাজা হুজুর। আপনার উজির সাহেব যা বলেছে সবই সত্যি।’ রাজা বললেন, ‘তাহলে আমার পয়সা তুমি খেয়ে ফেলেছ?’ হিরা বললো, ‘হ্যা, হুজুর। আমি পয়সা খেয়ে সদাইও কিনেছি।’ হিরা’র কথা শুনে উজির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো! উজির ধমক দিয়ে বললো, ‘এই বেটা মিত্থুক! কখন সদাই কিনলি? তুই বেটা এক পয়সার জিলাপি খাইলি। এক পয়সা ফকিরকে দিলি। আর এক পয়সা দিলি কোমড় ঢুলানি ড্যান্স দেইখা। তিন পয়সা তো এখানেই শেষ! আবার সদাই কিনলি কোত্থেকে? এই বেটা, সদাই কই? সদাই বের কর? এখানে বাটপারি করতে আসছ? তেরো সিকে ঢুকাইয়া রাখুম, বুঝলি!’
উজিরের বাড়াবাড়িতে রাজা ধমক দিয়ে উজিরকে থামিয়ে হিরা’কে বললো, ‘এই ছেলে, সদাই যদি কিনেই থাক, তাহলে সদাই কোথায়? সদাই বের করো। নাহয় পয়সা বের করো! যেই তিন পয়সা তোমাকে দিয়েছি, সেই তিন পয়সা দিয়ে এক মুল্লুকের জমি কেনা যায়। তুমি বাবা সদাই দাও, নাহয় পয়সা বের করো।’ রাজার কথায় হিরা কিছুই বলছে না। হিরা চুপ চোরের মতো এক কোণে করে বসে আছে।
উজির হিরা’র দিকে টগবগিয়ে চাচ্ছে আর বলছে, ‘রাজা হুজুর, আপনি ও-কে বন্দি করে কারাগারে ঢুকিয়ে রাখুন। সকালে ওঁর ঠিকানামতো ওঁদের বাড়িত্তে গিয়ে, ওঁর বাবাকেও তিন পয়সা বাটপারির দায়ে বন্দি করে নিয়ে আসবো। তারপর পরের পয়সা দিয়ে জিলাপি খাওয়া বের করবো।’ এবার হিরা বসা থেকে উঠে হাত দুটো জোড় করে বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনি আমাকে সদাই তিনটি কী কী যেন আনতে বলেছিলেন? দয়া করে আবার একটু বলুন, সবাই শুনুক! আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
রাজা বললো, ‘ওহ্! আচ্ছা, মনে হয় তুমি সদাই তিনটির নাম ভুলে গিয়েছ। তাহলে শুনো, আবারও বলছি! এক পয়সার এখন। এক পয়সার তখন। আর এক পয়সার এখনো না তখনো না। এবার শুনলে তো?’ হিরা বললো, ‘তাতো আমি এনেছি হুজুর! সদাই গুলো সব আপনার উজিরের কাছে আছে।’ এই কথা শুনেই উজির বসা থেকে দৌড়ে গিয়ে হিরা’র গলা চেপে ধরে বললো, ‘এই বেটা মিত্থুক! আমার কাছে সদাই দিছস কখন? তুই বেটা আমাকে জিলাপি খাওয়াতে চাইলি, তাওতো আমি খাইনি! এখন বলছিস সদাই আমার কাছে?’ রাজা ধমক দিয়ে উজিরকে থামিয়ে বললো, ‘এই ছেলে, উজির সাহেবের কাছে সদাই গেলো কীভাবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমি যা করেছি, আপনার উজির সাহেবের সামনা-সামনিই করেছি। তাই সদাই তিনটিও উজির সাহেবের সহযোগিতায় করা হয়েছে।’ উজির উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘কই, সদাই কই হে? জিলাপি খাও! ফকিরকে দাও! ড্যান্স দেখো! আবার সদাই কিনছে? বেটা বাটপার।’
রাজা বললো, ‘কখন কীভাবে সদাই কিনলে? আর আমার উজির সাহেবের কাছেই বা কখন দিলে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, উজির সাহেব-সহ যখন আপনার বাড়ির সামনে বউ বাজার গেলাম। বাজারে ঢুকতেই দেখি এক লোক জিলাপি ভেজে রেখেছে। উজির সাহেবকে বললাম, আমি জিলাপি খাব। উজির সাহেব জিলাপি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো, জিলাপি গরম না ঠান্ডা? জিলাপি বিক্রেতা বললো, একেবারে টাটকা গরম জিলাপি। এখন ভেজে রেখেছি, এখন। উজির সাহেব একপোয়া জিলাপি দিতে বললেন, জিলাপি বিক্রেতা একপোয়া জিলাপি মেপে দিলেন। আমি এক পয়সা জিলাপির দাম দিয়ে দিয়ে মনের আনন্দে জিলাপি খেতে শুরু করলাম। এই হলো আপনার তিনটি সদাই’র মধ্যে একটি সদাই, ‘এক পয়সার এখন’। কারণ, জিলাপি বিক্রেতা বলেছিল, এখন ভেজে রেখেছি এখন। তাই আপনার একটি সদাই, এখন।’
হিরা’র কথা শুনে উজির সাহেব এখন ভাবছে! আর মনে মনে বলছে, হায়! হায়! ঠিকই তো! রাজা তো এই এখনের কথাই বলছিল। এটা তো আমিও পারতাম! ছেলেটা তো ঠিকই করেছে।
হিরা’র কথা শুনে রাজা বললো, ‘তা মেনে নিলাম। বাদবাকি সদাই গুলোর হিসাব দাও।’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, জিলাপি খাচ্ছি আর হেঁটে যাচ্ছি বাজারে ভেতরে। আপনাদের এখানকার বাজার খুবই সুন্দর হুজুর। হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম। এমন সময় এক ভিক্ষুক আমার কাছে ভিক্ষা চাইলো। যখন ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলো তখন আমি ভিক্ষুককে এক পয়সা ভিক্ষা দিয়ে দিলাম। এই হলো আপনার তিনটি সদাই’র মধ্যে দ্বিতীয় সদাই, এক পয়সার তখন।’
এরপর গেলাম আপনার বউ বাজারের শেষ মাথায়। সেখানে যেতেই কানের সামনে বাজনার আওয়াজ এলো। একটু সামনে গিয়ে দেখি মানুষ গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে নাচগান চলছে। আমি হুজুর নাচগানের পাগল। তাই আর বাইরে থাকতে পারিনি। ঠেলেঠুলে ভেতরে গেলাম। রূপবান গানের সাথে এক হিজরার ড্যান্স দেখে নিজেও কিছুক্ষণ নাচলাম। চমৎকার ড্যান্স হুজুর। আপনার উজির সাহেবও দেখেছে। উনি আমার পিছনেই ছিল। একসময় যখন ড্যান্স শেষ হলো, সবাই সবার সাধ্যমতো এক পয়সা আধা পয়সা করে হিজরাকে বকশিস দিচ্ছিলো। তা দেখে আমিও সাথে থাকা এক পয়সা হিজরাকে বকশিস দিয়ে দেই, হুজুর। আপনার দেওয়া তিন পয়সার মধ্যে এই এক পয়সার হিসাব পাপপুণ্য বা ইহকাল পরকালের কোনও কাজে লাগেনি। তাই এটা জাহান্নামই গেলো হুজুর। এটা হলো আপনার তিন পয়সার তিনটি সদাই’র মধ্যে তৃতীয় সদাই, এখনো না তখনো না। এই বলেই হিরা উজিরকে জিজ্ঞেস করছে, কি উজির সাহেব, আমি কি মিথ্যে কিছু বলেছি?’
উজির বোকার মতো চুপ করে বসে বসে ভাবছে, এই সদাই তো আমি নিজেও করতে পারতাম। কেন যে বোকার মতো অপারগতা স্বীকার করলাম! পারবো না বলে ছেলেটার হাতে ছেড়ে দিলাম! হায়রে কপাল আমার! এখন ছেলেটাই তো রাজ্যের সব নিয়ে নিবে!
হিরা’র কথা শুনে রাজা এবার মনে মনে ভাবলো, ছেলেটা তো আমার তিন পয়সার তিনটি সদাই ঠিকই কিনে ফেলেছে। এখন যদি আমি বলি সদাই তিনটি ঠিক হয়েছে, তাহলে তো আমার রাজ্যের অর্ধেক ছেলেটার হাতেই চলে যাওয়ার সম্ভাবনা। না, তা হতে দেওয়া যাবে না। এই ভেবেই রাজা বললো, ‘শুনো ছেলে, এই তিনটি সদাই’র মধ্যে শেষ সদাইটি এভাবে হবে না। এটা অন্যভাবে হবে। তিনটি সদাই’র মধ্যে তুমি দু’টি সদাই ঠিকমতো করতে পেরেছ। তৃতীয় সদাইটি ঠিকমতো করা হয়নি।’
রাজার কথা শুনে দরবারে উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে হেল। কেউ খুশি হলো। কেউ রাগ হলো কেউ আবার দুঃখও পেলো। উজির এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলো, ছেলেটা তো সদাই তিনটি ঠিকমতোই করেছে। কিন্তু, রাজা এখন অস্বীকার করছে কেন? ছেলেটা যদি কিছু বকশিস পায়, তাহলে তো আমিও সেই বকশিস থেকে কিঞ্চিৎ কিছু পেতাম। তা যে-ভাবেই হোক ছলে-বলে কলেকৌশলে ছেলেটার কাছ থেকে আদায় করতাম। কিন্তু রাজার কথায় মনে হচ্ছে, সব আশাই আমার বিফলে যাচ্ছে। তারপরও দেখা যাক, কী হয়! এই ভেবে উজির কালো মুখ করে হিরা’র দিকে চেয়ে থাকলেন।
হিরা রাজার কথা শুনে বললো, ‘রাজা হুজুর, তা যদি আপনার মনোমত না হয়। তাহলে তো আমার কিছুই করার থাকলো না। দয়া করে আমাকে মাপ করে দিন। যদি তিন পয়সার জন্য আপনার কোনও দাবি থাকে তাও বলুন! আমি আমাদের বাড়িতে গিয়ে আপনার দেওয়া তিন পয়সা জোগাড় করে নিয়ে আসবো। তবে এরজন্য আমাকে অন্তত তিনদিন সময় দিতে হবে হুজুর।’ এই বলেই হিরা রাজদরবার থেকে বের হয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিলো।
রাজাও দরবারে বসে বসে ভাবতে লাগলো, এরকম মিথ্যা কথা বলা আমার ঠিক হয়নি। ছেলেটা তো আমার কথামতো তিনটি সদাই ঠিকই করেছে। কিছু চাওয়া-পাওয়ার জন্য এমন একটা বুদ্ধিমান ছেলেকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এই ভেবে মনস্থির করলো হিরা’কে ফিরিয়ে আনতে ডেকে পাঠাবেন, উজিরকে। কিন্তু হিরা ততক্ষণে রাজবাড়ি থেকে অনেকদূর চলে গেছে। রাজা উজিরকে বললেন, ‘উজির সাহেব, আপনি ছেলেটাকে ডেকে আনুন! আমি ছেলেটাকে উপযুক্ত বকশিস দিবো। এমনকি, ছেলেটা যা চাইবে, তা-ই দিবো। ডাকুন ছেলেটাকে! এই বুদ্ধিমান ছেলেটাকে আমি কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাই না। আপনি তাড়াতাড়ি গিয়ে ছেলেটাকে ডেকে আনুন।’ রাজার উপদেশ পেয়ে উজির সাহেব মনের আনন্দে দৌড়াতে শুরু করলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে মনে মনে বুদ্ধি করলেন, ‘যে-করেই হোক, ছেলেটার কাছ থেকে বকশিসের অর্ধেক আমার পেতেই হবে।’
আসলেন গেইটের সামনে। প্রহরী বললো, ‘উজির সাহেব, তাড়াতাড়ি দৌড় দেন! ছেলেটাকে ফিরিয়ে আনুন! ছেলেটা বকশিস পেলে আমিও কিছু বকশিস পেতে পারি। যান যান হুজুর, তাড়াতাড়ি যান।’ গেইট থেকে বের হয়ে উজির দৌড়াচ্ছে। হিরাও হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে। উজির দৌড়ে গিয়ে হিরা’র সামনে গিয়ে বললো, ‘বাবারে, অনেক কষ্ট করে রাজাকে রাজি করিয়েছি। এখন তুই বাবা যা চাস, তা-ই পাবি! কিন্তু বাবা আগে আমার সাথে তোর একটা শর্ত করতে হবে৷’ হিরা বললো, ‘কী শর্ত করতে হবে উজির সাহেব? তা আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন!’ উজির বললো, ‘তুই বাবা যা পাবি, তার অর্ধেক আমাকে দিতে হবে। আমি বাবা রাজাকে তেল মাখতে মাখতে হাত দুটো বিষ করে ফেলেছি। আমি যদি রাজাকে না বলতাম, তাহলে রাজা আর রাজি হতো না, তোর কপালেও আর বকশিস জুটতো না। এখন বল, তুই আমার সাথে শর্ত করতে রাজি কি-না?’
হিরা হাসতে হাসতে বললো, হ্যাঁ উজির সাহেব, আমি রাজি আছি। তো, এভাবে মুখের কথার কোনও গ্যারান্টি নেই। কিছুক্ষণ পর হয়তো বকশিস পেয়ে আমিও অস্বীকার করতে পারি। সেজন্য একটা কাগজে লিখে সই-স্বাক্ষর করে রাখা ভালো।’ উজির মনের আনন্দে রাজি হয়ে গেলেন। হিরা একটা দোকান থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ সংগ্রহ করে কাগজে লিখল, “রাজা থেকে আমি যা পাবো, তার অর্ধেক সম্মানিত উজির সাহেব পাওনা।” এরপর লেখার নিচে উজিরের স্বাক্ষর রাখলো।
এদিকে রাজবাড়ির গেইট প্রহরী গেইট খুলে আগে থেকেই তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে, কখন উজির-সহ ছেলেটা আসবে। উজির-সহ হিরা যখন রাজবাড়ির গেইটের সামনে আসলো, গেইট প্রহরী হিরা’কে বললো, ‘বাবারে, তোর জন্য রাজাকে অনেক তেল মালিশ করেছি। এখন তুই যা পাবি আমাকে অর্ধেক দিবি। বকশিস কিন্তু আমার কারণেই পাচ্ছিস।’ হিরা বললো, ‘আমি যা পাবো তা থেকে তো অর্ধেক উজির সাহেবকে দিতে হবে। তাহলে আপনাকে আমি কীভাবে অর্ধেক দিবো?’ প্রহরী বললো, ‘তাহলে উজির সাহেবকে অর্ধেক দিয়ে যা থাকে, তার অর্ধেক আমাকে দিবি।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। তবে এই কাগজে একটা স্বাক্ষর দিতে হবে।’ গেইট প্রহরী মনের আনন্দে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে গেইট ফেলে তিনজন মিলে চললো রাজদরবারের দিকে।
তিনজন মিলে দরবারে যেতেই দেখা হয় এক মহিলার সাথে। তিনি রাজবাড়ির পরিচ্ছন্নতা কর্মী। সেই মহিলা হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘বাবারে, তোর জন্য রাজাকে অনেক তেল মেখেছি। তারপরও রাজা কি-আর রাজি হয়! অনেকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছি তোকে বকশিস দিতে। এখন বাবা তুই যা পাবি, আমাকে এর অর্ধেক দিবি।’ হিরা হেসে বললো, ‘আমার বকশিসের ভাগিদার আপনার মতো আরও দুইজন আছে। তাহলে আপনাকে দিবো কীভাবে?’ পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলা বললো, ‘তাঁদের দিয়ে থুইয়ে যা থাকে, তার অর্ধেক দিলেই হবে বাবা।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। এখানে একটা স্বাক্ষর দিন!’ পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলা স্বাক্ষর জানতেন না। তাই কলমের কালি মহিলার বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লাগিয়ে টিপসই নিয়ে নিলো। এবার চারজন গিয়ে হাজির হলো রাজদরবারে।
রাজদরবারে তখন অনেকেই উপস্থিত ছিল। যত লোকই থাকুক-না-কেন, হিরা’ই এখন দরবারের হিরো। সবার দৃষ্টি হিরা’র দিকে। হিরা’কে রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘এই ছেলে, বাজার থেকে তোমার এনে দেওয়া তিন পয়সার তিনটি সদাই আমি খুশি মনে গ্রহণ করেছি। আমি যা চেয়েছি আর যেভাবে চেয়েছি, তুমি ঠিক সেভাবেই করতে পেরেছ। তাই আমি তোমাকে উপযুক্ত বকশিস দিতে চাই। এখন বলো তুমি কী চাও! তুমি এখন এই মুহূর্তে যা চাইবে তা-ই আমি তোমাকে দিতে রাজি আছি। বলো তুমি কী চাও!’
রাজার এই ঘোষণা শুনে উজির হিরা’র কানে কানে গিয়ে বললো, ‘বাবারে, ‘তুই বাবা রাজার সিংহাসনটা চা! তাহলে আমি রাজ্যের অর্ধেক পেয়ে যাবো। এই রাজার উজিরগিরি আর ভালো লাগে না। তুই বাবা তাড়াতাড়ি সিংহাসনটা চা।’ উজিরের এরকম পরামর্শে হিরা বললো, ‘চাচ্ছি উজির সাহেব, চাচ্ছি! চাইতে আমি আর কম চাচ্ছি না। একটু বেশি করেই চাচ্ছি। যাতে আপনাদের দিয়ে আমারও কিছু থাকে।’ হিরা’র কথা শুনে উজির খুশিতে তাইরে-নাই-রে নাই-রে-না করে নাচতে লাগলো!
হিরা’র চাইতে দেরি দেখে রাজা বললো, ‘কী ব্যাপার! চাও তুমি, কী চাইবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, চাইতে আমার কেমন যেন দ্বিধাবোধ হচ্ছে। আমি যা চাইবো, তা যদি আপনি না দেন, তাই।’ হিরা’র এমন কথায় রাজা খুব রেগে বললো, ‘কি, আমার মুখের কথার কি কোনও দাম নেই? চাও তুমি কী চাইবে!’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনার কাছে ধনসম্পত্তি, রাজ সিংহাসন এসব কিছুই চাই না।’ রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে তুমি কী চাও? যা-কিছুই চাও, তা-ই তোমাকে দেওয়া হবে। বলো কী চাও!’ হিরা বললো, রাজা হুজুর, ‘আমি আপনার দরবারে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি চাই!’
হিরা’র মুখে এই কথা শুনে রাজা-সহ উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে হিরা’র দিকে তাকিয়ে রইল। উজির কাঁপতে কাঁপতে হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘আরে বাবা, তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে?’ হিরা উজিরের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আবারও বললো, ‘রাজা হুজুর, ‘আমাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি দেওয়ার ঘোষণা দিন!’
রাজা অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে ভেবে দেখলো, ছেলেটার জুতার বাড়ি চাওয়ার পিছনে কোনও কারণ থাকতে পারে। তাই ছেলেটা জুতার বাড়ি চাচ্ছে। দেখি এর পিছনে কী থাকতে পারে? এই ভেবে রাজা বললো, ‘ঠিক আছে, আমি আজকে এ-ই দরবারে সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা দিচ্ছি, তোমাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়িই দেওয়া হবে।’ রাজা ঘোষণা দেওয়ার পর উজির কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে বসে কপালে থাপ্পড় মারতে লাগলো। গেইট প্রহরী রাজ দরবার থেকে বাইরে যেতে চাইলে, হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, জুতার বাড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার রাজদরবার থেকে কেউ যেন বের হতে না পারে। দয়া করে আপনি তাড়াতাড়ি ঘোষণা দিন!’
হিরা’র জুতার বাড়ি চাওয়ার বিষয়টি আর রাজার বুঝতে অসুবিধা হলো না। রাজা দরবারের গেইটে থাকা দুইজন সিপাহিকে বললো কেউ যেন দরবার থেকে বেরুতে না পারে। যেই কথা সেই কাজ। দরবারের গেইট মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল। জুতার বাড়ি দেওয়ার জন্য জল্লাদ এসে হাজির হলো। (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি মারার জন্য রাজার পুরানো গোডাউন থেকে রাজার বাপদাদার চোদ্দগুষ্টিদের ব্যবহার করা সব পুরাতন জুতা খুঁজে বের করে দরবারে আনা হলো। জুতার বিশাল স্তুপ দেখে উজির-সহ গেইট প্রহরী আর পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলার এখন জীবন যায় যায় অবস্থা! এর মধ্যে উজির কয়েকবার অজ্ঞানও হয়ে যাচ্ছিল।
রাজা জল্লাদকে হুকুম দিলো, ‘এই জল্লাদ, ছেলেটাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি মারো।’ রাজার হুকুম পেয়ে জল্লাদ দুইহাতে দুটি জুতা নিয়ে হিরা’র দিকে এগুতেই, হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমার কিছু কথা আছে। রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী কথা?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, এই বকশিস’র মধ্যে কিছু ভাগবাটোয়ারা আছে।’ রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘জুতার বাড়ির মধ্যে কেমন ভাগা-ভাগি থাকতে পারে?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, আমাকে এই বকশিস দেওয়ার জন্য আপনার উজির নাকি আপনাকে তেল মালিশ করে রাজি করিয়েছে? তাই উনি আমার কাছে বকশিস’র অর্ধেক দাবি করেছে। দেখুন, আমার সাথে উজিরের শর্ত করার কাগজ। যেই কাগজে আপনার উজিরের স্বাক্ষর আছে। তাই আমি উনার সেই দাবি পূরণ করতে চাই, রাজা হুজুর। দয়া করে (৫.০০০) পাঁচ হাজার জুতার বাড়ি আপনার সম্মানিত উজিরকে আগে দেওয়া হোক। হিরা’র কথামতো রাজা তা-ই হুকুম দিলেন। জল্লাদ আগেকার দিনের পুরাতন জুতা দিয়ে ঠাস্ ঠাস্ করে শখানেক বাড়ি উজিরের গালে মাথায় বসিয়ে দিলেন। উজিরের এখন জীবন যায় যায় অবস্থা। শেষতক হিরা’র অনুরোধে পাঁচ (৫.০০০) হাজার জুতার বাড়ি থেকে বাকি থাকা সব মাপ করে দিলেন। জল্লাদ বেটা জুতা মারা বন্ধ করলেন।
রাজা আর বাদবাকি (৫.০০০) জুতার বাড়ি ছেলেটাকে মারতে বললে, হিরা তাতেও আপত্তি জানিয়ে বলে, ‘রাজা হুজুর, এই (৫.০০০) পাঁচ হাজারের মধ্যেও ভাগ আছে।’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘ভাগটা কাকে দিতে হবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, এই ভাগিদার হলো আপনার গেইট প্রহরী।’ রাজা অবাক হয়ে বললো, ‘এই গেইট প্রহরী মানে দারোয়ান। দারোয়ানও তোমার কাছে বকশিসের ভাগ চেয়েছে?’ হিরা বললো, ‘হ্যাঁ রাজা হুজুর! উনিও নাকি আমার বকশিসের জন্য আপনাকে তেল মেখেছে? তাই উনাকেও থেকে যাওয়া বাদবাকি বকশিসের অর্ধেক দিতে হচ্ছে।’ রাজা রেগে-মেগে জল্লাদকে বলললো, ‘ও-কে আড়াই হাজার জুতার বাড়ি খুব জোরে জোরে মারবে। রাজার আদেশ বলে কথা। তাই জল্লাদ গেইট প্রহরীকে ঠাস্ ঠাস্ করে দুইহাতে মারতে শুরু করলো। শখানেক মারার পর গেইট প্রহরীর জীবন যায়। তখন হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, গেইট প্রহরীকে মাপ করে দিন।’ হিরা’র কথামতো রাজা মাপ করে দিয়ে জল্লাদকে বললো, ‘থেকে যাওয়া বাকি আড়াইহাজার জুতার বাড়ি ছেলেটাকে মারো।’
হিরা বললো, রাজা হুজুর, আরও একজন ভাগীদার আছে।’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘সে কে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনার রাজবাড়ির পরিচ্ছন্নতা কর্মী এই মহিলা।’ রাজা একেবারে ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন, ‘এই সুইপার মহিলাও তোমার কাছে ভাগ চেয়েছে? কী আশ্চর্য! আমার দরবারে কি সবাই চোর বাটপার? এতো দিন মনে হয় এঁরা রক্তচোষা হয়ে আমার রক্ত তো চুষে খেয়েছেই, সাথে আমার রাজ্যের সকলের রক্ত চুষে খেয়েছে। কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি। আজ তোমার কারণে সবাইকে আমার চেনা হয়ে গেল। এই বলেই জল্লাদকে বললো, ‘এই সুইপার মহিলাকে পুরো ১২৫০ টি জুতার বাড়ি মেরে, আরও ৫০টি জোতা বেশি মারবে। একটিও যেন কম না হয়।’ জল্লাদ সাথে সাথে শুরু করে দিল ঠাস্ ঠাস্ ঠাস্ ঠাস্ বাড়ি। সুইপার মহিলা মরে যাবে ভেবে হিরা গিয়ে জল্লাদের হাতে ধরে জুতার বাড়ি থামালেন। জল্লাদ থামলেন।
এবার হিরা রাজাকে বললো, ‘রাজা হুজুর, (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি থেকে আর যা বাকি আছে সব আমাকে মারতে হুকুম দিন।’ এই বলেই হিরা তাঁর শরীরের জামা খুলে খালি গায়ে দরবারের মাঝখানে দাঁড়ালো। তখন রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে হিরা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আজ থেকে তুমিই আমার এই সিংহাসনে বসবে। আমি যে ক’দিন বেঁচে থাকি, তোমার পাশে বসে থাকবো। আজ থেকে তুমিই রাজ্যের রাজা। আমি তোমার প্রজা।
তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-১
এখানেই সমাপ্তি।
loading...
loading...
এক পয়সার এখন। এক পয়সার তখন। আর এক পয়সার এখনো না তখনো না।
উত্তর জানা হলো। অভিনন্দন মি. নিতাই বাবু।
এবং ধন্যবাদ সার্থক একটি পাঁচ পর্বের গল্প উপহার দেবার জন্য।
loading...
শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি দাদা, গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সাথে থেকে, আমার এই নগন্য লেখায় গল্পটা পড়েছেন বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। হুভ দীপালির শুভেচছা রইল।
loading...
সমাপ্তি পর্ব পড়লাম নিতাই দা। চমৎকার আপনার উপস্থাপনা। রাজা'র শর্ত ভীষণ কঠিন ছিলো। হিরা সেটা সহজেই পূরণ করতে পেরেছে। কিন্তু দশ হাজার জুতার বাড়ির অংশটি অতি-সংযোজন মনে হলো। তারপরও গল্পের প্রয়াশ বা অংশ হিসেবে মেনে নিলাম।
loading...
শ্রদ্ধেয় সুমন দাদা, জোতার বাড়ি গল্পেরই অংশ। তবে আপনি গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সাথে থেকে, আমার এই নগন্য লেখায় গল্পটা পড়েছেন বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। জয় গুরু।
loading...
হিরাকে নিয়ে একটা টেনশন তাহলে শেষ হলো।
loading...
শ্রদ্ধেয় কবি সাজিয়া দিদি, গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সাথে থেকে, আমার এই নগন্য লেখায় গল্পটা পড়েছেন বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। জয় গুরু।
loading...
অভিনন্দন নিতাই বাবু। ছোট ধারাবাহিকে দারুণ মজাদার গল্প। হ্যাপী দিওয়ালী।
loading...
শ্রদ্ধেয় কবি দাদা, গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সাথে থেকে, আমার এই নগন্য লেখায় গল্পটা পড়েছেন বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। শুভ দীপাবলির শুভেচ্ছা রইল।
loading...
loading...
শ্রদ্ধেয় কবি দাদা, গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সাথে থেকে, আমার এই নগন্য লেখায় গল্পটা পড়েছেন বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। শুভ দীপাবলির শুভেচ্ছা জানবেন।
loading...
গল্পটি আমি বেশ উপভোগ করেছি দাদা।
loading...
শ্রদ্ধেয় কবি দিদি, গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সাথে থেকে, আমার এই নগন্য লেখায় গল্পটা পড়েছেন বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। দীপাবলির শুভেচ্ছা রইল।
loading...
* লেখকের জন্য শুভ কামনা সবসময়….
loading...
শ্রদ্ধেয় কবি দাদা, গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সাথে থেকে, আমার এই নগন্য লেখায় গল্পটা পড়েছেন বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। শুভ দীপাবলির শুভেচ্ছা রইল।
loading...
অদ্ভুত এক মুগ্ধতার আবেশে গল্পের সমাপ্তির সাক্ষী হয়ে রইলাম প্রিয় কবি দা।
loading...
শ্রদ্ধেয় কবি রিয়া দিদি, গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সাথে থেকে, আমার এই নগন্য লেখায় গল্পটা পড়েছেন বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। শুভ দীপাবলির শুভেচ্ছা রইল।
loading...
ওয়াও উদাহরন হয়ে থাকল এ গল্প এর আগে শুনিনি
খুব সুন্দর বাচ্চাদের শোনাতে হবে

loading...
শেষ অবধি আপনার মন্তব্যে আমার লেখা গল্পটাও সার্থক হলে, শ্রদ্ধে দিদি। গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাশে থেকে উৎসাহ দানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি ভালো থাকবেন, দিদি।
loading...