কয়েকদিন আগে নিজের মোবাইল ফোনে 4G ইন্টারনেট ব্যালেন্স ছিল না। তখন সময় রাত ১০টার মতো। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়ে গেল। এতো রাত পর্যন্ত অফিসের কাজ হাতে থাকা সত্ত্বেও তাড়াতাড়ি করে ফোন ফ্যাক্সের দোকানে গেলাম। দোকানে গিয়ে দেখি বর্তমান যুগের ইন্টারনেট রুগীদের ভিড় লেগে আছে। দুই-চার-পাচ জনকে আগে বিদায় করায়, আমার একটু দেরী হতে লাগলো। তাই আমি দোকানদারকে বললাম, “আঙ্কেল আমার নাম্বারটা লিখে টাকাটা রেখে দাও, তোমার সময় মতো দিয়ে দিও!”
আমার এমন কথায় দোকানের সামনে থাকা একজন বলল, “পরে লেখান। আমার কাজ আছে। তারাবীহ নামাজের সময় দোকান বন্ধ থাকার কারণে অনেকক্ষণ ধরে এখানে বসে আছি। মোবাইলে মেগাবাইট নাই। মাথা নষ্ট!”
ওই লোকটির মতো এমন মাথা নষ্টওয়ালা আরও অনেক দেখেছি, যাদের মোবাইলে ইন্টারনেট না থাকলে তাঁদের মাথা এমনই নষ্ট থাকে। লোকটির কথায় আমি নিশ্চিত হলাম, এই লোক ইন্টারনেট রোগে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আমি ভাবতে লাগলাম! আর আগেকার ফাও চা মানুষের হাতে হাতে দেওয়ার শোনা কথাও মনে পড়ে গেল।
একসময় নাকি এই বঙ্গদেশে বিনা (ফাও) পয়সায় চা-পাতার একটা পুটলি মানুষের হাতে ধরিয়ে দিতো। সাথে চা বানানোর জন্য দিতে ২০০ গ্রাম আন্দাজ চিনি। অনেক সময় চা প্রচারকারীরা সাথে কেরোসিন তেলের চুলাও (স্টোভ) সাথে করে নিয়ে আসতে। গ্রাম শহরের হাট বাজারে বসে চা কীভাবে বানাতে হবে, তা প্রচারকারীরা নিজেই চা বানিয়ে দেখাতো। মানুষকেও খাওয়াত। মানুষ ফ্রি (ফাও) চা হাতে পেয়ে মনের আনন্দে চায়ের পুটলি আর চিনির পুটলি বাড়িতে নিয়ে নিজেরাই চা বানিয়ে পান করতো। এভাবে দিন-মাস-বছর যেতে যেতে একসময় মানুষ চায়ের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লো।
সেসময় এই বঙ্গদেশে গরিব শ্রেণির মানুষের ঘরে চায়ের কাপ ছিল না। কিন্তু প্রায় মানুষেই তখন চায়ের নেশায় আসক্ত। না থাকুক চায়ের কাপ! নারিকেলের আইচা তো আছে? অনেকেই নারিকেলের আইচায় চা পান করে চায়ের তৃপ্তি মেটাত। এর চাক্ষুষ প্রমাণ আমি নিজেই একজন। আমার মাকেও দেখেছি, চা পান করার জন্য নারিকেলের আইচা সুন্দর করে চেঁছে রেখে দিতো। চা পান করার সময় ওই আইচা চায়ের কাপ হিসেবে ব্যবহার করতো।
সেই ফ্রি (ফাও) চা এখন বাংলার ঘরে ঘরে, আনাচে-কানাচে, হাট বাজারে, পাহাড়ের উঁচুতে,নিচে, সাগরের মাঝে, অলিগলিতে, অতিথি আপ্যায়নে, মজলিশে, জলসাঘরে, ক্লাবে, রেস্তোরায়, বিয়ে শাদিতে, সচিবালয়ে, মন্ত্রণালয়ে, জাতীয় সংসদে, গণভবনে, বঙ্গভবন-সহ সবখানে সব জায়গায়। চা ছাড়া বাংলার মানুষের এখন জীবন যায়। একবেলা না খেতে পারলেও সমস্যা নেই! কিন্তু ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাঙালির চা চাই! তা লাগবেই লাগবেই। চা ছাড়া যেন কারোরই রাতের ঘুম হয় না। একসময়ের ফ্রি চা এখন এক কাপ চায়ের দাম ৫ টাকা থেকে শুরু করে ১০টাকা পর্যন্ত। কোনও কোনও জায়গায় আরও বেশি।
অনেকেই মনে করে থাকেন যে, এটা হলো একসময়ে ফাও খাওয়ার খেসারত দেওয়া। এই বঙ্গদেশে একটা কথা প্রচলিত আছে, “ফাও খেলে ঘাও হয়”। আগেকার সময়ের বুড়ো বুড়িদের ছন্দে ছন্দে বানানো কথা আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। ফাও চা খেয়ে যেই খেসারত আমরা এদেশের অগণিত মানুষেই দিচ্ছি। এর চেয়ে বেশি খেসারত দিতে হচ্ছে ফাও মোবাইল সিমের ফাও ইন্টারনেটে। একসময়ের ফ্রি (ফাও) চায়ের মতো মোবাইল সিমও একসময় ফাও দিতো। বর্তমানেও ফাও বিতরণ করছে। আমরা তা ব্যবহার করে চায়ের মতো নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছি। অদূর ভবিষ্যতে আগামী প্রজন্মদের জন্য এর খেসারত হবে আরও বিপদগামী।
একসময়ে ফাও চায়ের মতোই এক ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে, বর্তমান যুগের 3G, 4G নামের ইন্টারনেট। যার সংযোগ থাকে মোবাইল বা সেলফোন তারবিহীন ছোট একটা যন্ত্রে। সবাই এখন এটাকে মোবাইল বলে। এর ভেতরে থাকা সিম কার্ডের সাহায্যে একস্থান থেকে অন্যস্থানে কথা বলা-সহ 4G-এর মাধ্যমে মুহূর্তেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যায়। ছবি দেখা যায়, ভিডিও দেখা যায়। ই-মেইলের মাধ্যমে ছবি সহ বার্তা আদান-প্রদান করা যায়। লেখা যায়। খবর পড়া যায়। বিশেষ অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপস্) ব্যবহার করে টেলিভিশনও দেখা যায়। এমনকি ভিডিও কলও করা যায়।
বর্তমানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ফোন আবির্ভূত হয়েছে। মোবাইল ফোন ছাড়া এখন মানুষের চলেই না। মানুষের জীবন চলার মাঝে খাওয়া-দাওয়া সহ অন্যান্য যা কিছু লাগে, তারমধ্যে মোবাইল ফোন হলো একটি। মোবাইল সাথে থাকতেই হবে। এমনও দেখা যায় বর্তমানে যাদের রাত যাপন করার মতো খেতা- বালিশ বলতে নেই, সেই ব্যক্তির ঘরেও জনপ্রতি একটা করে মোবাইল ফোন আছে। তাই জোর দিয়ে বলা যায় বর্তমানে মোবাইল হলো মানুষের দেহের একটা অংশ।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মোবাইল ফোন চালু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে। হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল) নামে ঢাকা শহরে এএমপিএস মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোন সেবা শুরু করে। এর পর থেকে শুরু হয় তারবিহীন সংযোগের মাধ্যমে কথা বলা। এরপর একের পর এক কোম্পানিগুলোর নিজস্ব সুবিধাদি দেওয়ার প্রতিশ্রুত দিয়ে গ্রাহক আকৃষ্ট করতে শুরু করে। শুরুর দিকে এ ফোন এবং সংযোগ উভয়েরই মূল্য বেশি থাকায় এর ব্যবহার ছিল সীমিত। কিন্তু পরে এর মূল্য সীমিত করায় এর ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতেই থাকে। এর সাথে আগে ছিল 2G ইন্টারনেট সেবা। এরপর 3G, এখন হাতে হাতেই থাকছে 4G ইন্টারনেট। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬টি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি সেবা প্রদান করে আসছে।
প্রথম প্রথম এই ৬টি মোবাইল অপারেটরই গ্রাহক বৃদ্ধি করার জন্য প্রতিযোগিতামূলক চায়ের মতো গ্রাহকদের হাতে বিনামূল্যে সিম তুলে দিতো। একসময় দেখতাম, নারায়ণগঞ্জ শহরে বাংলালিংক, ওয়ারিদ মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ট্রাকে করে ব্যান্ডপার্টি দিয়ে বাজনা বাজিয়ে ট্রাকের উপর থেকে সিম কার্ড রাস্তায় ছিটিয়ে দিতো। মানুষ তা কুড়িয়ে নিতো।
যা এখনও দিয়ে থাকে। তবে সীমিত মূল্যে। সিম কার্ডের যেই মূল্য নিয়ে থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে সিম কার্ড ব্যালেন্সে। এমনও দেখা যায় দুটি সিম কিনলে সাথে দিবে সাংসারিক কাজে ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রী। যেমন– একটা বাটি। একটা টিফিন ক্যারিয়ার বক্স। নাহয় টি-শার্ট অথবা গেঞ্জি। আর ফ্রি (ফাও) কথা (টকটাইম) বলার তো সুযোগ থাকছেই। নতুন সিমের সাথে দিচ্ছে ফ্রি (ফাও) 4G নামের নামমাত্র ইন্টারনেট সেবাও।
তাহলে এখন বুঝাই যাচ্ছে, আগেকার সময়ের ফ্রি (ফাও) চা-পাতা হাতে পাবার মতো হয়েছে, ফ্রি (ফাও) সিম হাতে পাবার ঘটনা। একসময় চা প্রচারকারীরা জানতো যে, “বাঙালি এভাবে ফাও খেতে খেতে একদিন চায়ের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়বে। তখন আর প্রচার করা লাগবে না। চায়ের নেশা আসক্ত ব্যক্তিরাই চায়ের প্রচার করতে থাকবে। আর আমরা বসে বসে মোছে তেল মাখবো।”
হাতে হাতে ফ্রি চায়ের মতো একইরকম অবস্থা দেখা যায়, ফ্রি (ফাও) সিম, আর ফ্রি ইন্টারনেটের বেলাও। এখন বাংলার প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে দেখা যাচ্ছে ইন্টারনেট নেশায় আসক্ত রুগী। যা চায়ের নেশার মতো হয়েছে অবস্থা। ইন্টারনেট নেশায় আমরা এখন গ্রাম শহরের সবাই আসক্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের এইরকম নেশাগ্রস্ত অবস্থা দেখে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো নানাভাবে প্রতারণার সুযোগও কাজে লাগাচ্ছে। তাঁরা বর্তমানে কল রেট সীমিত রেখে সরকারের বাহবা কুড়িয়ে, 4G নামের ইন্টারনেট সেবার নামে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তা আমরা অনেকেই টের পেয়েও পাচ্ছি না। কারণ, আমরা সবাই এখন ইন্টারনেট নেশায় আসক্ত। তাই এবিষয়ে কেউ প্রতিবাদও করছি না বা কেউ করছেও না।
মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো রিচার্জ ব্যালেন্স টিক রেখে 4G ইন্টারনেটে বেঁধে দিচ্ছে ফাঁসির মতো সময়সীমা। যাকে বলে মেয়াদ! মোবাইলে 4G ব্যালেন্স থাকা সত্ত্বেও, এর মেয়াদকাল শেষ হয়ে গেলে মোবাইল স্ক্রিনে 4G ব্যালেন্স দেখায় 00। তাঁরা বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্নরকম 4G প্যাকেজের অপার গ্রাহকদের দিয়ে থাকে। যদি কেউ ১জিবি মেগাবাইট ১সপ্তাহ মেয়াদে কিনে, ১সপ্তাহের মধ্যে ১কেবি মেগাবাইটও খরচ না করে; তাহলেও নির্দিষ্ট সময়ে গ্রাহকের কষ্টার্জিত টাকায় কেনা ১জিবি ইন্টারনেট ব্যালেন্স 00 হয়ে যাচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে! এরকম বাটপারি জুচ্চুরি সরকারি টেলিটকও করছে। দেশে থাকা অন্যান্য মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর পথ অনুসরণ করে দেশের জনগণের সাথে প্রতারণায় লিপ্ত রয়েছে। বর্তমান সময়ে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর এরকম প্রতারণার ফাঁদ দেশের জনগণ দেখে-ই-না। আর দেখলেও কিছু বলতে পারে না। কারণ, দেশের প্রায় মানুষই এখন একসময়ের ফাও চায়ের নেশার মতো ফাও সিমের ইন্টারনেট নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে, তাই।
loading...
loading...
আপনি ঠিকই বলেছেন মি. নিতাই বাবু। গ্রামীন ফোন কিভাবে মেগাবাইট চুরি করে টের পাই নাই। তবে অন্যান্য অপারেটর যারা রয়েছেন, মাশাল্লাহ একের সাথে আরেকজন পাল্লা দিয়ে মেগাবাইট কিলোবাইট চুরি করে। মোবাইল বন্ধ থাকলেও চুরি করে।
loading...
বর্তমানে আমাদের দেশে ৬টি মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট প্যাকেজে বেঁধে দেওয়া সময়সীমা হলো সবচেয়ে বেশি প্রতারণা ফাঁদ। আমি মেগাবাইট কিনবো, আমার ইচ্ছেমত খরচ করবো। এটাই হোক নিয়ম।
loading...
ফাও চা পাতায় আর ফাও সিম কার্ডের নেশায় আমরা আসক্ত। জাতি এখন নেশাভক্ত।
loading...
সত্যি দাদা আমরা বেশিরভাগ মানুষেই বর্তমানে ইন্টারনেট রুগী হয়ে গেছি।
loading...
ভারতেও এই বিষয়টির সাথে যথেষ্ঠ মিল রয়েছে। কদিন আগে ১৫৪ রুপিতে একটা রিলায়েন্সের মোবাইল পেলাম। দেড় ইঞ্চি মনিটরে সকল কারবার। বাঙালরা শুধু নয়, সারা ভারতে হৈ রৈ্ উঠে গিয়েছিলো। সেই ফোনে এখন প্যাকেজ বা পাওয়ার লোড মূল্য আকাশ ছোঁয়া করে দিয়েছে। নাও ঠ্যালা।
loading...
এই ঠেলা আমাদেরও সামলাতে হবে দাদা। সবেমাত্র শুরু!
loading...
আমরা যা পাই তাই ধরি। এতোদিন জানতাম নেশাদ্রব্যে আমাদের আসক্তি। এখন দেখি সমাজের প্রায় সবাই ই আমরা কমবেশী এই ধরণের আসক্তিতে ভুগছি।
loading...
সত্যি বলতে আমি নিজেই একজন ইন্টারনেট রুগী সেজে বসে আছি। ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় দিদি।
loading...
বর্তমান সময়ে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর এরকম প্রতারণার ফাঁদ দেশের জনগণ দেখে-ই-না। আর দেখলেও কিছু বলতে পারে না। কারণ, দেশের প্রায় মানুষই এখন একসময়ের ফাও চায়ের নেশার মতো ফাও সিমের ইন্টারনেট নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে, তাই। সত্য।
loading...
পরকে দেখিয়ে লাভ নেই দিদি। আমি নিজেই এর জ্বলন্ত প্রমা!
loading...
ফাও পাইলে আর কী লাগে।
loading...
সত্যি আমরা একরকম লোভী জাতি। ফাও পেলে আর ছাড়ি না!
loading...