আগেকার হাতে খড়ি বর্তমানে শিশুর স্কুলব্যাগ!

শিশুদের জন্য “হাতে খড়ি” উৎসব আগে গ্রাম শহরের সবখানে প্রচলিত থাকলেও, বর্তমানে এর বিন্দুবিসর্গ বলতে নেই বা কারোর চোখেও পড়ে না। আক্ষরিক অর্থে হাতে খড়ি হচ্ছে, লেখাপড়ার সাথে শিশুর প্রথম পরিচয়। শিশু জন্মের তিন থেকে চারবছরের মাথায় এই উৎসবটি পালন করা হতো। তা বেশি প্রচলন দেখা যেত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে। জন্মের পর থেকে জীবনে যতোগুলো উৎসব পালন করা হয়, তারমধ্যে হাতে খড়ি শিশুদের জন্য খুবই একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ছিল।

হাতে খড়ি অর্থ হলো, শিক্ষার সূচনা বা শিক্ষার শুরু। এই উৎসবটি পালন করা হতো, সরস্বতী পূজা উপলক্ষে, নাহয় সরস্বতী পূজার পরপর এক সপ্তাহের মধ্যে শনিবার বাদে যেকোনো দিন।

অনেকে এই বিশেষ উৎসবটি সরস্বতী পূজার দিনই করে ফেলতো। কেননা, সরস্বতী পূজা মানেই বিদ্যাদেবীর পূজা। তাই ওইদিন পুরোহিত সরস্বতী পূজা সম্পাদন করা শেষে, এই হাতে খড়ি উৎসবটির কাজ সম্পন্ন করতো।

যেসব অভিভাবকগণ তাঁদের শিশুকে হাতে খড়ি দিতে ইচ্ছুক থাকতো, সেসব শিশুদের হাতে খড়ি দেওয়ার কাজটি পূজামণ্ডপেই করে ফেলা হতো। যেসব শিশু বাদ পড়তেন, পূজার পর শনিবার বাদে যেকোনো দিন তাঁদের হাতে খড়ি উৎসবের কার্যসম্পাদন করা হতো। আগেকার সময়ে বেশিরভাগ শিশুদেরই হাতে খড়ি দিয়ে লেখাপড়া শুরু করা হতো। তা ধনী আর গরিবদের মধ্যে কোনও ব্যবধান ছিল না। তবে ধনীব্যক্তিদের সন্তানদের একটু জাঁকজমকভাবেই করা হতো। কেননা, ধনীব্যক্তিদের ধনসম্পদ বেশি বলে, তাঁদের নিয়মনীতিও একটু বেশি থাকতো, তাই। তবে সব পিতামাতাই তাঁদের সন্তানকে হাতে খড়ি দেওয়ার নিয়মটা করেই স্কুলে পাঠিয়েছেন।

আমারও হাতে খড়ি দেওয়া হয়েছিল। কীভাবে দেওয়া হয়েছিল, তা স্পষ্ট মনে না থাকলেও, একটু বড় হয়ে যাদের হাতে খড়ি উৎসব দেখেছি, তা খুবই মনে আছে। সরস্বতী পূজার আগের দিনই শিশুর অভিভাবক এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পূজা কার্যসম্পাদনকারী পুরোহিতকে অবহিত করে রাখতেন।

সরস্বতী পূজার আগে বা হাতে খড়ি উৎসবের আগের দিন বাঁশের কঞ্চি (ছিপ), কলাপাতা, একটা খালি দোয়াত, গরুর খাটি দুধ, ধান-দূর্বা, ফুল-তুলসী সহ কিছু ফলফলারি সংগ্রহ করে রাখা হতো। হাতে খড়ি উৎসবের দিন ভোর থেকে শিশুকে কিছুই খেতে দিতেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত হাতে খড়ি কার্যসম্পাদন না হতো।

এমনিতেই যেকোনো পূজার আগের দিন সংযম পালন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়মনীতি। তাই ছোটবেলায় শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজায় সংযমের দিন মাছ-মাংস পরিহার করা এমনিতেই ছিল বাধ্যবাধকতা, তারমধ্যে বাড়তি যোগ হচ্ছে হাতে খড়ি! শিশুটির নিরামিষ আহার, আতপ চালের ভাত খাওয়া, উপোস থাকা সম্ভব হবে কি-না এসব নিয়ে পূজার আগের দিন শিশুর অভিভাবকগণ খুবই দুশ্চিন্তায় থাকতে হতো।

সরস্বতী পূজার পুষ্পাঞ্জলি অর্পণে হতো আনন্দঘন এক আয়োজন! পুষ্পাঞ্জলি পর্বের পরপরই একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা কোমলমতি শিক্ষার্থীও ধর্মীয় চেতনায় দিয়ে থাকতো হাতে খড়ি। পুরোহিত হাতে খড়ি দিতে বা নিতে ইচ্ছুক সব শিশুদের একসারিতে বসাতেন। শিশুর সামনে থাকতো কাগজের মতো কলাপাতার চিকণ টুকরো। আর গরুর খাটি দুধে জল মিশ্রিত একটা দোয়াত। দোয়াতে থাকতো কলমের মতো চোকা একটা ছোট বাঁশের কঞ্চি(ছিপ)। শিশুর পেছনে থাকতো শিশুর মা, বাবা অথবা বড়দিদি।

পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করে দোয়াত থেকে কলমের মতন কঞ্চি দিয়ে এক এক করে প্রত্যেক শিশুর সামনে থাকা কলাপাতায় অ-আ ক-খ লিখে দিতেন। এরপর শিশুর পেছনে বসা মা, বাবা অথবা বড়দিদিরা শিশুর হাতে কঞ্চি ধরিয়ে পুরোহিতের অ-আ ক-খ-এর উপর শিশুর হাত ঘোরাতেন। কয়েকবার ঘোরানোর পর পুরোহিত সবার বিদ্যাবুদ্ধি কামনা করে সরস্বতী দেবির নিকট প্রার্থনার মধ্যদিয়ে শেষ করতেন, হাতে খড়ি উৎসব। এরপর থেকেই শিশুর লেখা-পড়ার জন্য চলতো শতরকমের চেষ্টা প্রচেষ্টা।

এই যুগে আর হাতে খড়ি উৎসবটা দেখা যায় না। আর হাতে খড়ি কাকে বলে এবং হাতে খড়ি কী, তাও অনেকে জানেনা। এখন শুধু জানে এবং বুঝে, শিশুর বয়স তিনবছর হলেই; শিশুকে ইংলিশস্কুল বা কিন্ডারগার্টেন ভর্তি করতে হবে। আর শিশুর কাঁধে একটা সুন্দর বেশি দামি বড়সড় স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে দিয়ে হবে।

তাই এখন দেখা যায় শিশুর বয়স তিনবছর হলেই, শিশুর কাঁধে বড় একটা স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে দিয়ে কিন্ডারগার্টেন নিয়ে যেতে। এটা একরকম আধুনিক যুগের ফ্যাশনও বলা চলে। এমনও দেখা যায়, শিশু তাঁর হাতের বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে যাচ্ছে। সাথে সেজে-গুঁজে যাচ্ছে শিশুর মা অথবা অন্য কেউ। শিশুকে ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে, শিশুর ছুটি না হওয়া পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেনের আশেপাশেই ডিউটি দিচ্ছে।

স্কুল ছুটির পর আবার বিশাল একটা স্কুলব্যাগ শিশুর পিঠে ঝুলিয়ে দিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। কেউ হেঁটে, কেউবা গাড়িতে। শিশুর স্কুলব্যাগের ভেতরে থাকছে, পানির বোতল, প্লাস্টিকের টিফিন বাটি সহ পড়ার চেয়েও বাড়তি কিছু বই। যা শিশুর অভিভাবকরা খুব সখ করে শিশুর স্কুলব্যাগের ভেতরে ভরে দেয়। যাতে শিশুর কাঁধে ঝুলানো স্কুলব্যাগটি একটু বড় দেখা যায়। যত বড় স্কুলব্যাগ হবে, তত বাড়বে শিশুর অভিভাবকদের প্রশংসা। তাই সময়সময় দেখা যায়, বিশাল স্কুলব্যাগের ভারে শিশু কুঁজো হয়ে যাচ্ছে। তবুও শিশুটিকে স্কুলব্যাগ বহন করতেই হচ্ছে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৪ টি মন্তব্য (লেখকের ৭টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. রুকশানা হক : ০২-০৪-২০১৯ | ৮:৪০ |

    চমৎকার একটা বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছেন দাদা। হাতেখড়ি অনুষ্ঠানটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে এলেও আগেকার দিনে তা বেশ ঘটা করেই পালিত হতো শিক্ষিত পরিবার গুলোতে । মনে পড়ে প্রথম কালো স্লেট আর পেন্সিল কিংবা খড়ি দিয়ে শুরু হতো লেখালেখি । 

    আজকাল একটি শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করার সময় থেকেই  শুরু করতে হয় ভর্তিযুদ্ধ। লেখাপড়ার প্রতি ভীতি সঞ্চার করা হয় উদ্ভট প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে।  আনুষ্ঠানিক পাঠ শুরু করার সময় বা মানসিকতা কোনটাই থাকেনা পিতামাতার। 

    সুন্দর পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।                          

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০২-০৪-২০১৯ | ২২:২৮ |

      এই প্রতিযোগিতাই এখনকার দিনের বাস্তবতা শ্রদ্ধেয় কবি দিদি। বর্তমান হিন্দু, বৌদ্ধ, আর ইহুদি, খ্রিষ্টান কেউ সেসব নিয়মনীতি নিয়ে মাথাও ঘামায় না। শুধুই টেনশন শিশুকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে হবে। মানুষ হোক-বা-না হোক, সেটা পরের কথা। আগে থেকেই মহা চিন্তা নিয়ে শুধু স্বপ্ন দেখা! এই হলো আমাদের চিন্তা চেতনা । 

      আপনার সুন্দর মূল্যবান মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম শ্রদ্ধেয় কবি দিদি। আশা করি ভালো থাকবেন ।

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ০২-০৪-২০১৯ | ৯:০২ |

    শিশুদের হাতে খড়ি উৎসব আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমার জীবনেও অতো অতো বই নিয়ে স্কুলে যাইনি। বিশালাকার স্কুলব্যাগের ভারে আমাদের শিশুরা যেন কুঁজো হয়ে যাচ্ছে। ৪টি বইয়ের জায়গায় ব্যাগে ঠাঁই করে নিয়েছে অপ্রয়োজনীয় সব বই। মেধা বিকাশে যে বয়সে যে প্রকরণের প্রয়োজন, আমাদের অভিবাবকদের প্রতিযোগিতার মধ্যে সেই প্রয়োজনটাই হারিয়ে গিয়েছে। ঘর বন্দি করে ফেলেছি আমাদের শিশুদের। উত্তোরণ প্রয়োজন।   

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০২-০৪-২০১৯ | ২২:২৬ |

      এই প্রতিযোগিতাই এখনকার দিনের বাস্তবতা শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। বর্তমান হিন্দু, বৌদ্ধ, আর ইহুদি, খ্রিষ্টান কেউ সেসব নিয়মনীতি নিয়ে মাথাও ঘামায় না। শুধুই টেনশন শিশুকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে হবে। মানুষ হোক-বা-না হোক, সেটা পরের কথা। আগে থেকেই মহা চিন্তা নিয়ে শুধু স্বপ্ন দেখা! এই হলো আমাদের চিন্তা চেতনা । 

      আপনার সুন্দর মূল্যবান মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। আরও আনন্দিত হয়েছি, আমার এই নগণ্য লেখনীয় পোস্ট শব্দনীড় ব্লগে বিশেষ নির্বাচিত হওয়ায়। চিরকৃতজ্ঞ শব্দনীড় ব্লগ টিমের কাছে।

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ০২-০৪-২০১৯ | ২২:৫৮ |

        শব্দনীড় যোগ্য লিখাকে সম্মান দিতে জানে। স্বাগতম মি. নিতাই বাবু।

        GD Star Rating
        loading...
      • নিতাই বাবু : ০৩-০৪-২০১৯ | ১:২২ |

        অশেষ ধন্যবাদ ও শুভকামনা সবসময় ।

        GD Star Rating
        loading...
  3. রিয়া রিয়া : ০২-০৪-২০১৯ | ১৯:৪০ |

    হাতে খড়ি অর্থ হলো, শিক্ষার সূচনা বা শিক্ষার শুরু। এই উৎসবটি পালন করা হতো, সরস্বতী পূজা উপলক্ষে, নাহয় সরস্বতী পূজার পরপর এক সপ্তাহের মধ্যে শনিবার বাদে যেকোনো দিন। কী আনন্দই না হতো। সব মনে পড়ে প্রিয় কবি দা। এখন শিশুকে ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে, শিশুর ছুটি না হওয়া পর্যন্ত অভিভাবকরা কিন্ডারগার্টেনের আশেপাশেই ডিউটি দেয়। এই কথাটিও মিথ্যা নয়। চোখের সামনে কত কিছুই না বদলে যেতে দেখলাম !!  Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০২-০৪-২০১৯ | ২২:৩২ |

      শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি, আগেকার ধর্মীয় নিয়মনীতি যেন সবই হারিয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু সবখানে চলছে প্রতিযোগিতা। 

      GD Star Rating
      loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০২-০৪-২০১৯ | ২০:৩৮ |

    কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই, আজ আর নেই…। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০২-০৪-২০১৯ | ২২:৩৩ |

      আগেকার নিয়মনীতি কিছুই থাকবে না শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। থাকবে শুধু বেঁচে থাকার যুদ্ধ। 

      GD Star Rating
      loading...
  5. সুমন আহমেদ : ০২-০৪-২০১৯ | ২০:৫৮ |

    শিশুদের জন্য “হাতে খড়ি” উৎসব আগে গ্রাম শহরের সবখানে প্রচলিত থাকলেও, বর্তমানে এর বিন্দুবিসর্গ বলতে নেই বা কারোর চোখেও পড়ে না। এটাই বাস্তবতা। 

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০২-০৪-২০১৯ | ২২:৩৪ |

      সুন্দর মূল্যবান মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম, শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন ।

      GD Star Rating
      loading...
  6. শাকিলা তুবা : ০২-০৪-২০১৯ | ২১:১৩ |

    শিশুর কাঁধে সুন্দর দামি বড়সড় স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে দেয়াটাই এখন প্রতিযোগিতা এবং ফ্যাশন। 

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৩-০৪-২০১৯ | ৯:১৬ |

      এই ফ্যাশনের যুগে আগেকার সবকিছুই যেন হারিয়ে যাচ্ছে শ্রদ্ধেয় কবি দিদি।

      GD Star Rating
      loading...