কামরূপ কামাখ্যা কি সত্যি যাদুর দেশ?

আমাদের দেশে ওঝা, বৈদ্য কবিরাজ, ফকির, সাধু, সন্যাসীর অভাব নেই। গ্রামে, গঞ্জে, হাটে বাজারে, শহরে, বন্দরের আনাচে-কানাচে, রাস্তাঘাটে, ফুটপাতে সবখানেই এসব ওঝা, বৈদ্য আর ফকির সাধুদের আনাগোনা চোখে পড়ে। তাঁরা সবসময়ই কামরূপ কামাখ্যার দোহাই দিয়ে তাবিজ কবচ মানুষের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইচ্ছেমত টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিচ্ছে। তাঁদের মুখে কামরূপ কামাখ্যার কথা শুনে মানুষ একরকম অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে যতগুলো দেশ আছে, এসব দেশের বেশিরভাগ মানুষই একরকম অন্ধবিশ্বাসী হয়ে বিভিন্ন ওঝা, বৈদ্য, ফকির, মাস্তান, সাধু, সন্যাসীদের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। এই অন্ধবিশ্বাসী মনোভব ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার, বাংলাদেশ হলো অন্যতম।

এসব দেশের মানুষের মনে যেমন আছে বিশ্বাস, তার চেয়ে বেশি আছে অবিশ্বাস। নিজের ঘরের মানুষটাকে বিশ্বাস করতে চায় না, অথচ একজন ভণ্ড সাধু, ওঝা, ফকির, মাস্তানের কথা বিশ্বাস করে থাকে। আবার যেমন দয়ালু, তার চেয়ে বেশি কৃপণ। আপন মায়ের গর্ভজাত ভাই না খেয়ে থাকলেও, তাকে কিছুই দিবে না। অথচ একজন ভণ্ড ফকিরের কথা বিশ্বাস করে তাকে হাজার হাজার টাকা দান দক্ষিণা দিয়ে দেয়। এই হলো আমাদের অন্ধবিশ্বাসের কিছু নিয়মনীতি।

আমাদের দেশের মানুষ অনেকেই জানে না যে কামরূপ কামাখ্যা আসলে কী! কামরূপ কী? কামাখ্যা কী? জানে না কামরূপ কামাখ্যা কোথায় এবং কোন স্থানে। কামরূপ কামাখ্যার তথ্যবিধান না জানার কারণে, ওঝা, বৈদ্য, ফকির, সাধুদের মুখে কামরূপ কামাখ্যার কথা শুনেই কিছু অন্ধবিশ্বাসী মানুষ ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কথিত ফকির সাধুগণ ঘোড়ার লোম, বাঘের ছাল, মহিষের শিং, আগাছা, পরগাছা, বালু, মাটি খাওয়াইয়া আর তাবিজের ভেতরে ঢুকাইয়া হাতিয়ে নিচ্ছে সহজসরল মানুষের কষ্টার্জিত টাকাপয়সা। ওইসব ওঝা বৈদ্যদের মুখে শুধু কামরূপ কামাখ্যার দোহাই বেশি থাকে।

এদেশের কিছু ভণ্ড ওঝা ফকিররা বলে, “কামরূপ কামাখ্যা হলো যাদুর দেশে! সেখানে মানুষ যেতে পারে না। যদি কেউ প্রাণপণ চেষ্টা করে একবার কামরূপ কামাখ্যা পৌঁছতে পারে, তাহলে সে আর ফিরে আসতে পারে না। যদিও আসে তো অনেক সাধনার বলে।”

অনেক ওঝা ফকির বলে, “আমি আসেছি প্রায় দুই যুগ পরে। অনেক তন্ত্রমন্ত্র শিখে আসেছি। আমি ইচ্ছে করলে এখন যা খুশি তা-ই করতে পারি, দেখাতেও পারি। কিন্তু না, তা আমি করবো না। আমি মানুষের উপকার করার জন্য খুব কষ্ট করে কামরূপ কামাখ্যা থেকে আপনাদের মাঝে ফিরে আসেছি।”

আবার অনেক সাধু সন্যাসী বলে, “কামরূপ কামাখ্যায় পুরুষ মানুষ বাঁচে না। সেখানে পুরুষ মানুষের খুবই অভাব! সেখানে প্রতিবছর বিশেষ একটি সময়ে সিংহে ডাক দেয়। সিংহের ডাক পুরুষের কানে গেলে সেই পুরুষের পুরুষলিঙ্গ পড়ে যায়। তার মানে হলো, ঐ পুরুষের আর পুরুষত্ব থাকে না। সেই পুরুষ হিজড়ায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।”

আবার অনেক ওঝা কবিরাজ বলে, “যখন সিংহে ডাক দেওয়ার সময় হয়, তখন সেখানকার নারীরা পুরুষের পুরুষত্ব আর পুরুষলিঙ্গ টিকিয়ে রাখার জন্য যারযার পুরুষকে মাটির গর্তের ভেতরে রেখে উপরে ঢাকঢোল বাজাতে থাকে। যাতে সিংহের ডাকের শব্দ পুরুষের কানে না যায়।”

আবার অনেক ফকির বলে, “কামরূপ কামাখ্যা যাবার পথে একটা নদী আছে। নদীর এপারে মানুষের ঘনবসতি থাকলেও, ওপাড়ে শুধু নারী। নদীর ওপাড়ে হলো কামরূপ কামাখ্যা রাজ্য। নদীর এপার ওপাড় বনজঙ্গল আর নানান জাতের বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। যিনি কামরূপ কামাখ্যা যেতে ইচ্ছুক, তিনি নদীর পাড়ে গিয়ে নদীর জল স্পর্শ করার সাথে সাথে ওপাড় থেকে একটা মাঝিবিহীন ডিঙি নৌকা তাঁর সামনে চলে আসবে। ডিঙি নৌকায় ওঠার সাথে সাথে নৌকা এপার থেকে ওপাড়ের উদ্দেশে রওনা হতে থাকবে। নৌকা নদীর ওপাড় ভিড়তেই তাঁর সামনে হাজির হয়ে যাবে কয়েকশ কামাখ্যা নারী। তখন আগত পুরুষমানুষটিকে নিয়ে শুরু হবে টানাটানি। কেউ বলবে, আমার ঘরে যাবে। কেউ বলবে আমার ঘরে থাকবে। এভাবে চলবে বাকবিতণ্ডা। অবশেষের কামরূপ কামাখ্যার বুড়ো সরদারনী এসে কয়েকজন নারীর মাঝে পুরুষমানুষটিকে ভাগ করে দিবে। শর্ত থাকবে, এঁদের মাঝে ৭ দিন, আর ওদের মাঝে ৭ দিন। এভাবে চলতে থাকবে পুরুষমানুষটির জীবন। অনেক নারীদের সাথে মেলামেশার কারণে কিছুদিন যেতে না যেতেই পুরুষমানুষটির শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর পুরুষমানুষটি নানানরকম অজুহাত দেখিয়ে নিজ দেশে ফিরে আসতে চাইবে।

“তখন কামরূপ কামাখ্যার নারীরা বলে, “তোমাকে তো আমরা বেধে রাখিনি? তুমি মুক্ত অবস্থাতেই আছো! তুমি ইচ্ছে করলেই তোমার দেশে চলে যেতে পার!” নারীদের মুখে এসব কথা শুনে পুরুষমানুষটি রাতের আঁধারে পালিয়ে আসার প্রস্তুতি নিয়ে হাঁটতে থাকে। সারারাত হাঁটতে হাঁটতে শরীর প্রায় অবসন্ন হয়ে পড়ে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দেখে যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছে, ঠিক সেখানেই রয়ে গেছে। এভাবে অনেকদিন চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই আর ফিরে আসতে পারে না। অবশেষে সেখানেই থেকে যায়। কেউ যদি আসতে পারে, তো অনেক তপস্যার বিনিময়ে আসতে হয়।”

কামরূপ কামাখ্যা থেকে নিজ দেশে ফিরে এসেই শুরু করে দেয় তেলেসমাতি ফৌকরালী চিকিৎসা। আর সহজসরল কিছু মানুষও মনের বিশ্বাসে রোগমুক্তির আশায় ওইসব কামরূপ কামাখ্যাবেশী ফকির, সাধু, ভণ্ড ওঝাদের শরণাপন্ন হতে থাকে।

আবার অনেক বুড়ো-বুড়ির মুখে শোনা যায়, “কামরূপ হলো পুরুষ, আর কামাখ্যা হলো নারী। কামরূপ রাজা ছিলেন, একজন বিখ্যাত যাদুকর। জাদুমন্ত্রই ছিল তাঁর একমাত্র শক্তি। কামাখ্যা দেবীর ছিলেন খুবই সুন্দরি রূপবতী। কামরূপ রাজা কামাখ্যা দেবীর রূপ দেখে একসময় কামাখ্যা দেবীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কামরূপ রাজার এমন প্রস্তাবকে কামাখ্যা দেবী প্রত্যাখ্যান করে। তারপরও কামরূপ রাজা তাঁর উজির নাজির আর সৈন্যসামন্ত দিয়ে বারবার কামাখ্যা দেবীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতেই থাকে। কামাখ্যা দেবী বিরক্ত হয়ে একসময় রাজি হয়ে যায়, শর্ত দিয়ে। শর্ত হলো, নদীর এপার হলো কামাখ্যা দেবীর রাজ্য, আর ওপাড় হলো, কামরূপ রাজার রাজ্য। নদীর এপারও পাহাড়, ওপাড়ও পাহাড়। কামাখ্যা দেবীকে বিয়ে করতে হলে নদীর ওপাড়ে থাকা পাহাড় একরাতে মধ্যে এপারের পাহাড়ের সাথে একত্রিত করে দিতে হবে। তা হতে হবে সন্ধ্যা শুরু থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ে। কামাখ্যা দেবীর শর্ত কামরূপ রাজা হাসিমুখে মেনে নেয়।

“একসময় দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হলো। সন্ধ্যালগ্ন শুরু থেকে কামরূপ রাজা তাঁর তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে এপারের পাহাড় ওপাড়ে চালান করতে লাগলো। রাতদুপুরে কামাখ্যা দেবী ধ্যানে বসে দেখতে পায়, কামরূপ রাজার পাহাড় কামাখ্যা দেবীর রাজ্যের পাহাড়ের সাথে একত্রিত হতে সামান্য বাকি। কিছুক্ষণের মধ্যের কামরূপ রাজার রাজ্যের পাহাড় কামাখ্যা দেবীর রাজ্যের পাহাড়ের সাথে একত্রিত হয়ে যাবে। দুই রাজ্যের দুই পাহাড় একত্রিত হয়ে গেলেই, যাদুকর কামরূপ রাজাকে তাঁর বিবাহ করতেই হবে। তাহলে তো কামাখ্যা দেবী কামরূপ রাজার কাছে হেরেই গেল। এই হার কিছুতেই কামাখ্যা দেবী মেনে নিতে পারবে না। তাই কামাখ্যা দেবী তাঁর আধ্যাত্মিক তন্ত্রমন্ত্র শুরু করে দেয়। একপর্যায়ে কামাখ্যা দেবী একটি মোরগের রূপধারণ করে এবং কামরূপ রাজার কানের সামনে কুক্কুরু কু আওয়াজ করে। কামরূপ রাজা মোরগের ডাক শুনে ভাবলো যে, হয়ত সূর্যোদয় হতে শুরু করেছে। তাই তাঁর তন্ত্রমন্ত্র থামিয়ে দেয়। এর ফলে কামরূপ রাজার তন্ত্রমন্ত্র দ্বারা চালান করা পাহাড় কামাখ্যা দেবীর পাহাড়ের সাথে মিশতে পারলো না। কামরূপ রাজা কামাখ্যা দেবীকেও আর বিয়ে করতে পারলো না।” এরকম আরও অনেক রূপকথার কাহিনী লোকমুখে এখনো প্রচলিত আছে।

আসলে ঘটনাটা কী? সত্যি কি কামরূপ কামাখ্যা যাদুটোনার দেশ? নাকি সবই ভুয়া? মনে হয় সবই ভুয়া! কেননা, বিশ্ববিখ্যাত ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউবে যখন কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরের ভিডিওগুলো দেখি, তখন মনে হয় না যে, কামরূপ কামাখ্যা সত্যিকারের যাদুটোনার দেশ। এসব ভণ্ড ওঝা, ফকির, সাধুদের বানানো কথা মাত্র। সত্যিকারার্থে কামরূপ হলো একটা, আর কামাখ্যা হলো হিন্দু শাস্ত্রের পবিত্র শক্তিপীঠের এক পীঠ। যার নাম কামাখ্যা শক্তিপীঠ বা কামাখ্যা মন্দির।

youtube.com/watch?v=eJNUXVMq3VY

তাহলে জেনে নিতে পারি কামরূপ কী আর কামাখ্যা-ই-বা কী? কামরূপ কামাখ্যার ব্যাখ্যা দিতে হলে, আগে হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত ৫১ শক্তিপীঠ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হয়।

শক্তিপীঠ হলো, হিন্দুধর্মের পবিত্রতম তীর্থস্থানগুলোর অন্যতম। লোকবিশ্বাস অনুসারে, শক্তিপীঠ নামাঙ্কিত তীর্থগুলিতে দক্ষ রাজার কন্যা দেবী দাক্ষায়ণী সতী
দেহের নানান অঙ্গ ও দেহে থাকা স্বর্ণালঙ্কার ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে রক্ষিত আছে। শাস্ত্রমতে ৫১টি শক্তিপীঠের কথা বলা হয়ে থাকলেও, শাস্ত্রভেদে শক্তিপীঠের সংখ্যা ও অবস্থান নিয়ে মতভেদও আছে। তবে এই ৫১টি পবিত্র শক্তিপীঠ মন্দির এবং স্থান ইতিহাসের পাতায় সুলিখিতভাবে বর্ণিত রয়েছে। তাহলে শক্তিপীঠ কী এবং কীভাবে?

সনাতন ধর্মের শাস্ত্র ঘেঁটে আর বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় সত্যযুগের এক ঘটনার ইতিহাস। সত্য যুগের কোনও এক সময়ে মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষ রাজা বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। দক্ষ রাজার কন্যা ছিলেন, দাক্ষায়ণী সতী দেবী। কন্যা সতী দেবী দক্ষ রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যোগী মহাদেবকে বিবাহ করায়, দক্ষ রাজা মেয়ে এবং মহাদেবের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই দক্ষ রাজা তাঁর যজ্ঞানুষ্ঠানে মহাদেব ও সতী দেবী ছাড়া প্রায় সকল দেব-দেবীকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। পিত্রালয়ে পিতার আয়োজন করা যজ্ঞানুষ্ঠান হচ্ছে জানতে পেরে সতী দেবী মহা খুশি। কন্যা খুশি পিত্রালয়ের জাঁকজমক আয়োজনে। কিন্তু নিমন্ত্রণ পাননি! তাতেও সতী দেবী দুঃখিত নয়, বরং খুশি! কারণ, দক্ষ রাজা সতী দেবীর জন্মদাতা তাই। যজ্ঞানুষ্ঠানের দিন যথাসময়ে মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী দেবী তাঁর অনুসারীদের সাথে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু সতী দেবী আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায়, তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। সত্যিকারার্থে দক্ষ রাজা মহাদেবকেই অপমান করেন। সতী দেবী তাঁর স্বামীর প্রতি পিতার এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন।

সতী দেবীর শোকে শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষ রাজার যজ্ঞ ভণ্ডুল করেন এবং সতী দেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করে দেন। মহাদেবের এমন প্রলয় নৃত্যে পৃথিবী কাঁপতে শুরু করে। তখন অন্যান্য দেবতা মহাদেবকে তাঁর প্রলয় নৃত্য থামাতে অনুরোধ করেন। সকল দেবতাদের অনুরোধে অবশেষে যোগী মহাদেব তাঁর প্রলয় নৃত্য থামিয়ে একরকম শান্ত হন। এরপর বিষ্ণুদেব তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতী দেবীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী দেবীর মৃতদেহে থাকা স্বর্ণালঙ্কার সহ ৫১ খণ্ড হয়ে যায়। এই ৫১টি দেহখণ্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে এবং পবিত্র শক্তিপীঠস্থান হিসেবে পরিচিতি পায়। যেমন– একস্থানে পড়েছে, হাত, একস্থানে, পায়ের আঙুল, একস্থানে পায়ের নূপুর। এভাবে ৫১টি খণ্ড ৫১ স্থানে পতিত হয়ে মন্দির স্থাপন হয়ে যায়।

এসব পবিত্র শক্তিপীঠগুলো আদিকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শক্তিপীঠ মন্দিরগুলোর মধ্যে নেপালে রয়েছে ২টি, ভারত-নেপাল সীমান্তে ১টি, শ্রীলংকায় ১টি, পাকিস্তানে ২টি সহ বাংলাশেও পবিত্র শক্তিপীঠ রয়েছে মোট ৬টি।

বাংলাদেশে যেসব স্থানে পবিত্র শক্তিপীঠ মন্দির রয়েছে, সেসব শক্তিপীঠ মন্দিরগুলো হলো–
১। ভবানী মহাপীঠ, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ার চন্দ্রনাথ মন্দির। এখানে সতী দেবীর ডান হাত পতিত হয়েছিল।
২। জয়ন্তী মহাপীঠ, বাউরভাগ, কানাইঘাট, সিলেট। এখানে সতী দেবীর বাম জঙ্ঘা পতিত হয়েছিল।
৩। গ্রীনা মহাপীঠ, জৈনপুর, গোটাটিকর, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট। এখানে সতী দেবীর গলা পতিত হয়েছিল।
৪। অপর্ণা মহাপীঠ, ভবানীপুর, করতোয়া নদীর তীরে, শেরপুর। এখানে সতী দেবীর পায়ে থাকা নূপুর পতিত হয়েছিল।
৫। যশোরেশ্বরী মহাপীঠ, ঈশ্বরীপুর, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা। এখানে সতী দেবীর হাতের তালু ও পায়ের পাতা পতিত হয়েছিল।
৬। সুগন্ধা মহাপীঠ, শিকারপুর, গৌরনদী, সন্ধ্যা নদীর তীরে, বরিশাল। এখানে সতী দেবীর নাসিকা পতিত হয়েছিল।

বাদবাকি ৩৯টি শক্তিপীঠই রয়েছে ভারতে। তারমধ্যে কলকাতার কালীঘাটে পতিত হয়েছিল, সতী দেবীর মুখ খণ্ড ও আসাম রাজ্যের কামরূপ জেলার নীলাচল পাহাড়ের পাদদেশে কামাখ্যায় পতিত হয়েছিল সতী দেবীর যোনি খণ্ড। যোনি দিয়েই ফকির, সাধু, রাজা, বাদশাহ, পুরুষ আর মহাপুরুষ এই সুন্দর পৃথিবীতে আগমন। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুরা আসামের কামরূপ জেলার কামাখ্যা মহাশক্তিপীঠ স্থানে যোনি পূজা করে থাকে। দাক্ষায়ণী সতী দেবীর দেহের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে এই দুইটি মহাশক্তিপীঠ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, কামাখ্যা শক্তিপীঠই বেশি গুরুত্ব বহন করে। তাই এই স্থানকে সব তীর্থের মধ্যে সেরা তীর্থচূড়ামণিও বলা হয়ে থাকে।

কামাখ্যা মন্দির:
মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এই মন্দিরগুলিতে দশমহাবিদ্যা অর্থ্যাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা – এই দশ দেবীর মন্দিরও রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে।হিন্দুদের, বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব অম্বুবাচী মেলা। শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলাশহর থেকে এই মেলায় লক্ষলক্ষ লোকের সমাগম ঘটে। সেখানে মানুষ পুণ্যলাভের আশায় যায়। পূজা দেয়। মানসী করে। পাঁঠাবলি দেয়।

মূল কথা:
আসাম রাজ্যের কামরূপ জেলায় কামাখ্যা মন্দির হওয়াতে, তাই মানুষে কামরূপ আর কামাখ্যা এক সাথে মিলিয়ে বলে কামরূপ কামাখ্যা। আসলে দুটি শব্দই আলাদা আলাদা শব্দ। কামরূপ হলো আসাম রাজ্যের একটি জেলার নাম। আর কামাখ্যা হলো একটি বিখ্যাত মন্দির বা তীর্থস্থান। যা লোকে বলে থাকে একসাথে।

আমার বড়দিদির বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া। আমি বড়দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়ে। সেখানে গিয়ে কামাখ্যা মন্দিরের খুঁটিনাটি তথ্য সেখানকার লোকমুখে শুনেছি। কিন্তু সময় আর অর্থের কারণে সামনে থেকেও কামাখ্যা মন্দিরে যাওয়ার ভাগ্য হয়নি। কামাখ্যা মন্দির নিয়ে সেখানকার মানুষের মুখে শুনেছিলাম, সেখানে আছে কিছু ভণ্ড উলঙ্গ সাধু সন্যাসীদের আস্তানা। এরা গাঁজা নামের সিদ্ধি সহ নেশা জগতের সবধরনের মাদকসেবনকারী। সবসময় মাদক সেবন করে নেশায় ভুত হয়ে নানারকম তন্ত্রমন্ত্রের ধ্বনি দিতে থাকে। আর অন্ধবিশ্বাসী ভক্তগণ পুণ্যলাভের আশায় সেসব সাধু সন্যাসীদের চরণে লুটিয়ে পড়ে। যা আমাদের দেশে থাকা মাজার মন্দিরে এরকম দেখা যায়। কিন্তু কোন ধরনের কোন যাদুবিদ্যার সুবাতাস কারোর চোখে পড়েনি। তবুও মানুষের কাছে কামরূপের কামাখ্যা মন্দির মন্ত্রতন্ত্র ও সাধনার এক রহস্যময় স্থান হিসেবেই রয়ে গেছে। যা এখনো অনেক মানুষের কাছে যাদুর দেশ হিসেবে বিবেচিত।

______________________
তথ্য সংগ্রহ উইকিপিডিয়া থেকে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৯টি) | ৮ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩০-০৩-২০১৯ | ৯:৪২ |

    ভারতে তা জানতাম। কামরূপ কামাখ্যা নামটি শিশুকাল থেকে শুনে শুনে বড় হয়েছি। সড়কের সাধু থেকে ঔষধ বিক্রেতাদের মুখে জলফেনা ফুটে উঠতে দেখেছি।

    আপন মায়ের গর্ভজাত ভাই না খেয়ে থাকলেও, তাকে কিছুই দিবে না। অথচ একজন ভণ্ড ফকিরের কথা বিশ্বাস করে তাকে হাজার হাজার টাকা দান দক্ষিণা দিয়ে দেয়। এই হলো আমাদের অন্ধবিশ্বাসের কিছু নিয়মনীতি।

    আজ আপনার পোস্ট পড়ে অনেক তথ্য  জানা হলো। ধন্যবাদ মি. নিতাই বাবু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ৩০-০৩-২০১৯ | ২০:১৭ |

      গত কয়েকদিন আগে এক ভণ্ড ফকিরের সাথে কামরূপ কামাখ্যা নিয়ে বাকবিতণ্ডা। একপর্যায়ে জটাধারী ফকির সাহেব লেজ গুটিয়ে নিয়ে চলে যায়। তারপর পর থেকে কামরূপ কামাখ্যা নিয়ে বিস্তারিত লিখে শব্দনীড় ব্লগের সবার মাঝে শেয়ার করতে মন চেয়েছিল বলেই এই পোস্ট।

      ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন। 

      GD Star Rating
      loading...
    • মুরুব্বী : ৩১-০৩-২০১৯ | ২২:২৩ |

      শেয়ার না করলে এমন সব তথ্য অজানাই থেকে যেতো মি. নিতাই বাবু।

      GD Star Rating
      loading...
      • নিতাই বাবু : ০১-০৪-২০১৯ | ০:০১ |

        আপনার অনুপ্রেরণা আর ভালোবাসায় কৃতজ্ঞ। আরও কৃতজ্ঞ শব্দনীড় ব্লগ কর্তৃপক্ষের কাছে। কারণ, শব্দনীড় ব্লগ কর্তৃপক্ষ আমার এই নগণ্য লেখনীয়  পোস্টখানা বিশেষ নির্বাচিত করেছে, তাই। শব্দনীড় ব্লগের দীর্ঘায়ু কামনা করি।

        GD Star Rating
        loading...
  2. দীপঙ্কর বেরা : ৩০-০৩-২০১৯ | ১০:৫৯ |

    সত্যিই ভাবার সময় এসেছে। 

    অনেক কিছু জানলাম

    ভাল থাকবেন। 

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ৩০-০৩-২০১৯ | ২০:১৮ |

      এতো বড় লেখার পোস্টখানে পড়েছেন শুনে অত্যন্ত খুশি হয়েছি শ্রদ্ধেয় দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময় ।

      GD Star Rating
      loading...
  3. রিয়া রিয়া : ৩০-০৩-২০১৯ | ২১:১৮ |

    ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনাটি পড়লাম কবি দা। অনেক তথ্য এসেছে যেটা তেমন বিশেষ ভাবে জানতাম না। অনেক কিছুই পরিষ্কার হলো। আমাদের কুশিক্ষা যতদিন না যাবে, ধর্মের নামে ভণ্ডামী ততদিন থাকবে।  https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ৩১-০৩-২০১৯ | ১২:৩৭ |

      পড়েছেন শুনে খুশি হলাম শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি। আপনার জন্য শুভকামনা সবসময় ।

      GD Star Rating
      loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ৩০-০৩-২০১৯ | ২১:২৮ |

    একদল ভণ্ডের ব্যবসার পুঁজিই হচ্ছে কামরূপ কামাখ্যা'র শিক্ষা। সাধু সন্ন্যাসরা যেভাবে বিষয়টিকে হাইলাইট করে মানুষকে বোকা বানায়, জীবনে হয়তো এই জায়গা দর্শন দূরে থাক এর ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান শূন্য। ইন্টারেস্টিং। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Razz.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ৩১-০৩-২০১৯ | ১২:৪০ |

      সেখানে আমার যাওয়া খুবই ইচ্ছে ছিল দাদা। কিন্তু পারিনি সময় আর সুযোগের না হোয়ার কারণে। তবে বেঁচে থাকতে একদিন যাবো বলে আশায় আছি।

      GD Star Rating
      loading...
  5. সুমন আহমেদ : ৩০-০৩-২০১৯ | ২২:১৩ |

    লিখাটি দুটি পর্বে খণ্ডিত হয়েছে। প্রথম পাঠ আসলেই সত্য।

    কামরূপ কামাখ্যা থেকে নিজ দেশে ফিরে এসেই শুরু করে দেয় তেলেসমাতি ফৌকরালী চিকিৎসা। আর সহজসরল কিছু মানুষও মনের বিশ্বাসে রোগমুক্তির আশায় ওইসব কামরূপ কামাখ্যাবেশী ফকির, সাধু, ভণ্ড ওঝাদের শরণাপন্ন হতে থাকে।

    দ্বিতীয় পাঠে বিধৌত ইতিহাস জানার জন্য ভালো হয়েছে।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ৩১-০৩-২০১৯ | ১২:৪২ |

      তবুও পড়েছেন শুনে আনন্দিত হলাম শ্রদ্ধেয় দাদা। তাই অসংখ্য ধন্যবাদ । সাথে শুভকামনা সারাক্ষণ। 

      GD Star Rating
      loading...
  6. শাকিলা তুবা : ৩০-০৩-২০১৯ | ২২:১৩ |

    ইতিহাস অংশ খানি পড়ে ভালো লাগলো।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ৩১-০৩-২০১৯ | ১২:৪৪ |

      সুন্দর গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, শ্রদ্ধেয় শাকিলা দিদি। সাথে শুভকামনা রইল।

      GD Star Rating
      loading...
  7. নিজু মন্ডল : ৩১-০৩-২০১৯ | ১২:৫৯ |

    সুন্দর পোস্ট। অনেক কিছু জানা হল।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ৩১-০৩-২০১৯ | ১৮:২১ |

      শুনে খুবই খুশি হলাম দাদা। সুন্দর  মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদের সাথে শুভকামনা সারাক্ষণ ।

      GD Star Rating
      loading...
  8. নাজমুন : ৩১-০৩-২০১৯ | ২১:০৩ |

    কামরূপ কামাখ্যার কথা শুনেছিলাম । কিন্তু এ নিয়ে যে এতো কিছু হচ্ছে তা তো জানতাম না । 

    এই সব ভন্ড ফকির , ওঝা , সাধু সন্যাসীর কাছে মানুষ যাবেই যতদিন না মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি  না আসে এবং যথাযথ  শিক্ষার আলোয় মানুষ আলোকিত না হয়। 

    মানুষের মন দুর্বল হলেই সমস্ত যুক্তি তার কাছে অসহায় । অতএব ভন্ডরা  রমরমা ব্যবসা করে যাবেই । মানুষ সচেতন হওয়া জরুরী এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও জরুরী । 

    আপনার পোস্ট পড়ে সমৃদ্ধ হলাম 

    ভালো থাকবেন। 

     

     

     

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০১-০৪-২০১৯ | ০:০৩ |

      সুন্দর মননশীল মূল্যবান মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। 

      GD Star Rating
      loading...