আমরা কি ভুলে গেছি ভারতের অবদানের কথা?
ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হয়ে মার্চ মাসের শুভ যাত্রা শুরু হয়ে গেল। মার্চের শুরুতেই মনে পড়ে যায় সেই ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের কথা। আমি তখন ৭থেকে ৮বছর বয়সের এক নাবালক শিশু। এখনো স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের সেসব কথা আমার বেশ মনে আছে। মনে আছে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সাথে ভারতের অবদানের কথাও।
১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ডাকে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পাক হানাদার বাহিনীদের ওপর। সেসময় নিরস্ত্র মুক্তিকামী জনতাকে সর্বদিক দিয়ে সহযোগিতা করেছিলে, তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। দিয়েছেন সৈন্য, দিয়েছেন গোলাবারুদ। লক্ষলক্ষ বাঙালি শরণার্থীদের নয় থেকে দশ মাস অতিথির মর্যাদায় খাওয়াইয়ে ছিলেন।
সেসময় বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধবিদ্যার ট্রেনিং সহ অস্ত্রসস্ত্র সাথে দিয়ে বাংলায় পাঠিয়েছেন, হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াই করতে। সাথে দিলেন তাঁর দেশের সেনাবাহিনী।
নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে কত যে ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল, তা আমার জানা না থাকলেও, সরকারের কাছে তার একটা হিসাব ঠিকই আছে বলে মনে হয়! সাথে প্রাণ হারিয়েছেন, আমাদের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সহ ত্রিশ লক্ষ মানুষ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন, অগণিত আমার মা ও বোনেরা।
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে আর অসংখ্য মা বোনের সম্ভ্রমের পাশাপাশি ভারতীয় সৈন্যদের অবদানের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মহান স্বাধীনতা। পেয়েছি বাংলাদেশ নামে এক নতুন দেশ। স্থান পেয়েছি বিশ্ব মানচিত্রে। আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন বাঙালি জাতি।
স্বাধীনতা পরিবর্তী সময় থেকে আস্তে আস্তে আজ আমরা মধ্য আয়ের দেশে পদার্পণ করতে সক্ষম হয়েছি। কিছুদিন পর হয়ত আমরা উন্নত দেশের তালিকায়ও থাকবো বলে আশা করি।
১৯৭১ সালের দিকে ফিরে তাকালে প্রথমে ভাবতে হয়, এতো অল্প সময়ের মধ্যে আমরা কী করে স্বাধীনতা অর্জন করলাম? তখন তো আমাদের সৈন্য ছিল না, অস্ত্র ছিল না, যুদ্ধ করার মতো ট্রেনিংও ছিল না। ছিল না যুদ্ধবিমান। ছিল না গোলাবারুদ কামান। আমাদের তখন ছিলাম না খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।
তখন তো আমরা ছিলাম, পাকিস্তানিদের গোলামের মতন। তাহলে আমরা কী করে, কার সাহসে ক্ষমতায় থাকা একটা দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরলাম? আবার যুদ্ধে জয়ীও হয়ে গেলাম? আমরা কি একবার ভেবে দেখেছি, তখন সাহসদাতা, আর অস্ত্রসস্ত্রের যোগানদাতা কে ছিল? ছিলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত।
তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে যদি ভারত এগিয়ে না আসতো, তাহলে কি আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে লাঠিসোঁটা নিয়ে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারতাম? মোটেই না।
তার মানে নয় মাসে নয়, নয় বছরেও পাকবাহিনীদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ের সম্ভাবনা আমাদের ছিল না। আমরা কিছুদিন লাঠিসোঁটা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ দিতে পারতাম ঠিক, শেষমেশ নিজেদের লেজ নিজেরাই গুটিয়ে দুই হাত তুলে তাঁদের কাছে ধরা দিতাম। তাঁরা মুক্তিকামী যোদ্ধাদের কিছু বন্দি করে, কিছু মেরে, তাঁরাই আবার দেশ শাসন করতেন। আমরা আর পেতাম না স্বাধীনতা। আমরা পেতাম সেই আগের মতন পরাধীনতা। আমাদের পায়ে বাঁধা থাকতো পরাধীনতার শিকল।
ভারতের বিশেষ অবদানে আজ আমরা স্বাধীন বাঙালি। দাবি করি বাংলাদেশি। আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়ে পাখির মতন ডানা মেলে দেশবিদেশ ঘুরছি, চাকরি করছি, প্রবাসে থাকছি, দেশে টাকা পাঠাচ্ছি। দেশ উন্নত হচ্ছে। সাথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, সাথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।
কিন্তু ভারতের কথা আমরা বেশিরভাগ বাঙালিরা মুখে তো আনি-ই-না, বরং ভারতের কোনও সুসংবাদও শুনতে চাই না। এখন ভারত হলো বেশিরভাগ বাঙালিদের কাছে এক শত্রুর মতন। আর পাকিস্তান হলো সজাতি দেশ। অর্থাৎ: ভারত হলো, হিন্দু বিধর্মীদের দেশ, আর পাকিস্তান হলো, আমাদের দ্বীনের নবীর উম্মতের দেশ।
কিছুকিছু বাঙালিদের এরকম মনভার দেখা যায় তখন, যখন ভারত বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হয়; কিংবা জম্মু কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তান উত্তেজিত হয়। আর সীমান্ত নিয়ে যুদ্ধযুদ্ধভাব দেখা দিলে।
তখন কিছুকিছু পাকিস্তান প্রেমী ভাইয়েরা সেই ১৯৭১ সালে ভারতের অবদানের কথা ভুলে গিয়ে, পাকিস্তানের জয়গান গাইতে থাকে। আর সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে স্ট্যাটাস দিতে থাকে পাকিস্তানের জয় হোক, ভারতের ক্ষয় হোক। পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ভারত ধান্ধাবাজ, নিপাত যাক।
বর্তমানে কাশ্মীর সীমান্তে বাজছে যুদ্ধের দামামা। থেমে থেমে উভয়পক্ষে গোলা ছুড়ছে পাল্টাপাল্টি। ভূপাতিত করছে একে অপরের যুদ্ধবিমান। চলছে উভয়পক্ষের হুমকি ধমকি। এরমধ্যে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে জয়গান গাওয়া শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তান প্রেমীদের। তাঁরা তাঁদের হিংসাত্মক এমনভাব প্রকাশ করছে নিজ নিজ টাইমলাইনে। এটা একরকম যুদ্ধ বেধে দেওয়ার উস্কানির সামিল। এটা কি ঠিক? ঠিক হতে পারে, না-ও হতে পারে। কারণ, এদেশের সবাই তো আর এই দেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ কোনোদিন সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। যুদ্ধ শুধু সহিংসতাই বাড়িয়ে দেয়। শত সমস্যার সমাধান হয় আলোচনার মাধ্যমে। এটা আমাদের সবাইকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
একসময় আমাদের দেশের অনেকেই স্বাধীনতার বিপক্ষে থেকে, পাক হানাদার বাহিনীদের নানাভাবে উৎসাহিত সহ নানাবিধ সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। যার কারণে সেসময়ে দেশ স্বাধীন হতে দীর্ঘ নয় মাস সময় লেগেছিল।যদি এদেশের সবাই স্বাধীনতার স্বপক্ষেই থাকতো, তাহলে দেশ স্বাধীন হতে আরও কম সময় লাগতো বলে মনে করি।
তবুও ওইসব স্বাধীনতা বিরোধী বিবেকহীন মানুষের সাহায্য পেয়েও পাক হানাদার বাহিনীরা আমাদের মুক্তিসেনাদের পরাজিত করতে পারেনি। ভারতের সহযোগিতায় খুব কম সময়ের মধ্যেই আমাদের মুক্তিবাহিনীরা হানাদার বাহিনীদের পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঐসব পাকিস্তান প্রিয় মানুষগুলো আবার বলতে শুরু করল, “ভারত দেশ স্বাধীন করে এই দেশের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে”। এটা ছিল ঐসব পাকিস্তান প্রিয় মানুষদের ধারনা।
এতে বুঝা যায়, উপকারীর গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলানোর সামিল। উপকারী উপকার করলো নিজের জানমাল দিয়ে, এখন উপকার পাওয়া মানুষগুলো দিচ্ছে উপকারীকে মিথ্যে অপবাদ। আসলে তা কি সত্যি? মনে হয় মোটেই না। কেননা, এখন তো আমাদের ঘরে কিছুই ছিল না। ছিল শুধু বাপদাদার ভিটেমাটিটুকু। এ ছাড়া তো আমাদের আর কিছুই ছিল না! ছিল না, বন্দুক। ছিল না টাকার সিন্দুক। ছিল না অস্ত্রসস্ত্র। ছিল না, গোলাবারুদ। ছিল না কোনও যুদ্ধবিদ্যা শেখা।
তাহলে ভারত দেশ স্বাধীন করে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের দেশ থেকে কী ছিনিয়ে নিতে পারে? তখন আমাদের দেশে কি হিরার খনি ছিল? স্বর্ণের খনি ছিল? তেলের খনি ছিল? ছিল না! তাহলে ভারত যাবার সময় সাথে করে নিল টা কী? নিয়েছে, তাঁরা আসার সময় সাথে করে যাকিছু এনেছে; তা-ই নিয়েছে। এ ছাড়া আর কিছুই নেয়নি। বরং আরও কিছু ফেলে রেখে তাঁরা এদেশ ত্যাগ করে তাঁদের নিজের দেশে চলে গিয়েছে। আমরা বেশিভাগ বাঙালিরা মনে মনে মনকলা খেয়ে এরকম চিন্তাভাবনা করে নিজেদের আরামের ঘুম হারাম করে থাকি, দিনের পির দিন, আর রাতের পর রাত। তাই শোনা কথায় চিলের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকি।
আসলে আমরা আগের সবকিছু ভুলে গেছি। আমরা ভুলে গেছি সেসব কথা আর ইতিহাস। ভুলে গেছি আমাদের স্বাধীনতার সাথে ভারতের বিশেষ অবদানের কথা। সেসময়ে ভারতের অবদানের কথা স্বীকার করতেও আমাদের কেমন যেন লজ্জাবোধ হয়। আমরা আসলে এক আশ্চর্য বাঙালি জাতি। আমরা শুধু পেতেই চাই, কাউকে কারোর ন্যায্য সম্মানটুকুও দিতে জানি না।
যাই হোক, পরিশেষে এইটুকু বলতে চাই; আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই! আমরা উস্কানি দিতে চাই না, আমরা মীমাংসা চাই। জয় হোক মানবতার।
loading...
loading...
আমরা আগের সবকিছু ভুলে গেছি। আমরা ভুলে গেছি সেসব কথা আর ইতিহাস। ভুলে গেছি আমাদের স্বাধীনতার সাথে ভারতের বিশেষ অবদানের কথা।
আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই! আমরা উস্কানি দিতে চাই না, আমরা মীমাংসা চাই। জয় হোক মানবতার। সহমত।
loading...
বর্তমানে ভারত পাকিস্তান নিয়ে অনেকেই অনেক ধরণের মতামত পেশ করছে, অনলাইলবিত্তিক সাইটগুলোতে। কেউ আবার পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে লিখছে। ফেসবুকে কিছু বন্ধুদের টাইমলাইনে কিছু পোস্ট দেখেই আমি এই লেখাটি লিখলাম। আমি মনে করি যুদ্ধ কখনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। সমাধান হয় আলোচনার মাধ্যমে। আপনার সুন্দর মতামতের জন্য ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় কবি দাদা।
loading...
যুদ্ধ কখনো সমস্যার সমাধান নয়। সমাধান আলোচনায়।
loading...
আমরা বেশিভাগ বাঙালিরা মনে মনে মনকলা খেয়ে এরকম চিন্তাভাবনা করে নিজেদের আরামের ঘুম হারাম করে থাকি, দিনের পির দিন, আর রাতের পর রাত। তাই শোনা কথায় চিলের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকি।
ভারত বাংলাদেশের শত্রু নয়। আমরা তো নইই।
লেখাটি কিছু সময়ের জন্য বিশেষ নির্বাচন করে সম্মানিত করতে শব্দনীড় সঞ্চালক মহোদয়ের কাছে আকুল প্রার্থনা করছি। আমার বিশ্বাস পাঠক ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটানোর উদার মানসিকতা শব্দনীড়ের রয়েছে। শব্দনীড় আমাদের ভালোবাসার অঙ্গন।
loading...
অনেক অনেক ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র দাদা। আপনার সুন্দর মতামতের জন্য কৃতজ্ঞ। আশা করি ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় দাদা।
loading...
ভারত বিদ্বেষ অনেকের থাকতে পারে। এটা যেমন বাংলাদেশে আছে; আছে ভারতেও। আমি মনে করি বিপদে বন্ধুর আসল পরিচয়। ভুলে যাওয়া যাবে না।
loading...
আমরা কিছু বেঈমান একেবারে ভুলেই গিয়েছি সেসব কথা। তাই সময়সময় খুব কষ্ট হয় দিদি।
আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ সহ শুভকামনা ।
loading...
যাইহোক ,পরিশেষে এইটুকু বলতে চাই; আমরা যুদ্ধ চাই না ,শান্তি চাই ! আমরা উস্কানি দিতে চাই না, আমরা মিমাংসা চাই।জয় হোক মানবতার। সহমত পোষণ করছি দাদা।
loading...