কুজ্ঝটিকা (শেষ পর্ব)

৭.
আমি আগে থেকেই অনুমান করে নিয়েছি নাবিল যে কোন সময় একটা মরন-কামড় দিতে পারে। সে অনুমান মিথ্যে হয়নি। এলাকার কিছু বখাটে ছেলে ঠিক করেছে আমাকে শায়েস্তা করার জন্যে। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন, ওরা আমার বেশ পরিচিত ছিল বিধায় যে ধারার ঝড় প্রবাহিত হতে পারত তা হয়নি। অল্পতে আকাশের মেঘ কেটে যায়। নাবিলের বাবা তাকে আবার বিদেশ ফিরে যেতে বাধ্য করে। পথের কাটা আর রইলনা বলে বেশ আমোদিত হলাম।

বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো সময়। আমাদের অনেক নতুন নতুন বন্ধু জুটল। আড্ডা এবং পড়া-লেখা সমানতালে চলতে লাগল। সিনিগ্ধা যে এই যাত্রায় পুরোপরি আমার সহযাত্রী একথা বলা চলেনা। আড্ডার নিত্য সঙ্গী হলেও লাইব্রেরিতে আমি একাই পড়তে যেতাম। এক্ষেত্রে আড্ডায় বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলোনা। ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসে আমরা অবিচ্ছেদ্য জুটি হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করলাম। প্রতিনিয়ত অবসরে নতুন নতুন পরিকল্পনা বুনে চলেছি নিরন্তর। নিজের মাঝে বাড়তি দায়িত্ববোধে সবার আড়ালে পড়ালেখার মাত্রাটাও বাড়িয়ে দিলাম। ভালো রেজাল্ট করতেই হবে।

পরীক্ষা হল, রেজাল্ট হল। ক্লাস বিমুখ আদিত্যের রেজাল্ট সবাইকে হতচকিত করে তুলল। সবার প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেলাম। সিনিগ্ধা কেমন খুশি হল তা মাঝে মধ্যে বোঝা দায়। আমার ক্লাসে উপস্থিতি যাই হোক কিন্তু জীবনে একদিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিলাম কিনা মনে পড়েনা।
প্রান্তিকের বাসায় আমার সাথে আমার আরেক বন্ধু থাকতো নকীব। অলস প্রকৃতির বলে কখনো দশটার আগে তার ক্যাম্পাসে যাওয়া হতোনা। সে আমার রাজনৈতিক সহযোদ্ধাও ছিল বটে। সে ছিল ল’ ফ্যাকাল্টির ছাত্র। সে সময় ল’ ফ্যাকাল্টি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দু নম্বর গেইটের পাশে। সে সুবাধে সিনিগ্ধার সাথে নকীবের মাঝে মধ্যে দেখা হয়ে যেত। আমিই তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।

অবশ্য তাদের পরিচয়টা আমার বাসায় হয়েছিলো। একদিন বিকেল বেলায় সিনিগ্ধা আমায় হঠাৎ তার ছোট বোন সিন্থি মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, তাকে কয়েকদিনের জন্য পড়া তৈরিতে সহযোগিতা করতে হবে। তার যেহেতু বড় ভাই নেই সিন্থির দাবী আমাকেই সহযোগিতা করতে হবে। সে সুবাধে বেশ কয়েকবার ঘনঘন তাদের বাসায় যেতে হয়েছে। ভালোই কেটে যাচ্ছিলো আমাদের দিনগুলো।

সিনিগ্ধার আচরণটা কেন জানি আজ আমার কাছে অন্যরকম ঠেকল। আচ্ছা আদিত্য, তুই বাংলায় ভর্তি হয়েছিস? কী করবি এই সাবজেক্টে পড়ে। বড়জোর একটা কলেজের শিক্ষকতা!
– হ্যাঁ, আমি একটা কলেজের শিক্ষকই হতে চাই।
– তারপর!
– তারপর, আবার কী।
– তবে তো ভালোই!
আমি কথা আর বাড়াতে চাইনি বলে আর বেশি দূর এগোয়নি। প্রতিদিনের মত আজও আমরা অনেকক্ষণ একসাথে কাটিয়েছি কিন্তু অধিকাংশ সময় সিনিগ্ধাকে বেশ বিষণ্ণ মনে হয়েছে। বিষয়টি যে আমার চোখে পড়েনি তা কিন্তু ঠিক নয়। তবে মন খারাপের বিষয়টি ঠিকভাবে ধরতে পারিনি।
কিছুদিন পর আমাদের বন্ধু শিমুল আমার অন্ধ চোখের পদ্মা খুলে দিল।

আদিত্য তোকে একটা কথা না বলে পারছিনে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। একদিন নকীব তার একটা ডায়েরি আমাকে পড়তে দিল। তার কয়েকটা শব্দ আমার কাছে আজও অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমি আজও বিশ্বাস করতে পারছিনা। তোর সিনিগ্ধার সাথে কথা বলা দরকার।
– কেমন কথা! তার সাথে তো প্রতিদিনই কথা হয়।
– তা তো আমারা কেন, ক্যাম্পাসের সবাই দেখে।
– তবে, আর নতুন করে কী বলব?
– আচ্ছা, সরাসরিই বলি, নকীবের সাথে তার সম্পর্ক ক্যামন?
– নকীব, আমার বন্ধু হিসেবে যেমন থাকা দরকার তেমনই।
– আমার কাছে তেমনটি মনে হয়না।
– তবে, ঠিক আছে কালকেই আমি সিনিগ্ধা থেকে জেনে নেবো।
কিন্তু শিমুলের কথার এক পার্সেন্টও আমার আমার কাছে সত্য মনে হয়নি। সেটি যে ভাবনার বিষয় হতে পারে তাও একবারের জন্য মনে আসেনি।
পরেরদিন সকালে আমরা দুইজন বসে গল্প করছিলাম এমন সময় মনের অজান্তে সিনিগ্ধাকে বললাম, আচ্ছা নকীবকে তোমার কেমন মনে হয়।
– কেন? হঠাৎ নকীবের প্রসঙ্গ কেন?
– না, এমনি বললাম। কিন্তু আজ খেয়াল করলাম, নকীব প্রসঙ্গটিতে তার চেহারায় যে পরিবর্তন তা আর কখনো চোখে পড়েনি। তার চোখে মুখে একটা কেন জানি একটা অপরাধবোধের চাপ ফুটে উঠলো। তখন তাকে একটা প্রশ্ন না করে থাকতে পারলাম না। আচ্ছা, তোমার সাথে কি নকীবের মাঝে মধ্যে দেখা হয়?
– আদিত্য, আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বাধ্য নই।
– মানে?
– মানে, আর কী? জেনো আমি তোমার বন্ধু ছিলাম, এখনো আছি। এর বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করতে যেওনা। আর সকল বিষয়ে মাথা ঘামানোর অধিকার আমি কখনো দেই নি। এই কথা যেন আর কখনো স্মরণ করিয়ে দিতে না হয়। তোমার এতই যেন জানার ইচ্ছা, তবে জেনে রেখো নকীব সম্পর্কে যদি কোন কিছু জেনেও থাক, তা অসত্য নয়।
কথাগুলো বলে সে আর এক সেকেন্ড দাঁড়াবার প্রয়োজনবোধ না করেই বাসার দিকে ছুটে চলল। আমি লক্ষ্য করলাম আমার পায়ের কাছ থেকে যেন একে একে সব মাটিগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। উঠে দাঁড়াবার সবশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বেঁচে থাকার স্বপ্ন ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে আসছে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়ের সেই করুণ চাহনি, ছোটকাল থেকে মায়ের আঁচলে বড় হওয়া সেই সব স্মৃতিগুলো। মা, যেন ডাকছে আমায়। আয়, খোকা ফিরে আয়। সেইদিনের সে ডাক আর উপেক্ষা করতে পারিনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফিরে এলাম মায়ের কোলে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২০-১১-২০১৮ | ১১:১১ |

    দিলেন টেনশন বাড়িয়ে। সহসা নকীব কোথা থেকে আবার জুড়ে বসলো !! https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Shock.gif.gif
    যাই হোক সার্থক একটি ধারাবাহিক পড়া হয়ে গেলো। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ কবি।

    GD Star Rating
    loading...
    • মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ২০-১১-২০১৮ | ২১:৩৭ |

      * প্রিয় প্রেরণাদাতা মুরুব্বী, গল্প লেখায় আমি বেশ অনভিজ্ঞ। গল্পের কাহিনীর অক্ষুন্নতা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছি। আমি আদিত্যের জীবন খুব কাছে থেকে দেখেছি। হয়তো নকীবের আগমন আরও নাটকীয় করা যেত কিন্তু কাহিনী এমনই ছিল।

      পাশে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. নিতাই বাবু : ২০-১১-২০১৮ | ১৩:২৬ |

    ভালো লাগলো শ্রদ্ধেয় দাদা। তবে সময় সুযোগমত আপনার লেখা পোস্টগুলো পড়ে নিবো। যেগুলো আগে পড়া হয়নি। এমন আরও চাই! 

    GD Star Rating
    loading...
  3. রিয়া রিয়া : ২০-১১-২০১৮ | ১৯:৫৭ |

    না কবি দা। আপনাকে সমর্থন করতে পারলাম না। প্রত্যাশা আরও ছিলো। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ২০-১১-২০১৮ | ২১:৪১ |

      * বাস্তব জীবনে নকীবের আগমন এমনই ছিল, যা আদিত্য বিন্দুমাত্র অনুমানও করতে পারেনি।  

      প্রিয় কবি দি, ভালো থাকুন নিরন্তর। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ২০-১১-২০১৮ | ২১:০২ |

    গল্পের পরিসমাপ্তি মন্দ নয়। ভালো হয়েছে কবি হুসাইন ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif 

    GD Star Rating
    loading...