কতদিন তাকাইনি তোর চোখে চোখ রেখে। আঁচল পেতে দিসনি বসতে ভালোবেসে। তোর কীবা দেবো দোষ! আমারই তো আসা হয়নি তোর ছায়ার পাশে। তোর বুকে শান্ত স্নিগ্ধ নদীর জল বয়ে চলে নিরবধি। শ্যামল আবেশে সন্তানদের ঘুমিয়ে রাখিস পরম ভালোবেসে। ভোর হতেই পাখিদের গান শুনিয়ে জাগিয়ে দিস পরম মমতায়। কথা বলছি তোর এক অবাধ্য ছেলে। যার অনেক লোভ ছিলো আকাশ ছোঁয়ার। তাই তোর মায়ার বন্ধন ছিঁড়ে হই দেশান্তরি। হিমালয়ের ওপারে, সাগর নদী পেরিয়ে পৃথিবীর ঠিক মধ্যবিন্দুতে পৌঁছে যাই আরো সুখের আশায়। চাই আরো সুখ, চাই আরো চাই…চাই… এ চাওয়ার কি শেষ আছে! পেয়েছি যা কিছু হারিয়েছি তার চেয়ে বেশি কিছু। এখন আর গল্প হয়না, ভালোবাসা হয়না, কথা হয় প্রতিনিয়ত যন্ত্রদানবের সাথে।
মনে পড়ে নিশুতি রাতে কথা হতো তোর সাথে। সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে গান শোনাতি নীরবে নিঃশব্দে। সে গান শুনতে কতদিন ঘুমাইনি। ক্লান্ত হইনি কোনদিন। তোর বুকে আমার স্বাধীনতা ছিলো। যা খুশি তাই করেছি। কারো কিচ্ছু বলার সাহস ছিলো না। যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছি। তোর ছায়া ছিলো নিরবধি।
ইংরেজ শাসন দেখিনি, দেখিনি পাক হায়নার কালোথাবা। হয়তো তাই বুঝতে পারিনি তোর গভীর ভালোবাসা। এজন্য পাঠিয়েছিস তোর অবোধ সন্তানকে আজ দেশান্তরে। এখন আর ঘুম ভাঙ্গেনা পাখির গানে। হিমেল বাতাসে মন জুড়ায়না কোমল আবেশে। বাতাসের শব্দ শুনে ঘর-দোর বন্ধ করে দেই ধুলি ঝড়ের কিংবা উনুনের তাপের শঙ্কায়। হয়তো ভাবছিস তোর সন্তান কোন কারখানার শ্রমিক হয়েছে নাকি। না মা, তা নয়। এখানকার পরিবেশই এমন। তোর শ্যামল রূপের মত রূপ এখানে নেই। আছে শুধু ধুঁধুঁ মরুভূমি। তোর ভালোবাসার মত ভালোবাসা পায়না বলে তার সন্তানগুলোও তেমন।
যা তা বলে যাচ্ছি, আর তুই বসে বসে হাসছিস তাই না! বুঝি, বুঝি সবই বুঝি। আসলে এটি আমার প্রাপ্য ছিল। বুঝার দরকার ছিল পরাধীনতা কাকে বলে?
প্রতিপদে পদে এখানে আমরা পরাধীন। ওদের দেয়া ছোট্ট একটা পরিচয় পত্র অনেক মূল্যবান। আমার চেয়েও ওটার মূল্য অনেক অনেক বেশি। সাথে না রাখছি তো কেল্লাফতে। যেখানে খুশি সেখানে যখন তখন তোর বুকে চষে বেড়ানোর মত সেতো কল্পনার অতীত। এখন আর দুঃখও হয়না। সব সয়ে গেছে।
তোর যে সন্তান আমার মতো পরাধীনতার অর্থ বুঝে না পাঠিয়ে দিস সযতনে, শিখিয়ে দেবো হাতে কলমে। যে বর্ণ বৈষম্য, জাতিভেদ বুঝে না তাও শিখে নিতে পারবে বিনে পরিশ্রমে। যে নিয়ম মানতে শেখেনি, নিয়মের প্রতি বিনয়ী করে নেবো সহসা।
তোর ননির পুতুলগুলো পছন্দসই খাবার না পেয়ে মায়ের দেয়া খাবারের থালা ছুঁড়ে দিয়েছিলো আকাশে সে আজ এক টুকরো পাউরুটি মুখে গুজে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে পরম আনন্দে। এক থলে বাজার নিয়ে হেঁটে আসতে যার আত্মসম্মানে বাজতো সে আজ অন্যের ভারী বস্তা কাঁধে নিয়ে হরহামেশা পাড়ি দেয় কয়েক মাইল। তপ্ত রোদে ঠাঁই দাঁড়িয়ে অন্যের রাস্তা তৈরি করে দিতে তার মোটেও কষ্ট হয়না। দ্বিতল বহুতল প্রাসাদ গড়ে তোলে অন্যের জন্য। মহাকালের যাত্রীও হয় অকালে।
তোমার অবোধ সন্তানটি এখনো রাত জাগে তোমার অপেক্ষায়। এখনো পথে চলি নিরবধি। দেখা হয় তোমার দেশান্তরি আরো কিছু সন্তানের সাথে। কেউ খোলা আকাশে তপ্ত মরুর বুকে, কেউ দেখি একটু সূর্যের আড়াল নিতে সেই সরু গলিতে দেয়ালে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নিতে।
এরা হয়তো এসেছে মানবিক দীক্ষা নিতে, এরা মানুষ হয়েছে। ক্লান্তি আছে কিন্তু চিহ্ন মুছে দিতে চায় চোখে মুখে। তাইতো মুখ তুলে নিত্যকার সেরা মিথ্যাটি আজো বলে- এইতো আছি, বেশ ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ।
loading...
loading...
লেখাটি কী যে দরদ আর ভালবাসা মিশিয়ে লেখা পড়তে গিয়ে মনটা হুহু করে উঠলো।
loading...
মনটা আর্দ্র হয়ে এলো স্যার। প্রবাসের এই জীবন আমার ভীষণ কাছে থেকে দেখা।
loading...