সব যাত্রা পূর্বনির্ধারিত নয়
রাত নেমে এলে গাছেরাও হিংস্র হয়ে উঠে। পাতাগুলো ছড়াতে থাকে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড।
আমার যে কী হয়! রাত নামলেই ইচ্ছে করে কোন ঝোপালো গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে সারারাত পাতার বাঁশি বাজাই। যেমন বাজাতাম শৈশবের অলস উদাস দুপুর গুলোতে। বাজাই আর পান করি সোনালি জ্যোৎস্নার অমিয়দ্রাক্ষারস।
আমার কোন আপত্তি নেই রাতভর পাতার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ফুসফুস ভরে নিতে। সারাদিন কত মানুষের ছড়িয়ে দেওয়া বিষ ঢুকে যায় শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর শরীর সেই বিষগুলো নিতে নিতে হয়ে গেছে নীলকণ্ঠ পাখি। কণ্ঠনালীতে জমে আছে কালকুটের ভরা থলে।
হয়না। রাতগুলো থাকে লৌহদরোজার নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বন্ধী। দূরে থাকে গাছ। পাতার বাঁশি।
পাহাড়সমান অনতিক্রম্য বাধা অতি ক্ষুদ্র এক ইচ্ছেপূরণের পথেও!
পুনর্জন্মবিশ্বাসী হলে আমি চাইতাম খোঁপায় বুনোফুল গোঁজা এক পাহাড়ী আদিবাসি রমনীর জীবন। হ্যাঁ জন্মে জন্মে আমি এক নারীই থাকতে চাই। কিন্তু সেই নারী এই নিগড়বন্ধী সমাজের কেউনা। জীবন হবে মুক্তবিহঙ্গের মতো, প্রজাপতির মতো স্বচ্ছন্দবিহারের। যে নারীরা অবগুণ্ঠনের আড়ালে লুকোয়না তাদের নারীত্ব——–বিব্রত নয় লোভীচোখের নগ্ন-চাহনীতে। উৎসবের রাতে মহুয়ার নেশায় ঘোরমাতাল হয়। নাচে তার পুরুষের হাতে হাতে ধরে, পায়ের তালে তালে তাল মিলিয়ে। ঝোরার জলে পা ডুবিয়ে বঁড়শিতে মাছ ধরে। চুলে মহুয়ার ফুল গুঁজে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ীঝর্ণার মতো বন্ধনহীন।
জীবনতো হবেই এমন সহজ আর অনাবিল।
নিরিবিলি রাতে পাতার বাঁশি বাজানোর সুযোগহীন জীবন আমার চাইনা।
এমন নয় যে এই বাঁশির সুরে তৈরি হয় কোন মোহনীয় আবেশ, বরং খানিকটা বিকট অথবা উদ্ভট মনে হয় কখনো কখনো। কিন্তু বাজাতে পারলে প্রাণের অফুরান স্পন্দনের শব্দ বেজে উঠে ঠিকই।
এই ইচ্ছেপূরণের ব্যর্থতাকে আমূল গ্রাস করে ফেলে সীমাহীন বিষাদের নীলঢেউ। আর সারারাত সেই উথালপাথাল ঢেউয়ের নাগরদোলায় দুলতে থাকে পৃথিবী।
ঘুম আসেনা। ঘুমপাড়ানি মাসীপিসী কেবলই পালিয়ে বেড়ায়। ছড়াগানের ছন্দে ছন্দে ঘুমে ঢুলু ঢুলু সেই চোখ দু’টোই যে ফেলে এসেছি সহস্র আলোকবর্ষ দূরের শৈশবে —- কেন যে বারবার ভুলে যাই! সেই মায়াভরা শিশুকাল আর ফিরবেনা। তবু হাতছানি দেবে। পিছু ডাকবে। আরো অনিদ্রায় অনিদ্রায় ভরে দেবে ব্যাকুল রাতগুলো।
খুব চড়ামূল্যে কিনে নিতে হয় নিজস্ব নির্জনতাটুকু। আর এই মহামূল্য নির্জনতার ভেতরেই ঢুকে পড়ে পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল। নিজের সাথে কথা বলতে গেলেই শুরু হয়ে যায় চাওয়াপাওয়া যোগবিয়োগের অংক। জীবনতো কখনো শুরু হয়না কোন অংকের সূত্রে। তবে কেন এত হিসেবের মারপ্যাঁচ উঠে আসে ! কেন যে খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও মনটাকে স্মৃতিশূন্য কিংবা একেবারে অনুভুতিশূন্য করে ফেলা যায়না ! কেন যে!
বেঁচে থাকার কোন মানেই হয়না জীবনে কিছু পাগলামি না থাকলে। এই এখন যেমন একশ তিন ডিগ্রী জ্বর নিয়ে কুয়াশাভেজা ব্যালকনিতে বসে হি হি করে কাঁপছি। মনে হচ্ছে এর চাইতে আনন্দদায়ক আর কিছু ঘটেনি এই জীবনে। এমনকি এখন যদি আকাশভাঙ্গা জ্যোৎস্না নেমে এসে প্লাবিত করে দিতে চায়, তাকে বলবো– ‘এখন নয়। এখন এই জ্বরতপ্ত অন্ধকার নির্জনতাই আমার প্রিয়। আলো চাইনা’।
যাপিতজীবন আর স্বপ্নের মাঝখানে এক রেললাইন ফাঁক। আজীবন পাশাপাশি তবু কেউ কাউকে ছোঁয়না ; কেবলই সমান্তরে ছুটে চলা আকাশ আর সমুদ্রের মতো।
দৃশ্যতঃ আমার কোথাও যাবার ছিলনা।
তবু চোরাটানে আবার এসে দাঁড়াই ইস্টিশনে। টিকেট কাউন্টারের জানালায় হাত বাড়িয়ে এক অচেনা গন্তব্যের টিকিট কিনে ফেলি।
সব যাত্রাইতো আর পূর্বনির্ধারিত নয়।
loading...
loading...
চমৎকার লেখা। অনেক অনেক অভিনন্দন ও শুভকামনা
loading...
দৃশ্যতঃ আমার কোথাও যাবার ছিলনা।
তবু চোরাটানে আবার এসে দাঁড়াই ইস্টিশনে। টিকেট কাউন্টারের জানালায় হাত বাড়িয়ে এক অচেনা গন্তব্যের টিকিট কিনে ফেলি।
সব যাত্রাইতো আর পূর্বনির্ধারিত নয়।
loading...