'সপ্তক' ও 'কালবেলা' – হায়াৎ মামুদ... ১ম ভাগ

স্বপ্ন ও সময় : ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াত্‍ মামুদ ১ম ভাগ।

ভালোবাসা, আমার অদ্যবধি প্রত্যয়, অহৈতুকী। তুমি তোমার ভেতরের গুণে ভালোবাসো; কেউ ভালোবাসার যোগ্য বলে তাকে ভালোবাসা দিচ্ছো এমন নয়। হেতু তার মধ্যে নেই, আছে তোমার নিজেরই ভিতরে। ভালোবাসার আবদারেই অনেকেই অনেক দিন ধরে ঝোলাঝুলি করে আসছেন- এবারে নাকি আমার উচিত স্মৃতিকথা জাতীয় কোনো কিছু রচনায় হাত দেয়া। তাঁদের এই চাওয়ায় আমার যোগ্যতা প্রমাণ হয় না, প্রকাশ হয় তাঁদেরই ভালবাসা। সংগোপনে হয়তো বা লুকিয়ে থাকে একটু আশংকাও।

মরা-বাঁচার কথা কেইবা বলতে পারে? এই যে সৈয়দ আলী আহসান ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন, অনেক শারীরিক কষ্ট ও নিজ দোষে সামাজিক অবহেলা পেয়ে, জানতেন তো না যে চলে যাবেন। তোমারই যে অমনটা হবে না, কি হতে পারে না, কে বলবে? মোটামুটি তো বাঁচলে মন্দ দিন নয়-বাঙালির গড়পড়তা আয়ুর মাপে, নিজেকে নিয়ে বলবার কিছু থাকলে এখনই বলে নাও, পরে সময় না পেলে- তখন? হয়তো মনের আড়ালে এসব চিন্তা উঁকিঝুঁকি মারে তাঁদের, নইলে স্মৃতিচারণিক লিখা লিখতে আমায় তাঁরা বলেন কেন? কিন্তু তারা যা জানেন না, আমি সেই মোক্ষম কথাটি জানি; … তাহলো, আমার সে যোগ্যতা নেই। লিখার যোগ্যতা আছে কি নেই, আমার কাছে তা ধর্তব্যের বিষয়ই নয়। সমস্যাটি অন্যত্র। স্মৃতিচারণ মানুষ করে কী দিয়ে? মালার্মে হলে হয়তো বলতেন- কলম দিয়ে। যেমন তিনি বলেছিলেন কবিতা লিখা হয় শব্দ দিয়ে। কথা তা নয়। লিখতে হলে তো কলম দিয়েই লিখতে হবে; আমার ছাই টাইপরাইটার বা কম্পিউটার কোনোটিই নেই। কিন্তু তারও আগে? লিখতে হবে তো সবচেয়ে আগে স্মৃতির পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে। আমার জানা চৌহদ্দিতে আমাপেক্ষা বিস্মৃতিপরায়ণ মানুষ আমার অন্তত জানা নেই। এ নিয়ে আমার ভারি মনোকষ্ট আছে।

বিশেষ করে আমি এমন দু’-চারজনকে জানি যাঁরা স্মৃতিধর, একবার কিছু দেখলে ছবির মতো ধরা পড়ে থাকে মনের মধ্যে; শুধু দেখলেই না, শুনলেও- সে অর্থে তাঁরা শ্রুতিধরও। মজার কথা, এ ব্যাপারটি আয়ত্বসাধ্য বা চর্চাসাপেক্ষ নয়। বিদ্যাচর্চা বা জ্ঞানবুদ্ধির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত আমি চাক্ষুষ করিনি। আমার পিতৃষ্বসা, বসন্তপক্ষে আবার মাতৃস্বরূপাই-কারণ এর হাতেই আমি মানুষ, একেবারে আদ্যান্ত নিরক্ষর থাকলে কি হবে, সারা গাঁয়ে পুঞ্জিকার ভূমিকা পালন করতেন।

আমাদের জনসন-দা, মান এককালে মস্কোয় রাষ্ট্রদূত খান সামসুর রহমান, উত্তর কৈশোরে পঠিত কবিতা মধ্যপ্রৌঢ়ত্বে বসে আড্ডার আসরে মুখস্ত শুনিয়েছিলেন আমাদের। ডক্টর জি.সি দেবকে দেখেছি একবার কাউকে দেখলে পনের-বিশ বছর পরে দেখলেও তাকে চিনতে পারতেন, নাম-ধাম বলে দিতেন। আমাদের এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গল্পলেখক, হুমায়ুন চৌধুরী, এখন দীর্ঘকাল কুয়ালালামপুরে প্রবাসী মিডিয়ায় কর্মসূত্রে, কী ঈর্ষণীয় স্মৃতিশক্তির অধিকারীই না ছিলেন !!
আমরা তখন ‘সপ্তক’ বের করছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুদা-র ক্যান্টিনে চা-সিঙ্গাড়া খেতে খেতে কী-যেন একটা খসড়া করা হল-একটা লিখা, এক পৃষ্ঠার মতো। আমিই লিখলাম, পাশে বসে ধরতাই যোগাতে লাগলেন জ্যোতি (গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত), সেবু (দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক ও কবি-নাট্যকার সেবাব্রত চৌধুরী, সম্ভবত এখন অবসরপ্রাপ্ত), শামসু (অধ্যাপক শামসুল হক, এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক) আর হুমায়ুন।

কাজের সময় দেখা গেল ঐ লেখাটি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই মিলে হুমায়ুনকে ধরলাম- দেখুন তো মনে করতে পারেন কিনা। আশ্চর্য, হুমায়ুন প্রায় সবটুকুই স্মৃতি থেকে তুলে এনে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। আনিস স্যারের (ড. আনিসুজ্জামান) স্মৃতিচারণ বেরুচ্ছে তখন দৈনিক প্রথম আলো‘তে। একদিন কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করি- স্যার, আপনি কি ডায়েরী রাখতেন? অবাক হয়ে বললেন- না তো, কেন? আমি তার একশ’ গুণ বেশি অবাক হয়ে যাই শুনে যে সবই তিনি স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে লিখছেন, তবে খট্কা লাগলে সম্পৃক্ত দু-একজনকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নেন। দুঃখ করলেন- স্মৃতিশক্তি পড়ে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে তো।

আমার মনে ক্রমে এ বিশ্বাসই দৃঢ় হয়েছে দিনকে দিন যে, আমি প্রায়- স্মৃতিহীন মানুষ, ভবিতব্য এভাবেই আমাকে তৈরি করে দিয়েছে, এতে আমার কোনো দায়ভাগ নেই, আমার করণীয় যেমন কিছু নেই দুঃখশোক করারও কিছু নেই হারিয়েছি বলে। কিন্তু মন তো মানে না। যাই হোক, মানুষ বটে তো আমি। অন্যের ভাগ্যে একটু ঈর্ষে হয় একটু হিংসে, দৈবের ওপরে অভিমানও হয়। আর রাগ হয় আমার সেইসব প্রিয় জনদের ওপরে যাদের ধারণা আমি চাইলেও স্মৃতিকথা লিখতে পারি।

স্বপ্ন ও সময় : ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াত্‍ মামুদ। Munshigonj.com

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

কোন মন্তব্য নেই

মন্তব্য বন্ধ আছে।