কলোসিয়াম (কলাস্সিও)

যারা শুধু দেখতে আসেন, তাদের অনেকেরই জানা নেই কত অসংখ্য রাজবন্দী, যুদ্ধবন্দী, ক্রীতদাস আর মুত্যুদন্ড প্রাপ্ত অসহায় আদম সন্তানের রক্তে সিক্ত ওর ভেতরের মাটি, প্রতিটি ধুলিকণা। একশো ষাট ফুট উঁচু চারতলা এই ইমারতটির প্রতিটি ইট কাঠ পাথরে মিশে আছে তাদের অন্তিম নিঃশ্বাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেই বিভৎস, জঘন্যতম প্রাণ সংহারী দ্বৈত-যুদ্ধের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই কলোসিয়াম।

রক্ত-পিপাসু রোম সম্রাটদের বিকৃত আনন্দের খোরাক যোগাতে গিয়ে কতমানুষ প্রাণ হারিয়েছে এই বধ্যভূমিতে, ইতিহাস তার সঠিক হিসেব রাখেনা। শুধু মানুষই নয়, অজস্র বন্য জীব-জন্তুও আছে সেই সাথে। সম্রাটদের নির্দেশে রাজকোষের অর্থে সে সময় এক ‘বিশেষ খেলা’ র জন্যে উত্তর আফ্রিকা থেকে আমদানি করা হত হাতি, নিউরিয়া থেকে গন্ডার এবং ইরাক থেকে সিংহ- শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে।
৭২ খ্রিষ্টাব্দে এটির নির্মাণ কাজে হাত দেন ফেরিয়াস বংশের সম্রাট, ভেসপাজিয়ান। মূলত জনসভা করার জন্যই ইমারতটি তৈরী করিয়েছিলেন তিনি – এর নাম রেখেছিলেন এমফি-থিয়েটারিয়াম ফেভিয়াম। সাত বছরে তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণ করে আকষ্মিক ভাবে মারা যান ভেসপাজিয়ান।
এরপর ক্ষমতায় বসেন তাঁর পুত্র, টাইটাস। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সম্রাটদের একজন ছিলেন টাইটাস। এমফিথিয়েটারের বাকী কাজ সম্পন্ন করেন তিনি। নাম পাল্টে নতুন নাম রাখেন কলোসিয়াম। এবং জনসভাস্থলটিকে ‘বিশেষ খেলার স্থান’ হিসেবে ঘোষনা করেন। একদিন খুব জাঁকজমকের সংগে শুরু হয় ‘বিশেষ খেলা’।
জীব-জন্তুর লড়াই। ভাল্লুকের সাথে হাতি, হাতির সাথে বুনো মোষ বা গন্ডারের সাথে হাতির লড়াই। দেশের বিশিষ্ট নাগরিক সিনেটর নাইট সেনা অফিসার এবং বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে সে-খেলা উপভোগ করতেন টাইটাস। এক সময় কান্ত হয়ে পড়েন তিনি এই একঘেঁয়ে খেলা দেখতে দেখতে। ব্যাপারটা হঠাৎ করেই সাদামাঠা হয়ে ওঠে।
এ সময় একদিন নতুন এক আইডিয়া আসে টাইটাসের মাথায়। লড়াইটা মানুষে মানুষে হলে কেমন হয়? ভাবলেন তিনি, ডুয়েল? বুদ্ধি আছে মানুষের মাথায়, রণকৌশল জানে তারা। পশুদের মত লড়াই হবে না সেটা, আরও কিছু থাকবে তাতে।
সেই থেকে শুরু। পশুর খেলা বন্ধ হয়ে গেল, শুরু হল মানুষের খেলা। কয়েকদিন পর পর নিয়মিতভাবে চলতে লাগল এ-খেলা। রাজবন্দী যুদ্ধবন্দীদের মরণপণ লড়াই। যতক্ষন না কোন একজনের মৃত্যু হত, ততক্ষন পর্যন্ত চলত দ্বৈত-লড়াই। কিন্তু ‘মাত্র’ একশোটি খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল টাইটাসের। এর-পর একদিন হঠাৎ করেই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যান তিনি- বন্ধ হয়ে যায় খেলা।
লম্বা বিরতির পর আবার শুরু হয় তা ২৬৪ খ্রিষ্টাব্দে। ব্রুটাস ভ্রাতৃদ্বয় চালু করেন এই ‘ঐতিহ্যবাহী’ খেলাটি। এঁরা চালু করেন ‘গ্ল্যাডিয়াস’ (খাটো তরবারি) – এর লড়াই। লড়িয়েদের বলা হত গ্ল্যাডিয়েটর। লড়াই চলাকালে কোন গ্ল্যাডিয়েটর আহত হয়ে পড়ে গেলে উল্লাসে ফেটে পড়ত কলোসিয়াম।
সে সময় মৃত্যু ভয়ে ভীত, ক্ষত-বিক্ষত গ্ল্যাডিয়েটর রেওয়াজ অনুযায়ী বাঁ হাত তুলে সম্রাটের করুণা প্রার্থনা করত, প্রাণ ভিক্ষা চাইত। মঞ্জুর করা না করা সম্পূর্ন তাঁর মন-মেজাজের ওপর নির্ভর করত। সম্রাটের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল আকাশ নির্দেশ করলে অপর গ্ল্যাডিয়েটর বুঝে নিত- তিনি বলছেন, ‘মিট্রি!’ অর্থ্যাৎ ছেড়ে দাও। আর ভূমি নির্দেশ করার অর্থ, ‘জুগুলা!’ – শেষ করে দাও।
জুলিয়াস সীজার এখানে তিনশো গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই উপভোগ করেন। আর সম্রাট ট্রাজান উপভোগ করেন পাঁচ হাজার দ্বৈত-যুদ্ধ। অনেক ঐতিহাসিকের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ষ্টালিন গ্রাদে যত রক্ত ঝরেছে, তারচেয়ে অনেক বেশি রক্ত ঝরেছে রোমের এই এক চিলতে মাটিতে।

কোথায় যেন পড়েছি, বহু বছর আগে খ্রিষ্টানদের এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়েছিল এখানে। ভ্যাটিকানের চোদ্দতম পোপ, গ্রেগরী উপস্থিত ছিলেন তাতে। অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাদের প্রত্যেককে কলোসিয়ামের এক মুঠো করে মাটি উপহার দিতে চেয়েছিলেন গ্রেগরী, কিন্তু কেউ-ই তা নিতে রাজি হননি। বলেছিলেন, “এই মাটি হাতে নিয়ে চাপ দিলে এখনো বের হবে তাজা রক্ত, তাই এই পাপের ভাগি আমরা হতে চাই না।” এ মাটিতে রক্তের গন্ধ। আমরা চাইনা এ মাটি।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

কোন মন্তব্য নেই

মন্তব্য বন্ধ আছে।