ঘুমানোর আগে কিছু টুকটাক কাজ সেরে ঘুমাতে যাই। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। বিয়ের আগে অভ্যাসটি রীতিমতো ভয়ংকর ছিল। বিয়ের পর একটু কমে আসলেও মহুয়া’র মৃত্যুর পর পুরনো অভ্যাসটি আবারো জেঁকে বসেছে। এখন অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রায় প্রতি রাতেই নির্ঘুম কাটে।
যেখানে থাকি সেই গ্রামটির নাম হাওয়া পাইড়া। এই গ্রামের একদম শেষ মাথায় দুই রুমের একটা ছোট টিনের ঘরে আমার বাস। ঘরের পিছনে এবং ডানে-বামে পুরাটাই ফাঁকা। এককথায় বলা যায় যতো দূর চোখ যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। সামনের সাইটে একটা গ্রাম আছে, পাথরঘাটা তার নাম। পায়ে হেঁটে গেলে তাও প্রায় মিনিট বিশেক তো লাগবেই। তবে আমার কখনো যাওয়া হয়নি ওদিকে। একদিকে তো ওই গ্রামে তেমন কোন কাজ থাকে না তার ওপর মহুয়ার বিশেষ নিষেধ ছিল ওদিকটায় যাওয়ার।
কিন্তু আজ যেতে হচ্ছে আমায়। এই নিশুতি রাতে জনমানবহীন জমির আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছি। উদ্দেশ্য জমির চাচা। আপন চাচা নন তিনি আমার। বয়স প্রায় সত্তুরের ওপরে। এখনো লাঠির সাহায্য ছাড়াই দিব্যি হেঁটে বেড়ান। শুনেছি নামকরা কবিরাজ তিনি। দুই-চারটা জ্বিন – ভুত নাকি তার সবসময়ের সঙ্গী। যে আইল ধরে হাঁটছি সেটা৷ একটু পিছলা। সন্ধ্যার দিকে একটা বড় বৃষ্টি হয়ে গেছে। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। তিন- চারবার পা পিছলে পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে ঠিক রেখেছি।
লাইট না থাকায় সমস্যা হচ্ছে বেশি। রাত জাগা পোকামাকড়ের ডাক বড়ই অদ্ভুত লাগছে। হঠাৎ একসঙ্গে তিন-চারটা বিড়ালের ডাক কানে। এর মধ্যে আবার একটা কান্না শুরু করে দিয়েছে। ছোট্ট বাচ্চার কান্নার আওয়াজের মতো। ছোট বেলায় মা বলতেন বিড়ালের কান্না ভালো নয়। কুলক্ষণ। বিড়ালের চিৎকারে টেকা দায়। মাথাটা তুলে সবে ডান দিকে তাকিয়েছি। আর অমনিই বাঁ পাটা পিছলে পড়ে যাবো ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ডান হাতটা কে যেনো খপ করে ধরে ফেলল। তাকিয়ে দেখি জমির চাচা। ধবধবে সাদা পাজামা – পাঞ্জাবি পড়ে আছেন। মুখে হাসি। তার পায়ে কোন কাদার চিহ্ন নাই দেখে একটু হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে ছালাম দিলাম।
– চাচা আমি তো আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম
– হু, চলো তাহলে বাসায় চলো সেখানে আলাপ পাড়বো।
বলেই তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন। আমি ওনার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। গল্পে পড়েছিলাম ভুতদের পায়ের গোড়ালি, আঙুল, পাতা কিছুই থাকে না। কিন্তু চাচার পায়ের দিকে তাকিয়েও আমি কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না তার পাজামার কারণ।
জমির চাচার বাড়ি। আমি দাঁড়িয়ে তার দরজার সামনে। উনি বাথরুমে গেছেন। যাওয়ার আগে বললেন, একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি। প্রায় মিনিট দশেক পেরিয়ে গেলেও তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। এভাবে পনের, বিশ, পঁচিশ আধাঘন্টা পেরিয়ে গেলেও তিনি বের হচ্ছেন না দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আশ্বিনের রাতেও আমি ঘেমে উঠছি। একসময় বাধ্য হয়ে দরজায় গিয়ে কড়া নাড়া শুরু করলাম। যিনি দরজা খুলে দিলেন তাকে দেখে হোঁচট খেলাম। একি জমির চাচা! কিন্তু বয়স এতো কম কেন তার?
দরজা খুলেই তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কে আপনি, এতো রাতে কি চাই?
আমি কোনরকমে আমতা আমতা করে বললাম, জ..মি..র চাচা….! আমার মুখের কথা শেষ করার আগেই উনি কেড়ে নিয়ে বললেন, আব্বা তো নেই। তিন বছর আগে তিনি মারা গেছেন।
এবার আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। ধপাস করে পড়ে গেলাম সেখানেই। দেখি লাল – নীল – হলুদ বিভিন্ন রকমের আলো দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে। আর আলোর মাঝখানে মাথা তুলে তাকিয়ে আছে মহুয়া। সে যেনো বলছে, আমি তোমাকে নিষেধ করছি না, ওদিকে যাবা না, যাবা না।
.
চলবে…
loading...
loading...
আপনার জীবন গদ্য একদম ঝরঝরে গোছানো টাইপের হয়। মুগ্ধ হই।
loading...
আপনার লেখা “অশরীরীঃ না গল্প না প্রবন্ধ” আগের পর্বগুলো সময়ের অভাবে পড়া হয়নি। এই ১০ পর্ব পড়ে আগের পর্বগুলো পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে। সময় করে পড়ে নিবো, আশা করি।
শুভকামনা নিরন্তর।
loading...