ছোটগল্প: দড়ি

মাথার উপরে টাঙানো দড়িটার দিকে শেষবারের মতো এক ‍দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফয়সাল। ছিঁড়ে যাওয়া মাকড়সার জাল যেমন করে ঝুলে থাকে আর সামান্য বাতাসেই দুলতে থাকে ঠিক দড়িটাকেও এখন তাই মনে হচ্ছে। নিজেকে তার মাকড়সা মনে হয়। ঝুলে যাওয়া একটা দড়ির শেষ মাথায় এসে সে চিৎকার করছে। না নামতে পারছে নিচে, না যাইতে পারছে ওপরে। জান বের হওয়ার মতো একটা অবস্থা। সে জোরে চিৎকার করবে নাকি মিঁইয়ে কান্না করবে বুঝে উঠতে পারে না।

কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল মনে নেই। হবে হয়তো মিনিট পাঁচেক কিংবা সাত এর মতো। আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না ওর। স্মৃতিশক্তি যেনো লোপ পেয়ে বসেছে। অনেককিছুই মাথা থেকে হারিয়ে গেলেও দীনার কথা ভুলতে পারে না কিছুতেই। দীনা! হু, দীনার কথাই বলছি। আর দশটা মেয়ের মতো করে না হলেও সে দীনাকে অনেক ভালোবাসতো। বয়সেও ফয়সালের চেয়ে দু’বছরের বড় হবে ও। তারপরেও দীনার চাওয়াকে না করতে পারেনি। সেদিন কেন যে পারেনি সে নিজেও জানে না। দীনার মনে হয়তো বা অনেক কিছুই খেলা করতো। রঙিন আকাশে স্বপ্নগুলো ভাসিয়ে দিতো একে একে। কোন এক চৈত্রের সকালে দীনা এসে হাজির ফয়সালের মেসে। তখন সবে লেখাপড়া শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পদে যোগদান করেছে ও। মাস শেষে ভালো বেতনও পাইতেছিল। দীনাকে দেখে কিছুটা হতচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে দীনাকে রুমে নিয়ে আসে। ভাগ্য ভালো যে, সেদিন মেসে আবদুল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ ছিল না। আবদুল্লাহ্কে খুব সংক্ষেপে কিছু বিষয় বুঝিয়ে আবার নিজের রুমে আসে ফয়সাল।

অল্প কথায় যা বললো দীনা তার সারমর্ম হলো সে তার বাসায় কাউকে না জানিয়ে ফয়সালের কাছে এসেছে। বাসায় আর যাবে না। বেশ বিধ্বস্ত চেহারার দীনাকে তার সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয়। অথচ ছোট বেলায় এই মেয়েই কিনা সারা গ্রাম দাঁপিয়ে বেড়াতো। ফয়সালের চেয়ে বড় হয়েও তার সামনে আসলেই কেমন যেন চুপসে যেতো লজ্জাবতী লতার মতো। তারপর পানি অনেকদূর গড়িয়েছে। সাত বছরের সংসারে তাদের পাঁচ বছরের অতনী নামে একটা মেয়ে আছে। অতনী জানুয়ারী থেকেই স্কুলে যাচ্ছে। মেয়েটার কথা শুনলে আত্মা ভরে যায়।

এই সংসারে এখন দীনা নেই। অতনী নেই। ঘরভরা হাসি নেই। কিছু চেয়ে না পেলে অতনী যে বালিশটায় মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো সেই ছোট্ট বালিশটা খাটের এক কোণায় পড়ে আছে। ধূলা পড়ে কেমন মলিন স্যাঁতস্যাঁতে সাদা হয়েছে। দীনারা চলে যাবার পর ফয়সালও ঘরের আর কোন জিনিসপত্র ঘুছিয়ে রাখেনি। দীনা যেমন করে রেখে গেছিল ঠিক তেমনি পড়ে আছে। অবহেলায়, অযত্নে।

শক্ত করে দুইহাত দিয়ে ধরে টান মেরে দেখে ছিঁড়ে যায় কি না। না, বেশ শক্তি আছে দড়িটায়। অথচ এই দড়িটা সংগ্রহ করতে তাকে বেশ গলদঘর্ম হতে হয়েছে। মনে হয়েছে কাঠখোট্টা এই ঢাকা শহরে দড়ি সংগ্রহ করাটাই সবচেয়ে বড় কঠিন কাজ। বিষ খাওয়ার মতো যার হাতে কোন পয়সা নেই সে এই করোনা কালে দড়ি কিনবেই বা কি করে। নদী ভাঙ্গন যেমন করে তীরে থাকা মানুষের ভিটেমাটি কেড়ে নেয়। স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয় এই করোনাও তেমনি ফয়সালের স্বপ্নগুলো কেড়ে নিয়েছে। দিন তিনেক তাকে ব্যায় করতে হয়েছে এই দড়ি খোঁজার পিছনে। শেষে যখন হতাশ হয়ে বিকল্প কিছু ভাবতে শুরু করেছে ঠিক তখনই এই দড়িটার খোঁজ মেলে।

চাকরী খোঁজার চেয়েও কঠিন মনে হচ্ছিল একটা দড়ি খুঁজে বের করা। অথচ এই সপ্তাহ খানেক আগেও সে দেখেছে অনেক জায়গায় দড়ি পড়ে আছে বেশ অবহেলায়। হাতিরঝিল দিয়ে হাঁটতে গিয়েও চোখের সামনে পড়েছে অনেক দড়ি। শুধু তাই নয় করোনা কালের আগে কাওরান বাজারে মাছ কিনতে গিয়েও সে প্রচুর দড়ি দেখেছে। অথচ এই দড়িটাই আজ যেনো সোনার হরিণ। তন্ন তন্ন করেও খোঁ মিলছে না তার। হতাশ ফয়সাল মাথা তুলে আসমান দেখতে গিয়ে থমকে যায়। কাওরান বাজার রেলগেটের পাশেই একটা নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ হচ্ছে। চোখ তুলে উপরে তাকাতে গেলে চোখ ব্যাথা হয়ে যায় এমনই উঁচা বিল্ডিং। চোখ উপর থেকে নিচের দিকে আনতেই চমকে ওঠে। আরে! এই তো দড়ি। উচা বিল্ডিংটার নিচতলার এককোনায় পড়েছিল দড়িটা। দড়ির অর্ধেকটা ভেজা। চুন-সুরকি আর বালিতে মিশে একাকার। তাতে কি! ভাবে ফয়সাল। দড়িটা তার যেভাবেই হোক চাই। বাসায় গিয়ে নাহয় পরিষ্কার করে নিবে। নিচতলায় এই ইট, চুন-সুরকি আর বালির যে দেখাশোনা করছিল সেই দারোয়ানকে অনেক অনুরোধ করার পর তার হৃদয় গলে যায়। কেননা ফয়সালের জানা আছে, নিচুতলার মানুষদের আর যাই হোক একটা ভালো মন থাকে। একটু অনুরোধে যদি গলে যায় তো একেবারে মোমের মতো হয়ে যায়।

-ভাই, আসসালামুই আলাইকুম। গলাটা একটু পরিষ্কার করে সালাম দেয় ফয়সাল।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। বেশ ভারি গলায় জবাব দেয় দারোয়ান।
– কে আপনি? এখানে কি চাই? কেন এসেছেন?
-ভাই, আ-আমি ফয়সাল। এসেছি ঐ দড়িটার জন্য আঙুল উঁচিয়ে দড়িটার অবস্থান দেখিয়ে দেয় ও।
-দড়ি-টড়ি এখন হবে না। যান তো।
-ভাই, আমার খুব দরকার ভাই। যদি দেন তাহলে আমার খুব উপকার হবে ভাই। আরও অনেক অনুনয়-বিনয় করার পর দিলটা নরম হয় দারোয়ানের। দড়িটা দিয়ে দেয়। শুধু দড়ি না, একটা পুরাতন বাজারের ব্যাগে ভরে দিয়ে দেয়।
দড়িটা হাতে পাওয়ার পর তার মনে হয়েছিল সে বুঝি স্বর্গ হাতে পেয়েছে। লম্বায় প্রায় বিশ হাত হবে। দড়িটা হাতে নিয়েই ফয়সাল বুঝে যায় এটাতেই কাজ হবে। দড়িটা নিয়ে বাসায় এসে বদ্ধ দরজার তালা খুলতেই একটা উৎকট গন্ধ নাকে এসে ঢোকে। চিকা মরার মতো এই গন্ধটা কয়েকদিন ধরেই সে পাচ্ছিল। কিন্তু গন্ধটার উৎস কোথায় সে খুঁজে দেখেনি। দড়িটা খাটের ছুঁড়ে মেরে দড়াম করে শুয়ে পড়ে ফয়সাল।

ফয়সাল মরে যাচ্ছে। ফাঁসিতে ঝুলে। চেয়ারের ওপরে উঠে দড়িটা গলায় আটকানোর পরে পা দিয়ে ল্যাং মেরে চেয়ারটা ফেলে দেয় ফ্লোরে। ছটফট করতে থাকে বন্দুকের গুলি লাগা পাখির মতো। পানি! আহ্ কেউ যদি তাকে এই মূহুর্তে একগ্লাস ঠান্ডা পানি দিতো। অতনীর মুখটা মনে করার চেষ্টা করে। দীনা! দীনা কোথায়? অন্ধকার পৃথিবীতে প্রিয়জনের মুখটা দেখতে পারার ভীষণ কষ্টে ফুরৎ করে জানটা বের হয়ে যায়। নিথর ফয়সালের দেহ ঝুলতে থাকে ফাঁসির দড়িতে।

দরজায় দুড়ুম-দাড়াম শব্দ হচ্ছে। শব্দ তিক্ষ্ণ থেকে তিক্ষ্ণতর হতে থাকে। কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মতো শব্দ। ঘুম থেকে হুড়মুড় করে উঠে বসে ফয়সাল। পানির পিপাসায় যেনো বুক ফেটে যাচ্ছে। ফিল্টারে পানি নেই। ডাইরেক্ট লাইন থেকে মগে পানি নিয়ে ঢকঢক করে পান করে। ওদিকে তখনও দরজার তার মেয়ে চিৎকার করছে, বাবা..। ও বাবা…..। দরজা খোলো। আমি অতনী, বাইরে দাঁড়িয়ে আছি তো। কিছুক্ষণ পর দীনাও ডাকতে থাকে। ফয়সাল, দরজা খোলো, আমি ফিরে এসেছি। ফয়সাল দরজা খুলতে গিয়ে দড়িটার দিকে তাকায়। ধূলোমাখা দড়িটা যেনো তাকে বিদ্রুপ করছে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৩-১১-২০২০ | ১১:৩৭ |

    অসাধারণ একটি অণুগল্প পড়লাম দীর্ঘদিন পর। শুভেচ্ছা কবি মোকসেদুল ইসলাম। শব্দনীড়ে অনেকদিন পর আপনার লিখা প্রকাশিত হওয়ায় ধন্যবাদ জানালাম।

    GD Star Rating
    loading...
  2. ফয়জুল মহী : ২৩-১১-২০২০ | ১২:৪৭ |

     চালিয়ে যান অবিরাম । পড়ে আকৃষ্ট  হলাম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_cry.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. আলমগীর সরকার লিটন : ২৪-১১-২০২০ | ১০:৪১ |

    অনেক অভিনন্দন ও শুভেচছা রইল  ভাল লেগেছে কবি দা

    GD Star Rating
    loading...