হালখাতার চিঠিটা দ্বিতীয়বারের মতো খুলে বউয়ের চোখের সামনে মেলে ধরে যতীন। তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর। নিশ্চুপ পৃথিবীতে দোচালা টিনের ঘরে তখনও দুটি মাত্র প্রাণী জেগে আছে। হিসেব কষছে আগামী পৃথিবীর। অভাবের সংসারে প্রায়ই প্রতিরাতে জেগে থেকে তারা পরের দিনের হিসেব কষে। আর রাতের দেখা স্বপ্নগুলো সকালবেলা ঘুম থেকে জাগতে না জাগতেই কাঁচের টুকরার মতো ভেঙ্গে গেলেও তারা কখনও হতাশ হয় না। পরের রাতে আবারও নবউদ্দামে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। গরীবের দুয়ারে যখন কোন স্বপ্ন এসে হানা দেয় তখন স্বভাবতই আনন্দের সাগরে ভেসে যায় তারা । হোক না সে স্বপ্নটি যতো ছোটই। তবে আজকের জেগে থাকাটা তাদের জন্য একটু ব্যতিক্রম এবং দুঃচিন্তারও বটে। দুঃশ্চিন্তাটা এ কারণেই যে আজ সে একটা হালখাতার চিঠি হাতে পেয়েছে এবং বকেয়া টাকাগুলোও শোধ করতে হবে দ্রুতই। হঠাৎ শাঁ করে একটা দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ায় চমকে ওঠে যতীন। ভয় কি জিনিস যদিও সে আজ পর্যন্ত জানে না। ভুত-প্রেত ওসবে তার বিশ্বাস নেই। কিন্তু কেন যেন হালখাতার চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই এক অজানা আতঙ্ক বাসা বাঁধছে তাঁর মনে ভেতর। বেশ সুন্দর রঙিন খামের ভেতর চিঠিটা খুলে উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকে কিন্তু পড়তে পারে না বলে আফসোস হয় তার। এমন নিশুতি রাতে যদি একটা বাক্যও আজ পড়ে সে তাঁর বউকে শোনাতে পারতো তবে কতই না মজার হতো। চিঠিটা ‘হালখাতা’র এই বিষয়টি মনে হওয়ায় ভাবনাগুলো আর বেশিদূর ডালপালা মেলতে পারে না। রসুল খাঁ যখন তাঁর হাতে চিঠি দিয়ে বলেছিল – নেও মিয়া, হালখাতার চিডি, এবার কিন্তু তোমারে আইতেই অইবো।” তখনই তাঁর বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠেছিল। এতো টাকা সে জোগাড় করবে কিভাবে। হাতের পাঁচ আঙুলের উপর নির্ভর করে চলে যার সংসার সে কিছুটা হলেও গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। অনেকের কাছেই হয়তো মনে হতে পারে এ আর এমন কি! সামান্য কয়টি টাকা। কিন্তু যতীনের কাছে এটা রীতিমত প্রায় বিশ দিনের কামলার দাম। প্রথমবার যখন সে বাড়িতে এসে চিঠিটা খুলছিল তখন মনের অজান্তেই তার একটি কোণা ছিঁড়ে যায়। বিষয়টা খেয়াল হয় তাঁর তিন ক্লাশ পড়–য়া ছেলে শৈলেনের কথায়।
-বাবা, তুমি চিডিটা ছিঁইড়া ফ্যাললা?
– হ বাপ, খেয়ালই করবার পাম নাই। টান দেওনের সময় ছিঁইড়া গেল। ছেঁড়া চিঠিটা টান দিয়ে বের করে তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু অশিক্ষিত যতীন কোন অর্থই উদ্ধার করতে না পেরে ছেলের দিকে বাড়িয়ে দেয়। তার কাছ থেকেই জানতে পারে দোকানে মোট বাঁকী পড়েছে দশ হাজার টাকা। গেল সোমবার। হাটের দিন। সারাদিন রইসউদ্দিন ব্যাপারী বাড়ীতে কামলা খেটে যখন বাড়িতে আসে তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। গোসল সেরে হাটের দিকে রওনা দিতে দিতে মাগরীবের আজান দেয়া শুরু হয়। একটু জোরেই পা চালায় যতীন। ব্যাপারীর কাছ থেকে কামলার টাকা নিয়ে তবেই বাজার-সদাই করতে হবে। বাজারে গেলেও সে সবসময় দক্ষিণ দিকের ‘রসুল বস্ত্রালয়’ দোকানটিকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু ব্যাপারী আজ সে দিকটায় অবস্থান করায় বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে। বিশেষ কায়দা করে দোকানটা পাড় হতে গিয়েও সুবিধা করতে পারেনা যতীন। রসুল খাঁ ঠিকই তাকে ধরে ফেলে। গেল বছরের বাঁকীটা যেন এবার ঠিক ঠিক শোধ করে দিয়ে যায় তাঁর ব্যবস্থা করতেই হাতে এই হালখাতার চিঠিটা ধরিয়ে দেয়। যতীন লোকটি এমনিতেই নির্ঝঞ্ঝাট, সহজ সরল মানুষ। তারঁ মতো গরীবের এসব বাঁকী নেয়া শোভা না পেলোও মাঝে মধ্যে এমন পরিস্থির সৃষ্টি হয় যে, বাঁকী না নিয়ে আর উপায় থাকে না। গেল বছর তার বড় মেয়ের বিয়ে দেয়ার সময় জামাই ও মেয়ের কাপড়-চোপড় কিনতে গিয়েই বাঁকী পড়েছিল। কিন্তু অভাবের সংসারে আর বাঁকীটা পরিশোধ করা হয়নি। ‘কি উপায়ে টাকাগুলো পরিশোধ করা যায়’ তাই নিয়েই এই মধ্যরাতে স্বামী-স্ত্রী আলাপ করছিল। বিন্দুমাত্র লেখাপড়া না জানলেও সে বুঝতে পারে এবার টাকাগুলো শোধ করতে না পারলে মান-সম্মান নিয়ে আর হাটে যেতে পারবে না। কারণ গরীবের মান একবার গেলে আর ফেরত আসে না।
শুক্রবার। ছুটির দিন। সবাই এই দিনে কিছুটা আরাম আয়েশে কাটাতে পারলেও যতীনের পক্ষে কখনো এটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরং সব দিনই সমান। তার জীবনে স্পেশাল বলে কিছুই নেই। গরীবের মাথায় একবার টাকার ভাবনা ঢুকে পড়লে আর বের হতে চায় না। গত তিনদিন ধরে হালখাতার পোকাটি মাথায় ঢোকার পর থেকে সে আর ভাল নেই। পোকাটি বারবার শুধু কামড়াচ্ছে মাথায় তা টাক মাথায়। মুক্তির জন্য সে ছটফট করলেও টাকা জোগাড় করতে না পারায় এ যাত্রায় তার মুক্তি মেলেনি। হালখাতার পোকাটির হাত থেকে মুক্তি পেতেই শুক্রবার এই সাতসকালে সে হাজির হয়েছে রইসউদ্দিন ব্যাপারীর বাড়িতে। গতকাল বিকালে কাজ শেষ করে যাওয়ার সময় বিষয়টি নিযে ব্যাপারীর সাথে তার খোলাখুলি আলাপ হয়েছিল। তিনিও আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। বিনিমযে শুধু বাজার দরের চেয়ে তিন মণ ধান বেশি দিতে হবে আসছে ইরির সিজনে। কোন উপায় না পেযে নিরুপায় যতীন তাতেই রাজী হয়ে যায়। ব্যাপারী তখন সবেমাত্র নামাজ শেষ করে বৈঠকখানায় বসেছে। যতীন তাকে সালাম ঠুকেই বলে উঠে – ব্যাপারী সাব ভালা আছেন?
-হ, ভালা আছি। তোমার দিনকাল কেমন চলছে মিয়া?
-গরীবের আবার দিনকাল কি সাব। আছি কোন রকমে।
– না মিয়া, তুমি তো ভালা মানুষ না। য্যামনেই থাক, শোকর গুজার করতে হয়, বুঝছো।
-জি। বেশি কথা বলতে পারে না যতীন।
-ট্যাহার জন্য আসছো তো নাকি? বলেই পাঞ্জাবীর পকেট থেকে কড়কড়ে নতুন পাঁচ শ টাকার বিশটা নোট যতীনের হাতে তুলে দ্যায়। নতুন টাকার গন্ধ পেয়ে তার ভেতরটা কেমন যেন আনচান করে উঠে। টাকাগুলো নিয়ে সে যখন রাস্তায় বের হয় এই গরমেও সে ঠান্ডা অনুভব করে।
শিশুপুত্র শৈলেন কে সঙ্গে নিয়ে হাটের দিকে রওনা দেয় যতীন। তখনও ঠিক মতো সন্ধ্যাটা ঘনিয়ে আসেনি। সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে মাত্র। সন্তানকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য সেও কিছু ভাল মন্দ খেয়ে নিক। রসুল খাঁর দোকানের সামনে গিয়ে অবাক হয়ে যায় যতীন। রং বেরংয়ের বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে দোকান। দেখলেই ধাঁধাঁ লেগে যায় চোখে। দোকানে যাওয়া মাত্রই তাকে হাসি মুখে বসতে দ্যায় রসুল খা। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। দোকানের বাকী পরিশোধ করার সময় সে খেয়াল করে দোকানের ক্যাশ বাক্সটি মনে হয় নতুন কেনা হয়েছে। তার ওপর আবার লাল শালুক কাপড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। রসুল খাঁ ও আজ সাদা ধবধবে একটা পাঞ্জাবী পড়েছে। বেশ লাগছে তাকে। টাকা পরিশোধ হয়ে গেলে দোকানের কর্মচারী তাকে একটা সুন্দর গোছানো ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে দেয়। সেখানে টেবিলের ওপর বিভিন্ন খাবার দেখে জিভে জল আসে তার। মানুষের টাকা আদায়ের কতনা বিচিত্র ফন্দি। বাপ-বেটা পেট পুরে খেয়ে যখন বাড়ির দিকে রওনা দেয় তখন রীতিমত রাত হয়ে গেছে। সারাটা পথ বাবার হাত ধরে হাটতে থাকে শৈলেন। আর যতীন হেটে হেঁটেই স্বপ্ন দেখে তার ছেলেও একদিন বড় হয়ে এমন মস্ত বড় একটা দোকানে দেবে হাটে। আর সে ক্যাশ বাক্সে বসে থেকে শুধু টাকা গুনবে। এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সূখী ব্যক্তি। ভুলে যায় ব্যাপারী কাছ থেকে আনা ঋণের টাকার কথা।
বাড়িতে প্রবেশ করেই আচমকা একটা ধাক্কা খায় যতীন। একি! তার বড় মেয়ে এই অসমযে বাড়িতে, কোনরূপ পূর্ব সংবাদ ছাড়াই হাজির। জামাইকে দেখার আশায় ডানে-বামে চোখ ফেরায়। তার ছেলে কখন যে হাত ছেড়ে বোনের কাছে চলে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি।
-কিরে মা, কেমন আছোস, জামাই কোনডে? কিন্তু কথা শেষ করতে পারেনা যতীন তার আগেই বুকের ওপর আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয় মেয়েটি। কাঁদতে কাঁদতে যা বলে শুনে যতীনের মুখ শুকিয়ে পাংশুটে হয়ে যায়। জামাই নাকি বলে দিয়েছে সাতদিনের মধ্যে যৌতুকের বাকীঁ দশ হাজার টাকা দিতে না পারলে মেয়েকে কোনদিন বউ হিসেবে মেনে নেবে না। কথাটি শুনে বাড়ির উঠোনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে যায় যতীন। মাথার ভেতরের পোকাগুলো আবারও কিলবিল করতে থাকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রইস ব্যাপারী, রসুল খাঁর দোকান আর হরেক রকমের মিষ্টি। কিন্তু একি! মিষ্টি ভেতর এতো পোকা কেন? মিষ্টিগুলোর ভেতর থেকে তাঁর জামাইয়ের মুখটাই বা কেন দেখা যাচ্ছে? খেটে খাওয়া যতীন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। সেই মুখের ওপর সে সজোড়ে একদলা থুথু নিক্ষেপ করে।
loading...
loading...
অতি চেনা জানা পরিচিত এই সমাজেরই চিত্র। যেন যাপিত জীবনের গল্প।
নাহ্। গল্প বললে ভুল হবে। আমাদের গল্প। সবার হয়তো নয়; কিন্তু অনেকের।
loading...
ধন্যবাদ মুরুব্বী
loading...
মোকসেদ ভাই, কবিতার মত গল্পেও আপনি পাকা।
শুভেচ্ছা রইল।
loading...
মন্তব্যের জন্য ভালোবাসা আনু ভাই
loading...
বাহ, বেশ চিত্রকল্প
loading...
ধন্যবাদ দাদা
loading...
গল্পটি পড়লাম। বেশ লাগলো!
অভিনন্দন প্রিয় মোকসেদুল ভাই।
loading...
ধন্যবাদ ভাই
loading...