ছোটগল্পঃ রুপন্তির কথা

তিনি এক রকমের কানে ধরেই সাংবাদিককে মুখের কাছে এনে বললেন,”রেইপ কথাটা বেশ্যাদের বেলায় ঠিক খাটেনা”। সাংবাদিক হে হে করে হেসে বললো, “খুবই হক কথা, নেতা”। উপস্থিত পাতি নেতাদের মধ্যে যারা তাদের নেতার কথা শুনলো তারা হেসে ওঠলো; যারা শুনেনি তারাও।

বিকেলেই রিপোর্টটা একটা অনলাইন পোর্টালে এলো। শিরোনামের নিচে পর্ণ ম্যুভি থেকে কপি পেস্ট করা একটা ছবি। রসিয়ে রসিয়ে লিখা। বিস্তারিত পড়ে নিহালের মন ভার হয়ে গেলো। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে। রুপন্তির ইনবক্সে নক করলো;

-কি করছ?

রুপন্তিকে এটা নিহালের কমন প্রশ্ন। ইনফ্যাক্ট এটা দিয়েই সে কথা শুরু করে। এক্ষেত্রে রুপন্তিরও একটা রেডিমেইড জবাব আছে,“তোমার জন্য নিজেকে সাজাই”!

কিন্তু আজ নিহাল কোন জবাব পাচ্ছিলনা। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনের মিনিট ! অতঃপর মোবাইলে কল দিয়ে সে রুপন্তিকে অনলাইনে আসতে বললো।

-বিশেষ কিছু করছিনা, নিহালের প্রশ্নের জবাবে রুপন্তি লিখলো।
দুমিনিট আগে হারিকেনের সলতে কমাতে গিয়ে কী মনে করে যে বাড়িয়ে দিলাম মনে আসছিলনা। পরে মনে পড়েছে, মিন্সট্রুয়েশন শুরুর এক্সপেক্টেড ডেট থেকে কতদিন পার হয়ে গেছে সেটা ক্যালেন্ডারে দেখতে চেয়েছিলাম। আসলে এই মুহূর্তে সেটাই করছিলাম আর তুমি কল দিলে। আজ দুই সপ্তাহ পূর্ণ হয়েছে। এর আগে নিয়মিতভাবে আটাশ দিনের চক্র ছিল। বিয়াল্লিশ দিন হয়ে গেলো। আমি নিশ্চিত প্রেগন্যান্ট।
রুপন্তি যোগ করলো।

– জানি
-কিভাবে জেনেছ?
-একটা অনলাইন পোর্টালে এসেছে ।

রুপন্তি বিষন্ন হলো। এসব ওই বদমাশদের কাজ। সে বিশ্বাস করে, ওরা ভালো করে জেনে লিখেনি। নিশ্চয়ই সবকিছু মনগড়া এবং বিকৃত। নাদেখা রিপোর্টটির নানান সিনারিয়ো তার চোখে ভাসতে লাগলো।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিহাল লম্বা করে একটা কমেন্ট লিখেলো; কিন্তু পোষ্ট করলোনা। কী লিখবে বুঝতে পারছিলনা। অতঃপর কিছুক্ষণ অফলাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো ;

-পরে আসছি।

নিহাল লগ আউট হলো।
রুপন্তি অপেক্ষা করতে লাগলো।

কেন অপেক্ষা করছে? নিহাল তার কেউ কি?
কে?

বিএ পাশ করার পর পরই রুপন্তির বিয়ে হয়। কিন্তু একটা রাতও পুরো হয়নি; ওর স্বামী মারা যায়। পুকুর ঘাটে সাপের কামড়ে। সেই থেকে কপালে অপয়ার সিল পড়ে। আর বিয়ে করেনি। একটা বেসরকারি চাকরি নিয়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ওটা একটা “হায় হায় কোম্পানি” ছিল। বেশিদিন চলেনি। নিরুপায় হয়ে দুই বছরের মাথায় একটা হোটেলে যাওয়া আসা শুরু করে। ওখানে তিন বছর হয়ে গেলো। নানান জন ওর কাছে আসে ! কেউ বয়সে বড়; কেউ অনেক ছোট। পকেটে ট্যাবলেট নিয়েও কেউ কেউ আসে। তবে নিহাল একেবারেই ভিন্ন। যেদিন রাতে বৃষ্টি হয় কেবল সেদিনই আসে। সারারাত রুপন্তির হাত ধরে জানালার পাশে বসে থাকে; গান গায় আর ময়নার গল্প বলে।

তিন বছর ধরে আকাশে মেঘ করলেই রুপন্তি নীল শাড়ি পরে; খোপায় ফুলের মালা জড়ায়। ময়নার কথা বলার সময় নিহালের চোখে জল দেখে রুপন্তির হিংসা হয়। সে ময়নার মতো হতে চায়। কিন্তু আজ ব্যাতিক্রম হলো। সে সাজেনি। রুপন্তি আর নিহালকে ছাড়াই আজ রাতের নগর জুড়ে বৃষ্টি হবে।

রুপন্তি খেয়াল করলো, নিহালের আইডির পাশে আবার সবুজ বাতি জ্বলে ওঠেছে।

-এতো দেরি করলে কেন? রুপন্তি কিছুটা অস্থির হয়ে প্রশ্নটা করলো
-সরি। ভালো আছো?

কথার মাঝে নিহালের এই কুশল জানতে চাওয়া নতুন কিছু নয়। এই প্রশ্নটার উত্তর যে কেবল হ্যাঁ বা না এর মধ্যে নেই সেটা রুপন্তি ভালো করেই বুঝে। সে একটু ডিটেইলে জবাব দেয়;

-একমাস আগে পাঁচদিনের ছুটিতে গ্রামে আসছিলাম। আমি বাড়ি থেকে দশ মিনিটের হাটা দূরত্বে তখন। আচমকা অপহৃত হলাম। পাড়ার এক বখাটে ছেলে আমাকে অস্ত্রের মুখে রেইপ করে। ওসব নিয়েই ঘণ্টাখানেক আগে বাড়িতে দরবার হলো।

-কোন সিদ্ধান্ত হলো কি?

-জানাজানি হবার আগে রজত ওর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে আমাকে ভয় দেখিয়েছিল। রজত মানে ওই বখাটে ছেলে;যে আমাকে রেইপ করেছে।

পরে গ্রাম্য দরবারে টাকা দিয়ে মিটমাটের চেষ্টা করা হয়। আমি কোনটাই মানিনি। এক পর্যায়ে রজতের পিতা বিয়ে পড়ানোর প্রস্তাব দেয়। সে প্রভাবশালী এক নেতার চেলা। প্রথম দিকে আমার বাবা মা নারাজ থাকলেও এখন রাজি। মামলা উঠিয়ে নিতে বলে। বিয়ের প্রস্তাব হয়তো ওদের একটা চাল। আন্তরিক প্রস্তাব হলেও আমি রাজি নই। আমি চাই ওর শাস্তি হোক।

রুপন্তির সম্মতি নিয়ে নিহাল ভিডিও কল দিলো। সবকথা তো লিখে প্রকাশ করা যায়না!

– আজ দরবারে তুমি ওই পক্ষকে কি বলেছো?
থুতনির নিচে হাত রেখে নিহাল রুপন্তির দিকে তাকিয়ে আছে

-সোজা “না” বলে দিয়েছি। কেন রাজি হবো তুমিই বল?

প্রশ্নটা করেই নিহালকে রুপন্তি লাইনে অপেক্ষা করতে বলে। রজতের পক্ষের লোকজন আসছে। হয়তো জরুরি কিছু।

মানুষগুলোর সাথে কথা বলতে রুপন্তি বাইরে গেলো। নিহাল ওকে নাদেখলেও ওদের কথোপকথন শুনছে। রুপন্তি প্রথমে ধীরে শান্তভাবে কথা বলে। পরে উত্তেজিত হয়ে যায়।

“মৃতের মতো শুয়েছিলাম। শরীর মেলে দিতে হয়েছিল। না দিলে তুই তো আমাকে মেরেই ফেলতি। তুই মার্ডরার, রেপিস্ট এবং —এবং— !
এই খাটাস, সব বলবো তুই আর কি কি?”

রেপিস্টকে রুপন্তি শাসাচ্ছিলো। সে লোকগুলিকে এক রকমের দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়ে নিহালের সাথে যোগ দিলো।

-পুরো পরিবারটাই খারাপ ! শুনেছি ওর বাবাও একই রকম। রুপন্তি আবার কথা শুরু করলো

-বুঝে শুনে ঠান্ডা মাথায় ওদেরকে হ্যান্ডল করো। নিহাল পরামর্শ দিলো

-হুম;আমার একার লড়াই
-ওই রেপিস্ট একজন সম্ভাব্য মার্ডারার; এবং সে আর কি সেটা বলতে যেয়েও বললেনা। তোমার ওই নাবলা কথাটা আমি জানি!

-কি?

-নপুংসক !

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১২ টি মন্তব্য (লেখকের ৬টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১০-০৯-২০১৮ | ২২:৩৪ |

    অনেকটা দেরি হলো আমি জানি। গল্পটি প্রথম প্রকাশেই পড়ে নিয়েছিলাম। কেবল অপেক্ষা ছিলো আমাদের এই শব্দনীড়ে যারা নিয়মিত ব্লগিং এবং মন্তব্যে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চলেছেন; তাদের আগমন কখন ঘটবে। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। অপেক্ষার অবসান হয়নি।  

    দুঃখজনক যে তেমনটা ঘটেনি। পোস্ট দেবার অবসর আমাদের মেলে; সতীর্থের লেখায় আগ্রহ নেই। যাকগে। গল্পটিকে আমি রিয়েলি ক্লাসিক বলবো। অবশ্যি সামান্য পরিধি বাড়ানো গেলে আমার মতো সাধারণ পাঠকের জন্য ভালো হতো। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মিড ডে ডেজারট : ১০-০৯-২০১৮ | ২৩:১৮ |

      পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে আপনার মন্তব্যের সাথে আমি শতভাগ একমত। লেখালেখিতে আমি একটু অস্থির টাইপের। গল্পকার কিছু কথা লিখে প্রকাশ করেন এবং তার নালিখা অংশেও পাঠক অনেক কিছু পড়েন যেখানে মূলত বহুস্বরতা থাকে (এইটা নয় ঐটা; ঐটাও নয় ভিন্ন কোন কিছু)।

      কিন্তু গল্পকার যেটুকু লিখে প্রকাশ করেন তা যেন পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়। এজন্য গল্পের আশপাশটা ডিটেইলআপ করা জরুরি। এই জায়গাটাতেই আমার বড় ঘাটতি (যা আপনি বলেছেন ধারণা করছি)। ঐ যে বললাম, এটা আমার অস্থিরতার কারণে হয়।

      অসাধারন গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য অনেক  ধন্যবাদ মিঃ মুরুব্বী! 

      GD Star Rating
      loading...
  2. শংকর দেবনাথ : ১০-০৯-২০১৮ | ২৩:১৭ |

    দারুণ স্মাূর্ট গদ্য। ভাল লাগল

    GD Star Rating
    loading...
    • মিড ডে ডেজারট : ১০-০৯-২০১৮ | ২৩:২১ |

      মন্তব্যে মুগ্ধ হয়েছি প্রিয় কবি!

      অনেক ধন্যবাদ!

      GD Star Rating
      loading...
  3. রিয়া রিয়া : ১০-০৯-২০১৮ | ২৩:১৭ |

    রুপন্তির জন্য মায়া হলো দাদা। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • মিড ডে ডেজারট : ১০-০৯-২০১৮ | ২৩:২৮ |

      আমার এক বন্ধু (বিজি মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার) যে সাহিতের ধারে কাছে থাকেনা।  গল্পটা আমার ওয়ালে পড়ে ফোন দিয়ে আপনার এই কথাটাই বলেছে দিদি। 

      বন্ধুটিকে জবাবে বলেছিলাম, "যারা মার্ডার করে, রেপ করা তারা সাইকোপ্যাথ সেটা তুমি জানো। ইন এডিসন আমি এই গল্পে বলতে চেয়েছি, রেপিস্টরা নপুংসক"।

      আপনাকে অনেক ধন্যবাদ দিদি।   

      GD Star Rating
      loading...
  4. ইলহাম : ১১-০৯-২০১৮ | ২:০৮ |

     খুব ভালো লিখেছেন প্রিয় লেখক মিঃ মিড ডে ডেজারটhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

     বেশ কিছু ভালো গল্প এবং কবিতা  আসছে! মুগ্ধ হয়ে পড়ছি! খুব ভালো সময় কাটছে।

    GD Star Rating
    loading...
    • মিড ডে ডেজারট : ১১-০৯-২০১৮ | ২১:০৮ |

      আপনার মন্তব্য পড়ে উঠে দাঁড়ালাম। একটু হাঁটলাম; আয়না ঘরে নিজেকে দেখতে গিয়ে ফিরে এলাম।  সিদ্ধান্ত নিলাম, আপনি যা বলেছেন তাইই সত্যি। কারণ অন্তরে আনন্দ অনুভব করছি।

      মন্তব্যে মুগ্ধ হয়েছি। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।  

      GD Star Rating
      loading...
  5. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১১-০৯-২০১৮ | ৬:২৮ |

    আপনার অন্যান্য লিখাও আমি পড়েছি। শব্দের যে পরিমিতি বোধ সেটা আপনার মধ্যে আছে। গল্প গল্পই। শুভেচ্ছা নিন।

    GD Star Rating
    loading...
    • মিড ডে ডেজারট : ১১-০৯-২০১৮ | ২১:১১ |

      দারুণ একটা কমপ্লিমেন্ট (পরিমিতিবোধ) পেলাম!

      ভীষণ আনন্দিত হয়েছি।

      আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ!

      GD Star Rating
      loading...
  6. শাকিলা তুবা : ১১-০৯-২০১৮ | ৯:০৪ |

    বক্তব্যকে সুন্দর প্রকাশ করতে পেরেছেন।

    GD Star Rating
    loading...
    • মিড ডে ডেজারট : ১১-০৯-২০১৮ | ২১:১৩ |

      আপনার মন্তব্যে খুব খুশি হয়েছি!

      GD Star Rating
      loading...