কেনিয়া, ১ আগস্ট ২০১৮; লোকাল টাইম ০০:০১ মিনিট।
-কারিবু। নোরিনের চিবুকে হালকা স্পর্শ দিয়ে আদনান নাভিদ গ্রিট করলো।
-আসান্তে সানা। ঘুম ঘুম কন্ঠে সুতপা নোরিন জবাব দিলো
বিয়ে বার্ষিকী; তাই নোরিনকে নাভিদ ওদেশের ভাষা সোহাইলিতে স্বাগত জানিয়েছে। একই ভাষায় উত্তরটাও নোরিনের জানা ছিল।
গত ২৬ জুলাই এর পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা এখন লডোয়াতে; কেনিয়ার রিফটভ্যালি প্রোভিন্সের একটা কাউন্টি হেড কোয়ার্টার। ডায়োসিস অব লডোয়ার গেস্ট হাউজে।
চিবুক ছুঁয়ে দিয়েই নাভিদ মিটমিটি হাসছিল।
-তোমার মতলবটা কি? নোরিন প্রশ্ন করলো
-জলে জোছনা মিশাবো। আবার দুষ্টু-হেসে নাভিদ জবাব দিল
-গল্প বল; এদেশের গল্প
ফ্রিজ থেকে আধা লিটারের একটা বোতল খুলে নাভিদ এক ঢোক জল খেয়ে নিলো।
-এখানে লোমিয়া নামে একটা কাউন্টি আছে। সকালের নাস্তা সেরেই লোমিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেব
-লোমিয়ায় কেন? নোরিন জানতে চাইলো
-এদেশে চাকরীকালীন সময়ে নাইরোবি থেকে বহুবার এখানে এসেছি। তখন একবার লোমিয়ার একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমাদের এই বার্ষিকীতে ওখানে যেতে চাই। নানান দেশে নানান রকমের বিয়ের সংস্কৃতি রয়েছে। সবগুলো থেকে তোমার-আমারটা যে প্রকৃতই ভিন্ন সেটা দুজন একসাথে অনুভব করতে চাই।
-আমার অমত নেই। তোমার সেই লোমিয়া ভ্রমণের অনুভূতি শেয়ার কর।
-লোমিয়ার এই নৃ-গোষ্ঠিটি মোটা দাগে টুরকান। সেবার এখান থেকে আড়াই ঘন্টা ট্রাভেল করে ওখানে গিয়েছিলাম; নিরাপত্তা বাহিনীর সবল প্রস্তুতি নিয়ে। শেষের দশ পনের মিনিটের পথ ছিল বিয়ের আয়োজন স্থলের ভিতর। উঁচু নিচু ঝোপ জঙ্গল; হঠাৎ হঠাৎ যেনো মাটি ফুঁড়ে সারিবাঁধা নারীরা হেলেদুলে নেচেগেয়ে গাড়ির সামনে এসে থেমে যেতো।
এর কয়েক মিনিট পর একটা লাঘার পাড়ে উপস্থিত হতেই ৩০-৪০ জনের একটা গ্রুপ আমার গাড়ির দিকে একে-৪৭ তাক করলো। বলে নেই, মরু ভূমিতে মরা নদিকে লাঘা বলে।
-মরু ভূমিতে নদি? নোরিন বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো
-উজানে উগান্ডা। ওখানে বৃষ্টি নামলে তা ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাডের রুপ নিয়ে এই মরুভূমির নির্দিষ্ট কিছু জায়গা দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেই জায়গাগুলো দেখতে মরা নদির মতোই।
-লাঘায় ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড দেখেছ?
-হ্যা; এবং সেটা হৃদয় বিদারক ছিল। অন্য একদিন সেই গল্প বলবো। এখন লোমিয়ার কথা শুনো
-ওকে; গো এহেড
-কিন্তু তার আগে কিছু বিনিময় চাই।
বেগতিক বুঝে নোরিন ওর মুখ নাভিদের বুকে লুকিয়ে ফেললো। এর অল্প কিছুক্ষণ পর ওরা বারান্দায় গেলো। পাহাড়ের ওপর গেষ্ট হাউজটা। জোছনায় বেশ দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। মধ্যরাতে নোরিন যেন একটা মরুভূমি শহরের বিলাপ অনুভব করছিল।
-জলে জোছনা না মিশালে আজ এই রাত খুব অভিমানী হবে। বলেই নাভিদ আবার মুচকি হাসলো।
স্বভাবসুলভ ভাবে নাভিদের বুকে নোরিন একটা কিল বসিয়ে দিল। এটা না পেলে নাভিদের বাম বুকের “লাব-ডাব” শব্দ মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে যায়; তাই সে এই কিলটার প্রতীক্ষায় থাকে।
-গল্পটা বল। সকালে উঠতে হবে। নোরিন তাড়া দিল
-ওই রকম বন্দুকের মুখোমুখি আগেও বেশ কবার হয়েছি। তাই লোমিয়ায় তখন ভয় পাইনি। এর কিছু কারণও আছে। রিফ্টভ্যালির কোন টুরকানা কাউন্টিতেই সরকারের কার্যকর উপস্থিতি ছিলনা। আগেই বলেছি, বিরাশিভাগ মানুষ যাযাবর। পশুপালন ছাড়া ওদের জীবন নির্বাহের তেমন কোন বিকল্প নেই। আয়তনে প্রায় আমাদের দেশের সমান এই বিশাল এলাকায় খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা ইউএন এর ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। তাই ইউএন এর সাইন বা লগোযুক্ত গাড়ি বা কিছু দেখলে ওরা ভালো আচরণ করে।
-গুলি করেনি?
-না। আমার নিরাপত্তা বাহিনির প্রধানের নাম ছিল জন। সে অনেকগুলো ভাষা জানতো। জন ওর গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে গিয়ে ওদের সাথে মিনিট দুয়েক কথা বলার পর চিত্রটা পুরো বদলে গেলো
-সেটা কি?
-ওদের গোত্রীয় প্রধান এসে আমাকে নিয়ে গেল। আমার সাথে জিম্বাবুয়ে এবং কেনিয়ার দুই নাগরিক ছিল। ওদেরকে নিয়ে গোত্রীয় প্রধানকে অনুসরণ করতে লাগলাম
-ওই দুই ভিনদেশী নাগরিক পুরুষ না মহিলা?
-বলবোনা;
নাভিদ একটা চাপা হাসি দিলো
-ঠিক আছে; বলোনা। কিন্তু তারপর কি হলো?
-পায়ে হেটে লাঘা পেরিয়ে আমরা একটা জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। সেখানে নানান বয়সী পুরুষ লোক ছিল। সবার হাতে একে-৪৭ । গায়ে যেটুকু আবরণ ছিল তা ওদের মূল কিছু আড়াল করতে পারেনি। একটা কথা সম্ভবত তোমাকে আগেই বলেছিলাম। টুরকানায় যে বৃদ্ধকে লাঠিতে ভর দিয়ে চলার কথা তার হাতেও একে-৪৭ দেখেছি
-পরে জঙ্গলে কি হয়েছিল?
-ওখানে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানটা চলছিল। এখানে সেখানে গরু, ছাগল পুড়ানো হচ্ছিল। আমার উদ্দেশ্যে গোত্র প্রধান মিনিট পাঁচেক কথা বলে ভোজনে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানালো। সে কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেছিল। আফ্রিকার অনেক জায়গাতে একটা কমন কালচার হলো, কোন খাবার অফার করলে সেটা গ্রহণ করতে হয়। জন আমার হয়ে ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। ওটা রমজান মাস ছিল এবং আমি মুসলিম এটা বুঝাতে জনকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
-রমজান মাস না হলে কি করতে?
-আমি আসলে ওদের খাবারে অংশ নিতে বেশ আগ্রহী ছিলাম। যদিও পশুগুলোর চামড়া আধপোড়া ছিল। ওরা নুন মরিচ চিনেনা। রোজা না রাখলে বার্থডে কেকের মতো চামড়াসহ কেটে দেয়া মাংস পিছগুলো আমি সানন্দে খেতাম
-তুমি সর্বোতভাবে জংলী;
কথাটা বলেই নাভিদের ফিনফিনে চুল নোরিন এলোমেলো করে দিল।
-ইন্টারেস্টিং কিছু কথা বলা হয়নি
-কি?
-বর ষাটোর্ধ ছিল; কনে সিক্সটিন। তাই কনেকে যৌতুক হিসেবে বর বেশি পশু দিয়েছিলো। রিপিট করছি, যৌতুক বরেরা দেয়; কখনোই কনে নয়
-ডিটেইল বল
-বর যেইই হোক না কেন প্রেমিক বা ভিখিরি; বিয়েতে ন্যূনতম চার ইউনিট পশু দিতেই হয়। এজন্য অধিকাংশ যুবকই বিয়ের আগে যুদ্ধে যায়। শত্রু নৃগোষ্ঠির পশু জয় করে এনে বিয়ে করে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যায়। বলে রাখি, প্রতি ইউনিটে তিরিশটা পশু থাকে। এর মানে বিয়ে করতে হলে একজন পুরুষের কমপক্ষে ১২০টা পশু থাকতে হবে। এক ইউনিট মানে- এই যেমন ৩০ টা গরুর এক ইউনিট, ৩০ টা ছাগলের এক ইউনিট; এইভাবে মেষ, উট, জেব্রা ইত্যাদির ইউনিট। ওই বিয়েতে বর যেহেতু বেশি বয়সী এবং ধনী ছিল তাই সে ৪ এর অধিক ইউনিট পশু দিয়েছিল। সংখ্যাটা আজ একজাক্টলি মনে নেই।
-বিয়ে করতে যুদ্ধে যায়- এরকম কী যেন বললে?
-হ্যাঁ। রিলেটিভলি ধনীরাই পশু পালন করে। বাকীদের কেউ কেউ তাদের পশু দেখভাল করে। ওরা বিয়ে করবে কেমনে যদি নিজের পশু না থাকে? তাই ওরা পকট এ যুদ্ধে যেতো। পকট এলাকাটা বড় বড় পাহাড় দিয়ে টুরকানা থেকে আলাদা করা।
-ট্রুলি ভেরি ইন্টারেসটিং। নোরিন মন্তব্য করলো
-বিয়ের অনুষ্ঠানটিতে উল্লেখ করার মতো আরও কিছু ঘটনা ঘটেছিলো। আধাকাঁচা চামড়ায় তৈরি বরের পোশাকটা আমি পরেছিলাম।
-কোনদিন ছবি দেখাওনি তো!
-কেনিয়ার পর উগান্ডায় চাকরি করতাম। কামপালায় থাকতাম। শেষের দিকে একদিন আমার লেপটপ্টা ক্র্যাশ করে। ওখানে কেনিয়া এবং উগান্ডায় তোলা সব ছবি ছিল।
– বিগ লস
– রিয়াক্ট না করলে তোমাকে একটা কথা বলবো
-বলো
-আফ্রিকানরা রোমান্টিক হয়না। ইস্ট আফ্রিকার দেশগুলিতে দীর্ঘ সময় থেকে এই সত্যটা বেশ বুঝেছি। তবে আমার দিকে লোমিয়ার ওই কনের মিটমিট-তাকিয়ে থাকা দেখে ভাবছিলাম, আফ্রিকান রমণীরা সেদিনই প্রথম রোমান্টিক হয়েছে!
-তো?
-অথচ এই আমার সাথে এমন মধুরাতেও তুমি কেমন কৃপণ!
নাভিদের ধনুকের মতো বাঁকা ঠোঁটটা চেপে ধরে নোরিন “গৃহে” প্রবেশ করল। আজ সে নিজেই মুলবাতি নিভিয়ে নীলটা জ্বালিয়ে দিলো।
ঈশ্বব্রের ডায়েরিতে অবশ্য স্পষ্ট লিখা আছে, জগৎ সৃষ্টির পর কোন এক পহেলা আগস্টে মরুভূমিতে একবার বৃষ্টি নামবে।
ঈশ্বরের কী কখনো ভুল হয়?!
পরিশেষ জানিনা ঈশ্বরের ভুল হয়েছিলো কিনা তবে নাভিদ- নোরিনের গল্প-ভ্রমণে যে একটি মহাদেশীয় জাতির ঐতিহ্য সংস্কৃতি উঠে এসেছে তাতে করে আমার মতো ঘরোয়া পাঠকের তৃতীয় নয়ন খুলে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। মুগ্ধ হলাম মি. ডেজারট।
বহু কারণে রিফটভ্যালির টুরকানা আলোচিত। সেসবের মধ্যে ওখানকার আদি মানুষ এবং তাদের ডাইভারসড-কালচার কাউকে কাউকে খুব আকৃষ্ট করে।
যাহোক, আপনার দামি মন্তব্যে ভীষণ আনন্দিত হয়েছি। অশেষ ধন্যবাদ জনাব মুরুব্বী!
সত্যসত্যিই এই ধারাবাহিকের সমতা বা সামন্জস্য আপনি দ্বিতীয় পর্বে এসেও ধরে রাখতে পেরেছেন। ভীষণ ভলো লাগছে ভ্রমণ গল্পটির পাঠক যুক্ত হতে পেরে।
মন্তব্যে মুগ্ধ হয়েছি।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ!
স্বাগত ধন্যবাদ আপনাকেয়ো।
* আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে…
শুভ কামনা সবসময়।
আপনার মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি!
শুভেচ্ছা !