মরুভূমি ও পাহাড় পর্বতের দেশে এক খণ্ড প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মণ্ডিত নগরী তায়েফ। ফুল, ফল ও ফসলের সমারোহ সেখানে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের মনের খোরাক ইতিহাস-ঐতিহ্যের নগরীও বটে। পবিত্র মক্কা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফ। এ শহর ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। চমৎকার সাজানো গোছানো একটি শহর। মক্কা থেকে তায়েফের রাস্তাগুলো পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি করা। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে শরীর হিম করা গভীর খাদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এ শহর দেখতে হাজিরা কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখেন।
পাহাড় কেটে বানানো রাস্তাটি একমুখী। অনেক উপরে ওঠার প্রতিক্রিয়ায় গাড়ির ভেতরে নিঃশ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হওয়ার পাশাপাশি, কান বন্ধ হয়ে যায় আপনা-আপনি। তায়েফের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায়, ঝক্ঝকে নীল আকাশ। মরুর দেশে এমন নীল আকাশের কথা চিন্তা করা যায়? পাহাড় দেখে মানুষ কেন আপ্লুত হয়, সেটা তায়েফের পাহাড় না দেখলে জানা হত না। পাহাড়ের সৌন্দর্য আর আকাশের সত্যিকারের নীল এক সাথে দেখতে হলে তায়েফের আকাশ দেখতে হবে।
ওমরার হাজীগন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এখানে আসতে হয়। তাই আমরা সেভাবেই মাইক্রো ভাড়া করে মক্কা নগরের মিসফালাহর হিজরা মসজিদ এর সামনে থেকে রওয়ানা দিলাম। মক্কা নগরের নানান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও আধুনিক স্থাপত্য অতিক্রম করে আমাদের গাড়ি চলছে। বিশাল উচ্চতার পাহাড়, তবুও সে সব জায়গায় পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে প্রশস্ত সড়ক ও টানেল। আরো রয়েছে দীর্ঘতম উড়াল সড়ক। সত্যিই অবাক করার মতো দূরদর্শী পরিকল্পনা। কোথাও কোথাও এমনও আছে, কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নেই। শুধুই ধু ধু মরুভূমি। প্রাণীকুলের মধ্যে উট আর দুম্বা। বৃক্ষ বলতে শুধুই বাবলা গাছ। একটা সময় আবহাওয়ার তারতম্যেই বুঝা গেল আমরা তায়েফের কাছাকাছি।
শুরু হলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক। গাড়ি চকচকে পিচঢালা পথ ঘুরে ঘুরে শুধু উপরের দিকেই উঠছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ৬৯ ফুট উচ্চতায় আমাদের উঠতে হচ্ছে। সড়কের পাশে নানা কারুকার্যময় স্থাপনা। আরো রয়েছে বিভিন্ন কটেজ, রিসোর্ট ও শিষাবার। গাড়ির জানালা দিয়ে নিচে ও উপরে তাকালে বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এটিকে তায়েফের রিং রোড বলা হয়ে থাকে। সড়ক দ্বীপে বানরের দল নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ায়। চারপাশে নির্মল সবুজের হাতছানি। যা আমাদের জন্য মায়াবী পথে চমৎকার এক যাত্রা। অপার্থিব ঘোরের মাঝে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তায়েফ শহরে পৌঁছে যাই।
তায়েফ সৌদি আরবের মক্কা প্রদেশের একটি শহর এবং গভর্নরেট। ১,৮৭৯ মি (৬,১৬৫ ফু) উচ্চতায় হেজাজ পর্বতমালার ঢালে অবস্থিত। যেটি নিজেই সারাওয়াত পর্বতমালার অংশ। ২০২০ সালের হিসাব মতে আনুমানিক শহরটির জনসংখ্যা ৬৮৮,৬৯৩ জন যা এটিকে রাজ্যের ৬ষ্ঠ জনবহুল শহর করে তুলেছে।
কুরআনে সূরা আয্-যুখরুফ (৪৩) এর ৩১ নং আয়াতে তায়েফকে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শহরটি ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে কোন এক সময়ে নবী মুহাম্মদ (সা.) পরিদর্শন করেছিলেন এবং বনু ছাকিফ গোত্র বসবাস করেছিল এবং এখনও তাদের বংশধরদেরেরা বসবাস করা হয়েছে। হেজাজের একটি অংশ হিসেবে। শহরটি তার ইতিহাস জুড়ে অনেক ক্ষমতার হস্তান্তর দেখেছে। সর্বশেষটি ১৯২৫ সালে হেজাজের সৌদি বিজয়ের সময় হয়েছিল।
শহরটিকে সৌদি আরবের অনানুষ্ঠানিক গ্রীষ্মকালীন রাজধানী বলা হয়। কারণ এখানে গ্রীষ্মকালে একটি মাঝারি আবহাওয়া বিরাজ করে। আরব উপদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চল থেকে এখানে ভিন্ন। শহরটির অনেক পাহাড়ি রিসর্ট এবং মাঝারি জলবায়ুর কারণে পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা রয়েছে। আইকনিক হাইওয়ে ১৫ (তাইফ-আল-হাদা রোড) এর মাধ্যমে নিকটবর্তী অবলম্বন শহর আল-হাদার সাথে শহরটি সংযুক্ত। এটি হেজাজ অঞ্চলের বাকি অংশ থেকে আলাদা কারণ এটি একটি শহর যা সৌদি আরবের কৃষি উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং আঙ্গুর, ডালিম, ডুমুর, গোলাপ এবং মধু চাষের জন্য পরিচিত একটি কৃষি অঞ্চলের কেন্দ্রস্থল। ঐতিহ্যবাহী ‘ ইত্তার ‘ তৈরিতেও খুব সক্রিয় এবং স্থানীয়ভাবে তায়েফ গোলাপের শহর নামে পরিচিত। তায়েফ ঐতিহাসিক সওক ওকাজও আয়োজন করে। রাস্তার পাশেই বিশাল ফলের মার্কেট আমাদের নজরে পড়ল।
তায়েফ গভর্নরেট ১৫টি ছোট পৌরসভায় বিভক্ত যার রাজধানী তায়েফ। শহরের প্রশাসন উত্তর তায়েফ, পশ্চিম তায়েফ, পূর্ব তায়েফ, দক্ষিণ তায়েফ এবং নিউ তায়েফ নামে ৫টি পৌরসভা দ্বারা পরিচালিত হয়।
তায়েফ আরবি শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ পরিভ্রমণকারী, বিচরণকারী বা প্রদক্ষিণ এবং তা কাবার প্রদক্ষিণ প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়। বনু সাকিফ গোত্রের দ্বারা নির্মিত প্রাচীর যা শহরটি প্রদক্ষিণ করে আছে। সংক্ষেপে তায়েফ নগরীর আক্ষরিক অর্থ হল ঘেরা শহর।
দেখতে দেখতে গভীর অনুভূতিতে চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। কোলাহলহীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর। সড়কের পাশেই পার্ক, যেখানে সবুজের সমারোহ। আমাদের গাড়ি থামায় একটি বিশাল আকারের গেইটের সামনে। এটা হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: মসজিদ। এটিই তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ। খুবই দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ। এর পাশেই প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: চির শায়িত অছেন। এখানে আমরা দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করি। মসজিদের ভিতরে ঠান্ডা পানি ও খেজুর খেলাম। বাহিরে এসে ফটো তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই।
প্রাচীনকাল থেকে মক্কা ও তায়েফবাসীর মাঝে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। হজরত আব্বাস (রা.) তায়েফের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। পরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)ও তায়েফের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যান। এখানে আরও অনেক সাহাবির কবর রয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন একটি লাইব্রেরি আছে। সেটা অবশ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। তবে সেখানে প্রাচীন অনেক কিতাবের সংগ্রহ আছে। রয়েছে হজরত আব্বাস (রা.)-এর হাতের লেখা কোরআনের কপিসহ বিভিন্ন সময়ে পাথর ও কাগজে লিখিত কোরআনের প্রাচীন কপি।
এরপর গাড়ি আবারো এগিয়ে যায়। ড্রাইভার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দক্ষ গাইডের মতোই আন্তরিকতার সাথে পরিচিতি করাতে লাগলেন।
একে একে দেখলাম হজরত আলী রা: মসজিদ। প্যাঁচানো সিঁড়ির দেয়ালের কারুকার্য, যা দেখে পর্যটকেরা অবাক না হয়ে পারে না। শত শত বছর আগের নীর্মাণশৈলী মনকে ভাবুক করে তোলে। তারপর মসজিদে আদম (আ.)। আঙ্গুরের বাগানের পাশেই মসজিদটি। এরপর কথিত বুড়ির বাড়ি। জায়গাটি পাথর দিয়ে ঘেরা। তার পাশেই বড় বড় দু’টি পাথর। ছোট্ট পাথর দ্বারা আটকে আছে। হুজুর সা:-কে হত্যার উদ্দেশ্যে পাহাড় থেকে এই পাথরগুলো বুড়ি ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ পাকের কুদরতের মাধ্যমে তা প্রতিহত হয়। যা আজো সেভাবেই রয়েছে। পাহাড়ের পাদশেই রয়েছে হুজুর সা: মসজিদ। সঙ্গীরা কেউ কেউ মসজিদে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করল।
ইতিহাসের পাতায় তায়েফ আরও নানা কারণে আলোচিত। এই তায়েফের বনি সাকিফ গোত্রে নবী করিম (সা.) দুধমাতা হজরত হালিমা সাদিয়ার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। এখন সেই বাড়ি-ঘরের কোনো চিহ্ন নেই। তারপরও একটি পাহাড়ের পাদদেশকে অনেকে হালিমার বাড়ি বলে সেখানে যেয়ে নামাজ পড়েন। পাশের পাহাড়টিতে নবী করিম (সা.) বকরি চড়িয়েছেন বলে মনে করে সেখান থেকে মাটি আনা, সেখানে যেয়ে গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করেন লোকজন। সাম্প্রতিত বছরগুলোতে খুব বেশি ভিড় বেড়ে যাওয়ায় গত দুই বছর ধরে সেখানে যাওয়া বন্ধ।
তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে নবীকে অত্যাচার ও নিগ্রহ করেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় নবী করিম (সা.) যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে নাম মসজিদে আদ্দাস। আমাদের গাড়ি আরো সামনে আগাতে থাকে। ড্রাইভার গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে কথাও চালিয়ে যাচ্ছে। ‘এখানের মরুভূমি যেন মরূদ্যানে রূপান্তরিত হয়েছে। ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’রাই সেই পাহাড়ের উপত্যকায় খণ্ড খণ্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মরু উপত্যকার বিভিন্ন এলাকা আজ সবুজে সবুজময়। কোথাও উপত্যকার সমতলে, কোথাও আবার একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় চাষাবাদ হচ্ছে বাংলাদেশের শাকসবজি এবং ফলমূল। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, গাজর, মূলা, বেগুন, পটল, খিরা আর ধনেপাতা। মাচার নিচে ঝুলে আছে চালকুমড়া, লাউ, ঝিঙার মতো লতানো সবজি। বাংলাদেশি কৃষকের উৎপাদিত শাক-সবজি চলে যাচ্ছে মক্কা থেকে জেদ্দা পর্যন্ত নানান শহরে।’ ড্রাইভার যে বিভিন্ন সময় এখানে আসে তার এক ভাইও এখানে থাকে সেই গল্পের গতিতে ঘুরতে থাকে গাড়ির চাকা ও তার হাতের স্টেয়ারিং।
তাপমাত্রা মক্কায় যখন ৪০-৪২ তখন তায়েফে মাত্র ২৫-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তায়েফ শহরে রয়েছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি করা চমৎকার সব রিসোর্ট, পার্ক আর অবকাশ যাপন কেন্দ্র। পর্যটকদের আনন্দ দিতে রয়েছে পাহাড়ে ক্যাবল কারের ব্যবস্থা।
যে দিকে চোখ যায় দু’পাশে সবুজ বনানী, ফসলের ক্ষেত আর নানা আধুনিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।
তায়েফের ঐতিহাসিক স্থাপত্যে মুগ্ধ হয়ে ইতিহাসবিষয়ক স্কলার মোনা উসাইরি বলেছেন, ‘তায়েফের এ পাথুরে স্থাপত্যগুলোর ভেতরে ও বাইরের রঙিন নকশাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুরুষরা যখন দুর্গের নির্মাণ কাজে ব্যস্ত থাকত, নারীরা দুর্গের ভেতরে ও বাইরে তখন নকশার কাজগুলো করত। দুর্গগুলোর দেয়ালে বিভিন্ন রঙিন নকশা তাদের কারু কর্মেরই প্রতিচ্ছবি। তায়েফের এ দুর্গগুলো আমার মন শীতল করেছে। ইতিহাসপ্রেমী যে কোনো পর্যটকের জন্যই তায়েফের এ ঐতিহাসিক প্রাচীন দুর্গ গুলো দর্শন করা উচিত বলে আমি মনে করছি।
আমরা মিকাত জিল মাহরাম থেকে উমরার নিয়ত করে দ্বিতীয় বারের মত ইহরাম পরিধান করে মক্কায় ফিরলাম । সেই সঙ্গে মনে আফসোস থেকে গেল, যদি আরো কিছুটা সময় থাকা যেত! এক দেখাতে কি আর মন ভরে। শুধু স্মৃতিপটে ভাল লাগার দাগ কেটে যায় আর কল্পনায় শ্রদ্ধাভরে ভেসে আসে প্রিয় নবী (স.) এর ত্যাগ ও কষ্টের দিনগুলোর কথা।
মোঃ সুমন মিয়া,
লেখক: গহীনে শব্দ (কাব্যগ্রন্থ)
সম্পাদক, চান্দিনা দর্পণ।
loading...
loading...
প্রাকৃতিক ও পার্বত্য সৌন্দর্যের শহর তায়েফ শীর্ষক ভ্রমণ কাহিনী পড়লাম। আমি মুগ্ধ। ভ্রমণের এই কথা গুলোন পড়লে যে কোন পাঠকের জ্ঞান সমৃদ্ধ হতে সহায়ক।
আশা করবো ভ্রমণ বা প্রবাসের কথা গুলোন নিয়মিত ভাবে শব্দনীড়ে শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ।
loading...
Thank you Sir for your compliment.
loading...
আপনি কী সৌদিতে ভ্রমণ ভিসায় গিয়েছেন
loading...
Umrah Visa…13/05/2022 to 26/05/2022
loading...