আরব সাগরের শুভ্র ঢেউয়ে কিছু সময়

ala

সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত তিহামাহ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর জেদ্দা। এটি মক্কা প্রদেশের সর্ববৃহৎ ও সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। লোহিত সাগরের উপর অবস্থিত সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর এই শহরেই অবস্থিত। ৪৩ লক্ষ জনসংখ্যা নিয়ে শহরটি সৌদি আরবের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র।

জেদ্দা হল মুসলিম উম্মাহর জন্য পবিত্রতম নগরী মক্কা ও মদিনা শহরের অন্যতম প্রবেশদ্বার। অর্থনৈতিক ভাবে জেদ্দা সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে তথ্য প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রাচ্যের লোকদের বিশ্বাস অনুসারে, ইভের সমাধি অর্থাৎ মা হাওয়া (আঃ) এর কবর, যাকে মানবতার আদি মাতা বলে মনে করা হয়। ১৯৭৫ সালে কিছু মুসলমান সেখানে প্রার্থনা করার কারণে সমাধিটি কংক্রিট দিয়ে সিল করে দেওয়া হয়েছিল।

বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩০ সালের দিকে তার বিশ্ব ভ্রমণের সময় জেদ্দা পরিদর্শন করেন। তিনি তার ডায়রিতে শহরের নাম “জিদ্দা” লিখেছিলেন। ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস এবং ব্রিটিশ সরকারের অন্যান্য শাখাগুলি পূর্বে “জেদ্দা” এর পুরানো বানান ব্যবহার করত, অন্যান্য ইংরেজি-ভাষী ব্যবহারের বিপরীতে, কিন্তু ২০০৭ সালে, এটি “জেদ্দা” বানান পরিবর্তিত হয়। টি.ই. লরেন্স মনে করেছিলেন যে ইংরেজিতে আরবি নামের যে কোনো প্রতিলিপি ইচ্ছাকৃত। তার বই, রেভল্ট ইন দ্য ডেজার্ট, জেদ্দা প্রথম পৃষ্ঠায় তিনটি ভিন্ন উপায়ে বানান করা হয়েছে। সরকারী সৌদি মানচিত্র এবং নথিতে, শহরের নাম “জেদ্দা” প্রতিলিপি করা হয়।

ওমরাহ্ শেষ করে আমরা আরব সাগর দেখার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে জেদ্দা রওয়ানা দিলাম। একটি ট্যাক্সি ভাড়া নিলাম বাঙালী ড্রাইভার দেখে। বাড়ি কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম। পাঁচ বছর হলো এখানে সে এই পেশায় নিয়োজিত। এখানকার রাস্তাঘাট তার পরিচিত এবং এদেশের ভাষা ও আইন কানুন সম্পর্কেও ভাল অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছে। এখনও বিয়ে করেনি। এবার ছুটিতে গেলে বিয়ে করবে। আমরা তার ও তার পরিবারের গল্প শুনতে শুনতে সুউচ্চ দালান কোঠা, ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য, সুদৃশ্য মনোরম আইল্যান্ড দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। একসময় দেখতে পেলাম ‘হাওয়া গেট’। তেমন কোন কারুকার্য নেই অথচ হালকা হলুদ রঙের হাওয়া গেট দেখতে অপরূপ। আদি মাতা হাওয়া (আঃ) এখান দিয়েই নাকি প্রবেশ করেছিলেন মক্কা নগরে। সেই স্মৃতিতে হাওয়া গেট। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পাওয়া গেল মা হাওয়া (আঃ) এর কবরস্থান। মা হাওয়া (আঃ) এর কবর জিয়ারত করলাম।

হাল্কা বিরতি নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। ড্রাইভার বয়সে নবীন হলেও তার চিন্তা ভাবনায় গভীরতা আছে। নানা বিষয়ে সে কথা বলছে। বিভিন্ন পর্যটন এলাকা, এই দেশে ইসলামী রীতিনীতি, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজীদের ইতিকথা সহ অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে বাংলা ভাষাভাষী লোকজন পেলেই প্রাণ উজার করে গল্প করে। এই দেশে বাংলাদেশীদের অবস্থান, সৌদিদের বাংলাদেশীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, মাইগ্রেশন ও এ্যাম্বাসীর কার্যক্রম, এদেশে শ্রমিকদের অবস্থা সহ নানা বিষয়ে আমাদের সাথে গল্প আড্ডায় যোগ দিল। সে ভাল একজন গাইড হিসাবেও কাজ করছে। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন হোটেল, পার্ক, হেরেম শরীফ, রাস্তায় পরিচ্ছন্ন কর্মী ও এই গরম উচ্চ তাপমাত্রায় কনস্ট্রাকশন থেকে শুরু করে সকল প্রকার নিচু পোষ্টে এমন কোন কাজ নেই যে বাঙালিরা করে না। কথার ফাঁকে এক সময় বললো বাংলাদেশ থেকে মেয়েরা যাতে এদেশে গৃহকর্মী হয়ে না আসে সেজন্য তারা মিটিং-মিছিল করেছে। কারণ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, মিসরের অবস্থা হলে বাংলাদেশের মান থাকবে না।

কারুকার্যময় সব স্থাপনা আরবদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আমলের দ্রব্যাদি সড়কদ্বীপের মাঝখানে সুদৃশ্যভাবে সাজানো আছে। সুরাই, চিকন কাঁধ যুক্ত মোটা পেটের হাঁড়ি কাত হয়ে শুয়ে যেন আরাম করছে। মহাসড়কের দু’দিকেই মনোরম দৃশ্যরাজি। কোনটার চেয়ে কোনটা কম নয়। একটি টানেল পাড় হতে হলো। ইসলামিক ঐতিহ্যের কৌনিক আর্টে সাজানো দু’পাশের দেয়াল। ওভার ব্রীজ গুলোতে আলো জমকালো আরবি অক্ষরে বিভিন্ন বাণী লেখা থাকে।

সাজানো গোছানো প্রশস্ত রাস্তাঘাট, ওভারপাস ও রাসুল (সঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত এই পবিত্রভূমি; ভাবতেই অবারিত মুগ্ধতায় চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠছে। গাড়ি থেকে দৃষ্টি বাহিরে যেতেই একটি দৃশ্য খুবই অপূর্ব লাগলো। সৌদি আরবের বিশাল আকৃতির জাতীয় পতাকা বাতাসে ঢেউ খেলে উড়ছে। মধ্যখানে যে তরবারি ওটি বাতাসের দোলে এমন দেখাচ্ছ যেন সাগরের কোন অচেনা প্রাণী সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে। কানে এলো সাগরের গর্জন আর বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ। মক্কার তুলনায় এখানের তাপমাত্রা অনেকটা কম। জানালার গ্লাসটা নামিয়ে দিলাম।

চলতে চলতে সামনে যেতে হাতের বামে চোখে পড়লো সাগর। এটিই সেই আরব সাগর। যার কথা শুনেছি গানে, গল্পে, কবিতায়। মরমী কবি লিখেছেন ‘আরব-সাগর-পাড়ি-দেব-নাইকো-আমার-কড়ি, পাখি-নইক-উড়ে-যাবো-ডানাতে-ভর-করি।’ কাজী নজরুল ইসলাম আরব সাগরের মনোহরণ বর্ণনা দিয়েছেন ‘বাঁধন হারা’ পত্রউপন্যাসে। ‘তোমার পানির সাথে লইয়া যাও রে আমার চোখের পানি, লইয়া যাওরে এই নিরাশার দীর্ঘ নিশ্বাস খানি।’ অনুরোধ কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম ।

আরব সাগরের জেদ্দা পাড়ও গাছপালা শূন্য। ভেবেছিলাম আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর মত বালুকাময় হবে কিংবা বিস্তৃত কোন খোলা জায়গায় ঢেউ এসে আচড়ে পড়বে পায়ের কাছে। আবেগে নেমে পড়ব ঢেউয়ের মোহনায় আর উল্লাসে মাতব। আসলে তা নয়। হয়তো ভঙ্গুর সাগর তীরে সেজন্যই বড় বড় পাথর ফেলে আছড়ে পড়া ঢেউ আটকে রাখা হয়েছে। যেখানে সাগর এগিয়ে, পিছিয়ে গেছে সেখানে পাথুরে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ ছিমছাম সাগর তীর দেখতে ভালই লাগে। পাশেই পায়ে হাঁটার পাকা রাস্তা। মাঝে মাঝে আফ্রিকান মহিলারা নানারকম খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসে আছেন। পর্যটকরা হেঁটে হেঁটে পথ পেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ গাড়ি।

মনে হয় সাগর ভরা মাছ। আঁশটে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। পানি কিছুটা কালচে মনে হলেও দুধের মত শুভ্রতা মাথায় মেখে ঢেউ ছুটে এসে তীরে আঘাত করে। ঢেউ-এর সাথে আসে ছোট মাছ, পাথরের উপর উঠে যেন নাচতে থাকে। অপূর্ব যে ঢেউ-এর নাচন-জলকণা উড়ে এসে বৃষ্টির মত ভিজিয়ে দেয় পাথরের উপরে বসে থাকা কাকড়া গুলোকে। পাথরগুলো কালো ও বেশ শেওলা জমে আছে।

এই অনবদ্য দৃশ্য আরো কাছ থেকে অনুভব করতে তীর থেকে সাগরের পানির মধ্যে পিলার দিয়ে রাস্তার মত করা হয়েছে। অনেকে সেখানে দাঁড়িয়ে গায়ে মাখছে সাগর জলের ঝাপটা বাতাস। আমরা নিজেদেরকে উজার করে ভাসিয়ে দিলাম বাতাসে। ফটো সেশন করলাম ফাঁকে ফাঁকে।

কক্সবাজারে সাগরে নেমে আমরা যেমন জলকেলিতে বিভোর হই এখানে তেমন দৃশ্য নেই। যে যার মত বসে বসে আড্ডায় মগ্ন।

সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমরা সাগর তীরে হাঁটছি। সামনে একটি মসজিদ দেখা যাচ্ছে। এ মসজিদও অর্ধেক মাটিতে অর্থাৎ সাগর তীরে বাকি অর্ধেক সাগর বক্ষে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দেখলাম বঙ্গোপসাগরে যেমন রং ছড়াতে ছড়াতে সূর্য ডিমের আকার ধারণ করে সহসা ঝুপ করে ডুব দেয় সাগরে। এখানে রঙের ছড়াছড়ি তেমন নেই। সামান্য হলুদ আভা পানিতে দোল খেলে যায়। জাহাজ নেই, নৌকা নেই, কিছু নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। ঢেউয়ের প্রতিফলন। সাগরপাড়ে এমন চমৎকার সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে যে, তার উপরে হেলিকপ্টার পর্যন্ত নামতে পারে। মাঝে মাঝে সাগরের পানি আটকে কৃত্রিম জলাধার বানানো হয়েছে, সৌন্দর্য বাড়াতে দেয়া হয়েছে বাদশাহজাদির সাজ।

সাগর পাড়ের মসজিদে নামাজ পড়ে বাইরে এসে দেখি আরব সাগর আলোক সজ্জায় সজ্জিত হয়ে রানীর গরিমায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো দিনের চেয়েও তার রাতের রূপ কম না। একেক সাজে একেক সৌন্দর্য্য।
সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে একেবারে ঢালুতে সাগরের কাছাকাছি এক পর্যটক পরিবার বসে আছে, মুগ্ধ নয়নে দেখছে আরব সাগরের অপরূপ রূপ।

রাস্তার পাশেই আল-বাইক; সেখানকার জনপ্রিয় খাবারের রেস্তরা। আমরা সেখান থেকে খাবার মেন্যু দেখে কিছু খাবার নিয়ে পাশেই শানে বাঁধানো টুলে বসলাম। আমাদের সাথে আছে ড্রাইভারও। সে বল্ল আমাদের দেশের মত এখানে পানিতে কেউ নামতে পারে না। আর চারপাশে রেলিং দেওয়ার কারন; এখানে মেয়ে ছেলেরাও পানিতে নেমে পড়বে। উলঙ্গ হবে। তাই পানিতে নামা নিষেধ। ইদানিং ওয়েস্টার্ন কালচারে বেড়ে উঠা সৌদি মেয়েরা আপত্তিকর পোশাকে এখানে আসে। সরকার নারীদের জন্য অনেক আইন শীতিল করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কি যে হয়! আস্তাগ ফিরুল্লাহ্। আল্লাহ ভাল জানেন।

সন্ধা ঘনিয়ে আসছে। এবার ফেরার পালা। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মুগ্ধ দেহ ও মন নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম এবং ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো মক্কার উদ্দেশ্যে। কিসে যেন সুক্ষ্ন পিছুটান অনুভব হলো বুকের কোণে। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। যেতে যেতে দূর থেকে চোখে পড়ল মক্কা টাওয়ারের মায়াবি সবুজ আলো । ধ্রুবতারার মত হাতছানি দিয়ে যেন কাছে ডাকছে। কন্ঠে আনমনেই বেজে উঠছে সেই ধ্বনি- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।

2822a

মোঃ সুমন মিয়া, লেখক- গহীনে শব্দ (কাব্যগ্রন্থ)
সম্পাদক- চান্দিনা দর্পণ।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
আরব সাগরের শুভ্র ঢেউয়ে কিছু সময়, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০১-০৬-২০২২ | ৮:৫২ |

    লিখাটি যথেষ্ঠ তথ্যবহুল এবং একজন পর্যটকের দৃষ্টিতে একটি দেশ কেমন লেগেছে সে বিষয়টি চমৎকার উঠে এসেছে। গুড।

    ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ভ্রমণ কথা-গল্প ভীষণ ভালো লাগে।

    নিয়মিত লিখুন মোঃ সুমন মিয়া। আপনার সহ-ব্লগারদের পোস্টেও আপনার মতামত দিলে ভালো লাগবে। মন্তব্য এবং প্রতি-মন্তব্যে ব্লগিং হোক আনন্দময়। সালাম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মুরুব্বী : ০৪-০৬-২০২২ | ৭:০০ |

      অন্যের লিখায় পাঠক না হওয়া অথবা নিজের লিখায় মন্তব্যের উত্তর না দিলে আমার মনে হয় পাঠক সংখ্যা কমে যায়। Smile

      শুভ সকাল মোঃ সুমন মিয়া। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

      GD Star Rating
      loading...