নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৭

১৫।
দাউদকান্দি ব্রিজের কাছে এসে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ফিল্মের ফিতা ছিঁড়ে গিয়ে রাশেদ সাহেবের সিনেমা দেখা থেমে গেলো। রাশেদ সাহেব চমকে উঠলেন। সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করলেন-

-কি ব্যাপার ভাই কি হয়েছে?
-না কিছু হয়নি সামনে বিরাট কিউ তাই থেমেছে।
মিনিট পনের পর আবার গাড়ি চলতে শুরু করলেই সিনেমার ফিতা আবার জোড়া লেগে যায়।
একটা পরিবার, একটা সংসার, একটা বংশের উন্নতি ঘটানো কারো একার পক্ষে বা এক পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ওরা চার ভাইয়ের মধ্যে রাশেদ সাহেব বাদে সবাই উচ্চ শিক্ষিত। রাশেদ সাহেব পড়াশুনার সুযোগ পেলেন কোথায়? তবুও তার সাথে কথা বলে, তার আচার আচরণ, পোষাক পরিচ্ছদ, চলাফেরা, মানুষের সাথে মেলামেশা দেখে বোঝার উপায় নেই। চমৎকার এক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি। তাদের বাড়ির একটা সুনাম আছে, পড়ালেখা বাড়ি। নিজেদের বাড়ির একটা নামও ঠিক করে রেখেছেন কিন্তু বাড়িটা উপরে উঠার আগে এই নাম বেমানান তাই আর পয়সা খরচ করে নাম লেখা হয়নি। তিনি ভেবেছিলেন তার ব্যবসার উন্নতি হলে আস্তে আস্তে দোতলা, তিন তলা, চারতলা, পাঁচ তলা করে আকাশের একটু কাছে গিয়ে চার ভাই আর এক বোন মিলে এক বাড়িতেই সুখে দুঃখে মিলে মিশে থাকবে, যাতে করে সবাই সবাইকে কাছে পায় এরকম একটা ইচ্ছে ছিলো। সে ইচ্ছে ইচ্ছে পর্যন্তই রয়ে গেলো, এ আর কোন দিন বাস্তব হবে বলে মনে হয় না। আরও কত আশা ছিলো। মনিরা এবং তার নিজের বাগান করার বেশ ঝোঁক।

চাকরির উপলক্ষে যেখানে থেকেছে সেখানেই একটা অস্থায়ী বাগান করে নিয়েছে। তা এই ঢাকা শহরে এতো জায়গা কোথায় পাবে যেখানে দালানকোঠার মাথা উঠে আকাশ ঢেকে ফেলেছে সেখানে বাগানের জায়গা কোথায় তাই ছাদের উপরে টব সাজিয়ে বাগান করবে। দুজনে মিলে এক সাথে পানি দিবে, গাছের যত্ন করবে, টব পরিষ্কার করে নতুন মাটি সার মিশিয়ে আবার নতুন গাছ লাগাবে।

মনিরা এর মধ্যেই ছাদের উপরে একটা ছোট বাগান করেছে যেখানে প্রতিদিন তার নিজের সন্তানদের মত করে ফুল গাছের যত্ন করে। যতক্ষণ বাগানে কাজ করা যায় ততক্ষণ মনে সুন্দর একটা প্রফুল্ল ভাব থাকে। একটা স্বর্গীয় সুবাতাস এসে মনে জমা কালিমাগুলি ঝড়ের মত উড়িয়ে নিয়ে যায়। গাছ গুলি যেন কথা বলে আর ফুল গুলি তো হাসতেই থাকে। আজে বাজে দুশ্চিন্তাগুলি মনে ঢোকার দরজা খুঁজে পায় না। তার আরও স্বপ্ন ছিলো বাড়িটাকে লতায় পাতায় ঘেরা কুঞ্জবন বানাবে। যেখানে থাকবে নানা রঙের বাহার আর মৌ মৌ করা ফুলের গন্ধ। সেবার লন্ডন থেকে দেখে এসেছে কারুকাজ করা অক্ষরে বাড়ির নম্বর লেখা রয়েছে প্রায় বাড়িতে, তেমন করে নক্সা আঁকা বোর্ডের উপর কারুকাজ করা নম্বর প্লেট লাগাবে বাড়ির গেটে।

বিকেলে বা বৃষ্টির সময় সবাই মিলে বারান্দায় বসে চা পিঁয়াজু খেতে খেতে বৃষ্টি দেখবে, নয়তো জোসনা দেখবে, গল্প করবে। এর মধ্যেই সাভার হর্টাস নার্সারি থেকে ওয়াল কার্পেটের চাড়া এনে বাড়ির সীমানা দেয়ালে লাগিয়েছে, একটা বকুল গাছ লাগিয়েছে বাড়ির পিছনে দক্ষিণ পশ্চিম কোনায়, সামনের উত্তর পূর্ব কোনায় লাগিয়েছে একটা স্বর্ণ চাঁপা গাছ। বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ হলে সিঁড়ির এক পাশে একটা মাধবী লতা আর অন্য পাশে হলুদ আলমন্ডা গাছ লাগিয়ে একেবারে ছাঁদ পর্যন্ত উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো।
সামনের দিকে পূর্ব দক্ষিণ কোনায় যে বারান্দায় সবাই মিলে বসবে বলে ভেবে রেখেছে সেই বারান্দার নিচে গ্যারেজের পাশে একটা চামেলি গাছ থাকবে এটাও ছাঁদ পর্যন্ত উঠিয়ে নিতে চেয়েছিলো যাতে সবাই বসলে সারা বছরেই চামেলি বা মাধবী লতার পাগল করা গন্ধে মনে কোন কলুষতা আসতে না পারে। নানা ফুলের গন্ধে পুরো বাড়িটা হয়ে উঠবে একটা স্বপ্নপুরী বা মায়াকুঞ্জ কিংবা কুঞ্জবন।

নাম যেটা ঠিক করে রেখেছে তা হচ্ছে ‘পান্থনীড়’ বাড়িটা তো কয়েক পুরুষ ধরে টিকে থাকবে কিন্তু এ বাড়িতে যারা বাস করবে তারা আর বাড়ির মত ইট বা লোহার তৈরি নয় যে বাড়ির সমান বয়স পাবে। বাড়ির বাসিন্দারা পুরুষানুক্রমে যখন এক এক করে আসবে তখন আনন্দের মেলা বসবে আবার যখন প্রকৃতির ডাকে চলে যাবে তখন তেমনি তার উলটো কান্না কাটির ঝড় বয়ে যাবে। এই যে আসা যাওয়া এই নিয়েই তো সংসার। এই পৃথিবীতে সবাই সংসারের পথিক। ক্ষণকালের জন্য আসবে আবার চলেও যাবে।
যারা এই বাড়িতে থাকবে তারা না জানি কে কি পেশা নিয়ে থাকবে। হয়ত কেও শিক্ষক হবে, কেও ডাক্তার হবে, কেওবা উঁকিল ব্যারিস্টার বা কেও হয়ত নিতান্ত সাধারণ জীবন যাপনই করবে। এরাই হয়ত পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে আবার কোন বিশেষ দিনে প্রিয় জনের সাথে মিলিত হবার আগ্রহে আধির প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করবে। ও আসছে কে কি পছন্দ করে আহা বিদেশে থাকে কি খায় না খায় তার কি কোন ঠিক আছে? কি কি বাজার করতে হবে, কে কে এয়ারপোর্টে যাবে এই আয়োজনে ব্যস্ত থাকবে। যারা আসবে তারাও কার জন্য কি নিয়ে যাবে তাই নিয়ে মাস ধরে কেনা কাটার ধুম চলবে। সবাই এসে একত্র হবে।
বিশাল হৈ চৈ আনন্দ উৎসবে মেতে উঠবে ক্ষণিকের জন্য, আবার সবাই সুখের একটা স্মৃতি নিয়ে আবার তাড়াতাড়ি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন ভার করে যার যার কর্মস্থলে ফিরে যাবে। যারা থাকবে তাদের কাছে কিছু দিন বাড়িটা ফাঁকা মনে হবে। এক সময় আবার তা সয়ে যাবে। সবাই তো পথিক, এটা তো পথিকের ঘর, ক্ষণিকের জন্য আসা আর যাওয়া তাই এর নাম ‘পান্থনীড়’। রাশেদ সাহেবের এই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। এখনও যে তা বাস্তবায়নের কোন আভাস সে খুঁজে পায়নি, আজ চট্টগ্রাম থেকেও তেমন কোন আশার বাণী শুনে আসতে পারেনি।

১৬।
রাশেদ সাহেবের মা হঠাৎ করেই মারা গেলেন। হঠাৎ করেই বলা যায়। বুকে এক ঘা হয়েছিলো যা তিনি নিজে অনুভব করছিলেন কিন্তু কাউকে কিছু বলছিলেন না। যখন ব্যথা সহ্য করতে পারছিলেন না তখন এক দিন বড় বৌকে বললেন। মনিরা দেখে এসে তার স্বামীকে জানালেন। রাশেদ সাহেব শুনেই মায়ের কাছে এসে দেখতে চাইলেন। মা নিরুপায় হয়ে দেখালেন। দেখেই রাশেদ সাহেব বুঝলেন ‘ক্যান্সার’, তার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। মাকে বললেন-
-একি! আপনি কেন একথা এতদিন জানাননি?
মা নির্বাক। কোন কথা বলছেন না।
-কেন চেপে রেখেছেন বলেন।
-কি বলবো, তোর এই অবস্থা দেখছি ভাবলাম দেখি এমনিই হয় তো সেরে যাবে তাই বলিনি।
-আমার অবস্থা দেখে আপনি বলেননি বেশ কিন্তু আপনার তো আরও ছেলে আছে তাদের অবস্থা তো আমার মত নয়।
-ওদের কাছে কি আমি কখনো কিছু বলি?
-তাই বলে এই সর্বনাশ করবেন? জানেন এর ফল কত ভয়ঙ্কর?
মা নিরুত্তর। পরিবেশ নিস্তব্ধ।
রাশেদ সাহেব জানেন মা এক তাকে ছাড়া আর কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না, তাই বলে এর কি কিছুই মা বুঝতে পারেনি? তাকে বললে কি সে কিছুই করতে পারতো না? মায়ের জন্য কি তার কিছুই করার ছিলো না? সে নিজে না পারলেও অন্তত তার ভাইদেরকে তো জানাতে পারত এবং সে জানে ভাইয়েরা চুপ করে বসে থাকতে পারতো না, অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে ত্রুটি করত না।

সব নিয়তি, আজ যদি আমার এ অবস্থা না হোত তা হলে মা কিছুতেই এটা চেপে রাখতে পারতেন না। হায়রে অর্থ! হে মহান অর্থ! ওহে মহান, তুমি এতই উচ্চ শিখরে উঠে বসে আছ? হে সর্ব সমস্যার সমাধান, তোমার কাছে কি আমি এতই তুচ্ছ? তুমি আমাকে ধরা দিলে না, তোমার অভাবে যে আমার মা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে আর আমাদেরকে তাই বসে বসে দেখতে হবে। সময় মত তার চিকিৎসা করাতে পারলাম না। একি তুমি দেখতে পাচ্ছ না? তবুও তোমার এতো অহংকার কেন? হায়রে পলাতক অর্থ, তুমি আমার মায়ের এই সময়েও পালিয়ে রইলে? আমি তোমার সাথে কোন অন্যায় করিনি, কোন অমর্যাদা করিনি, আমি তোমায় দিয়ে জুয়া খেলিনি, আমিতো কোন নেশা করার জন্য তোমায় ব্যবহার করিনি, তোমার কোন অপব্যবহার করিনি। তাহলে কেন আমার থেকে দূরে রইলে? কেন আমার সাথে এই বঞ্চনা?
[চলবে]

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১২ টি মন্তব্য (লেখকের ৬টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩০-১০-২০১৯ | ১৬:৫৪ |

    যদিও একটু দেরি হলো তবু মন দিয়ে পড়লাম বন্ধু। ধারাবাহিকের জন্য ধন্যবাদ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ৩১-১০-২০১৯ | ১২:০০ |

      দেরিতে হলেও ধন্যবাদ জানাতে কি ভুল হতে পারে! https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. সুমন আহমেদ : ৩০-১০-২০১৯ | ১৮:৫০ |

    শুভেচ্ছা জানবেন খালিদ উমর ভাই। সালাম। 

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ৩১-১০-২০১৯ | ১২:০১ |

      সালাম এবং শুভকামনা প্রিয়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. সাজিয়া আফরিন : ৩০-১০-২০১৯ | ২০:৫৬ |

    পড়েছি খালিদ উমর ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_cool.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ৩১-১০-২০১৯ | ১২:০৫ |

      বেশ ভাল কথা! পড়তে থাকুন, পড়াশুনা করা ভাল সহজেই পাশ করতে পারবেন। আশা করছি ভালই লাগবে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ৩০-১০-২০১৯ | ২১:৪৬ |

    কতদূর আর কতদূর খালিদ ভাই। ভালোবাসা তাহারে কয় যাহারে কয় ভালোবাসা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ৩১-১০-২০১৯ | ১২:০৬ |

      আরতো নয় বেশি দূর, মাত্র ২০০ পর্ব! https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

      GD Star Rating
      loading...
  5. রিয়া রিয়া : ৩০-১০-২০১৯ | ২৩:০৬ |

    শুভেচ্ছা জানবেন খালিদ দা।

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ৩১-১০-২০১৯ | ১২:০৭ |

      শুভেচ্ছা এবং ভালবাসা দিদি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

      GD Star Rating
      loading...
  6. শাকিলা তুবা : ৩০-১০-২০১৯ | ২৩:১৩ |

    পড়ে চলেছি। 

    GD Star Rating
    loading...