মুক্তি যুদ্ধের শেষ রাত

bangladesher_potaka7

ঝাউতলা স্কুলে আমাদের ট্রুপের ডিউটি থাকে, গত একমাস যাবত এখানেই ডিউটি চলছে। তবুও ডিউটিতে আসার আগে কমান্ডারের কাছ থেকে ডিউটি স্টেশন কোথায় জেনে আসতে হয়। আজ বিকেলেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। কমান্ডার ভাই বললেন আজ রাতে কিন্তু সবাই সাবধানে থাকবে আর সন্দেহ হলে ব্রাশ ফায়ার করতে দ্বিধা করবে না।

সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর। বেশ কনকনে শীতের বিকেল। গায়ের চাদরের নিচে স্টেনগানটা ঢেকে ঝিটকা থেকে আমরা ৫ জন রওয়ানা হলাম। সন্ধ্যার মাগরিবের আজানের পরেপরেই নির্ধারিত ঝাউতলা স্কুলে এসে যার যার পজিশন নিয়ে বসে রইলাম। শীত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমরা প্রথম রাতেই পাশের ধান কাটা জমি থেকে নারা এনে বিছিয়ে নিয়েছিলাম।

আমাদের ডিউটি ছিল রাতের একটা নির্দিষ্ঠ সময়ের পরে এই পথে কে কে চলাচল করে তাদের সনাক্ত করে পরদিন কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট করা এবং পাকিবাহী কনভয় আসতে দেখলে একজন দৌড়ে কমান্ডারের কাছে সংবাদ পৌছে দেয়া এবং বাকী ৪ জন প্রথমে ডিনামাইট দিয়ে কলতার ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া আর ব্রাশ ফায়ার করে কনভয় থামিয়ে দেয়া। সঙ্গে অনেক হ্যান্ড বোমা থাকত দরকার হলে অন্তত চারজনে চারটা গাড়ি উড়িয়ে দেয়া। কাজটা বেশ ঝুকিপূর্ণ কিন্তু তখন আমাদের মাথায় ঝুকি বলে কোন শব্দ কাজ করতনা। যা করত তা হলো পাকি শেষ কর আর দেশ স্বাধীন কর! আর কিছুই আমাদের ভাবনায় আসত না।

তবে আমাদের মানিকগঞ্জ-ঝিটকা রাস্তায় রাতে আক্রমনের জন্য কোন কনভয় আসেনি। যা আসার তা দিনের বেলায়ই আসত, আমরা তখন নিজ বাড়িতে গভীর ঘুমে থাকতাম। জানতে পারতাম বিকেলে ডিউটি স্টেশন জানতে যেতাম তখন।
সেদিন রাতে কেন যেন হঠাত করেই আমাদের মনে একটা নির্ভয় ভাব এলো। সবাই যার যার চোখ কলতা ব্রিজের ওদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আড্ডায় মেতে উঠলাম, সবাই বেসুরো গলায় এক লাইন করে গান গাইছিলাম। আজ সৃ্স্টি সুখের উল্লাসে, কারার ঐ লৌহ কপাট এমনি নানা গান কিন্তু কেন যে আজ ভয়ের জায়গায় আনন্দ উল্লাসের জোয়ার বইছে কিছুতেই আবিষ্কার করতে পারছিলাম না।

সারারাত জেগেও লক্ষ্য করার মতি কিছুই দেখলাম না। যথারিতি সকালে ফজরের আজান শুনে আবার স্টেনগান চাদরে ঢেকে যারযার বাড়ির পথে চলে যেতাম শুধু মাসুদ কমান্ডারের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকে সারারাতের রিপোর্ট দিয়ে যেত।
সেদিন ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। লোকজনের হৈ হৈ চিতকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চমকে উঠলাম এত শব্দ কিসের? কী হয়েছে, বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের বাইরে এসে শুনি রেডিওর খবর শুনে সবাই এমন উল্লাস করছে। আমাকে দেখেই আমার চাচাত ভাই বলল, শুনেছিস পাকিরা আত্মসমর্পণ করবে, রেসকোর্সে সব রেডি হচ্ছে। ঢাকায় যাবি? নারে তোরা যা আমার কাজ আছে আমি পরে যাব।

দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তানিরা মিত্রবাহিনী ভারতীয় সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করল। রেডিওতে খবর শুনে সবাই একে একে জড়ো হলো আমাদের কমান্ডার এর বাড়িতে। বিজয় পতাকা ওড়াতে হবে। আনন্দ হবে, উৎসব হবে, স্বাধীনতার উৎসব। বাসি স্বাধীনতার উৎসব নয়। স্বাধীনতা বার্ষিকী নয় একেবারে জীবন্ত স্বাধীনতা। সদ্য স্বাধীনতার উৎসব। এর কি কোন তুলনা আছে না কারো সাথে এর তুলনা করা চলে! কয়জনের ভাগ্যে এই উৎসব জোটে? এই দেশে আরও কত কোটি কোটি মানুষের জন্ম হবে কত কি হবে কিন্তু আজকের এই দিনের স্বাদ কজনে দেখবে? কমান্ডার বাবু আমার হাতে এক টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন যাও ঝিটকা থেকে বাংলাদেশের পতাকা কিনে আন। কোন রকম টাকাটা হাতে নিয়েই দৌড়। দেড় মাইল পথ প্রায় দৌড়েই এ্লাম। একটা মুহূর্ত নষ্ট করার উপায় নেই। উল্লাস কমে যাবে, আনন্দের গতি ধীর হয়ে যাবে। সুখের স্রোতে ভাটা পরে যাবে। পতাকা কিনেই তা বগল দাবা করে আবার দৌড়।

বাজার থেকে বেড় হয়ে এসে গ্রামের মেঠো পথের পাশে সবুজ গম খেতের গমের শীষে বেধে কখন যে পতাকাটা আটকে রয়ে গেছে তা বুঝতে পারিনি। বাড়ির কাছে এসে যখন দেখলাম বগলের পতাকা নেই, কি হলো? আবার উলটো দৌড়। বেশ খানিকটা পথ এসে দেখি গমের শীষের সাথে পতাকা ঝুলছে। নিয়ে আবার দৌড়। বাড়িতে এসে দেখি বিশাল আয়োজন। সমস্ত এলাকার মানুষ চলে এসেছে। সবুজের মাঝে রক্ত লাল আর তার মাঝে দেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা বাঁশের তৈরি মাস্তুলের মাথায় বেধে ওড়ানো হলো। হারমোনিয়াম তবলা রেডি ছিল, পাশে দাঁড়িয়ে সবাই স্বাধীন ভাবে, মনের উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে এক সুরে “‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গাইল। সে যে কি শান্তি, কি উল্লাস তা কি আর ভাষায় বলা যায়? সে শুধু অনুভূতি দিয়ে অনুভব করতে হয়। আমার কি সৌভাগ্য! আমি এই সদ্য স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করলাম। জাতীয় সঙ্গীতের পর আরও দেশাত্মবোধক গান হলো।
কে যেন কলতা বাজার থেকে মিষ্টি এনেছিল। গানের পরে মিষ্টি বিলানো হলো। সুশীল কাকার বাড়িতে খেজুরের গুড় দিয়ে ক্ষীর রান্না হয়েছিল কলাপাতায় করে সে ক্ষীর বিলানো হলো। হৈ চৈ শেষ করে গভীর রাতে শিহাব এবং মইন চাচার সাথে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। রাতে বাড়ি ফিরেই আবার রেডিওর পাশে বসলাম। ঢাকার খবর জানতে হবে।
IMG_1196
ছবিঃ জনাব রিজভান রিহান, দেশের ভবিষ্যত নাগরিক।

বন্ধুগন, এ দেশের স্বাধীনতা আমরাই এনেছি, এর মর্যাদা আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে তাইতো আমি দেশের পতাকা তুলে দিয়েছি আমার ভবিষ্যতের হাতে। আপনিও তাই করুন! স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানাতে সচেষ্ট হোন। আমার আর এক শাহানশাহ জনাব রাফসান চৌধুরি আমার কাছে নেই তাই ভেবে পাইনা তাকে কে বাংলাদেশি বানাবে!

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মামুনুর রশিদ : ১৬-০৪-২০১৭ | ১৯:৪৪ |

    জীবন্ত স্বাধীনতার ঘ্রাণ যদিও সৌভাগ্য হয় নি তবু অনুভব করি হৃদয়ে।

    শুভেচ্ছা নিন দাদা। জনাব রিজভান রিহানের জন্য অনেক শুভ কামনা।

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৬-০৪-২০১৭ | ২০:১১ |

      জীবন্ত স্বাধীনতার ঘ্রাণ যে কী অনুভুতি সে কথা ভাষায় বোঝান যায় না! যতদিন জীবিত থাকব কোনদিন একটা মূহুর্তের জন্যেও ভুলতে পারব না।

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ১৭-০৪-২০১৭ | ১০:৩৬ |

    আমাদের দেশের পতাকা তুলে দিয়েছি আমাদের ভবিষ্যতের হাতে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৭-০৪-২০১৭ | ১২:৪৮ |

      ধন্যবাদ জনাব প্রিয় বন্ধু।
      বেশ একটু অনুপস্থিত মনে হলো! https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Confused.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. আনু আনোয়ার : ১৭-০৪-২০১৭ | ১৮:৪৮ |

    আপনাদের কল্যাণে আমরা পেয়েছি মুক্ত স্বদেশ।
    আপনাদের কল্যাণে বলতে পারি – মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার।

    GD Star Rating
    loading...