দুই দেশে এক ঈদ

9d899a224010b208efc23a8944cc958a
অনেক অনেক দিন আগের কথা। যখন ঢাকা শহরে দুই টাকায় একটা প্রমাণ সাইজের পদ্মার ইলিশ পাওয়া যেত এবং আমার মা সেই ইলিশের কোর্মা ও ইলিশ পোলাও রান্না করতে পারতেন। আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে অতি উপাদেয় খাদ্য হিসাবে ওগুলির স্বাদ আস্বাদন করতাম। আমি তখন পত্নী হীন (দয়া করে কেউ আবার বিপত্নীক ভাববেন না) তবে সহসা আমাকে সপত্নীক করার জন্য ছন্দা নামে এক হবু ভদ্র মহিলা ওরফে আমার সবে ধন নীলমণি একমাত্র প্রিয়তমা, যিনি দেশে বাস করতেন এবং কেন যেন আমার সাথেই যুগল বাঁধার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন।

তখনকার প্রেম ভীষণ কঠিন প্রেম ছিল। অনেক কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে তবেই কোন প্রেমিকার কাছ থেকে একেবারে তারাহুরো করে লেখা একটা প্রেম পত্র পাওয়া যেত। সে সময়ের প্রেম প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে একটু নির্জনে আলাপ, দূর থেকে সামান্য চোখের ভাষায় বা একটু ইশারা ইঙ্গিতে তোমার আমার ভালবাসা বাসির মধ্যেই সীমিত ছিল, এবং এই ছিল অনেক। এর বেশী ভিন্ন কোন উষ্ণতার আশা করা ছিল আত্মঘাতী মূলক আচরণ। তখন মোবাইল, ফোন বা ইন্টারনেটে আলাপ করার কোন কিছুই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি বলে তারা প্রেমিক প্রেমিকাদের ভর্তসনা ছাড়া আর কিছু পেত না। রাতের আঁধারে মিটমিটে হারিকেনের আলোতে পড়ার টেবিলে নোট তৈরির ছুতায় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে প্রেমপত্র লিখে আবার সেই চিঠি লুকিয়ে পোস্ট অফিসে যেয়ে পোস্ট করে এসে মাস দুয়েক পরে উত্তর পাবে সে আশায় পথের দিকে চেয়ে থাকা ছিল আরও কঠিন। প্রতীক্ষার প্রতিটি প্রহর যেন আর শেষ হতে জানত না। দুই বা তিন মাস পর কোন রকমে উত্তর পেয়ে সহজেই কি আর তা পড়া যেত? সুযোগ খুঁজতে হত কখন এই চিঠি পড়ার শুভক্ষণ আসবে। রাতের অন্ধকারে যখন সবাই ঘুমিয়ে পরত তখন বালিশের কাছে হারিকেন বা মাটির প্রদীপ এনে সামান্য আলোতে কিংবা শেষ বিকেলে সবাই যখন নানা কাজে ব্যস্ত তখন পুকুরের পাড়ে বেতের ঝোপে মশার কামড়ের সাথে বা খড়ের পালার পাশে বসে প্রেমিকের চিঠি পড়ার আনন্দ ছিল ভিন্ন স্বাদের। বুক ঢিব ঢিব করত, এই বুঝি কেউ দেখে ফেলে! তবুও কি যে না বলতে পারার মত একটা ভিন্ন ধরনের স্বর্গীয় আনন্দ তা বোঝান যায় না। সে চিঠি এক বার, দুই বার তিন বার পড়েও যেন আশ মিটত না। কাছেই কারো সারা পেয়ে চিঠি লুকবার যে কি চেষ্টা তা আজকাল কেউ বুঝবেই না।

সত্যি কথা বলতে কি, আমার এই লেখালেখির হাতে খড়ি দিয়েছে আমার ছন্দা। তাকে লিখতে হত বিশাল উপন্যাসের মত চিঠি। যাতে কবে কি খেয়েছি, কোথায় গিয়েছি, সে দেশের সুন্দরীরা দেখতে এবং শুনতে কেমন, এ ছাড়া আর কি কি দেখেছি এবং দিনের মধ্যে কতবার তার কথা মনে হয়েছে সব ইনিয়ে বিনিয়ে না লিখলে পরের চিঠিতে তার বকুনি নির্বিবাদে হজম করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকত না। তখন ব্রিটিশ এয়ার এর নাম ছিল BOAC বা ব্রিটিশ ওভার সিজ এয়ারওয়েজ কর্পোরেশন। আমি তখন আয়ারল্যান্ডের তৈরি এরিনমোর নামের হলুদ রঙ টিনে ভরা অতি মহনীয় সুগন্ধযুক্ত তাম্রকূট দিয়ে বিড়ি বানিয়ে ধূমপানে অভ্যস্ত ছিলাম। এই বিড়ি বানানোর কাজে আমার সূ দক্ষতা সারা জাহাজে সর্বজন বিদিত ছিল।
সেই তখনকার কথা বলছি। আজকের কথা নয়। আমি তখনও জাহাজের ডেক ক্যাডেট। আমার এই ভয়েজের ‘ওশেনিয়া’ জাহাজ খানার মালিক ছিল ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি।
একবার কুরবানির ঈদের মাস খানিক আগে সউদি আরবের রাস্তানূরাহ থেকে কাঁচা তেল (ক্রুড ওয়েল) নিয়ে স্পেনের একটি বন্দরে আনলোড করেছি। এর পর জাহাজটা গ্যাস ফ্রি করে ডকিং করার জন্য ইংল্যান্ডের প্লিমাউথে যাবার কথা। হিসাব অনুযায়ী প্লিমাউথে যাবার পর আমার রিলিভার আসবে এবং আমি দেশে ফিরে এসে সবার সাথে আনন্দে ঈদ উদযাপন করব আর এরই এক ফাঁকে ছন্দার সাথে এক পলকের দেখা আর একটু খানি হাতে হাত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করার ইচ্ছা নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। সেই এক ফাঁকে ওর জন্য কেনা জিনিষগুলি দিয়ে আসব। এমন কিছু দেয়া যাবে না যা দেখে ওকে প্রশ্নের সামনে পরতে হয়। কোথায় পেলি বা কে দিয়েছে? মনের এমন একটা আশা বুকের মধ্যে ভরে রেখেছি, দিন গুলি যাচ্ছে একেকটা বছরের মত।

স্পেনের মাদ্রিদে তেল নামিয়ে চলে আসছি আর রাস্তায় গ্যাস ফ্রি করছি। কয়েক দিনের মধ্যে জাহাজ প্লিমাউথে এসে পৌঁছেছে। শুনলাম আমার রিলিভার রহিম ভাই লন্ডনে চলে এসেছে। দেশে আসার পোটলা বোচকা বাঁধাবাঁধির ঝামেলা সেরে ফেলেছি। জাহাজ তখনও ডকে আসেনি, মাত্র আউটার এঙ্কারেজে অপেক্ষা করছে। চিফ অফিসার জানিয়ে দিল রেডি হয়ে থাকতে কাল বিকেলে তোমার রিলিভার আসছে।
জাহাজ নোঙ্গরেই ছিল।

ক্যাপ্টেন হিসাব নিকাশ করে জাহাজ থেকে আমার যা প্রাপ্য তা দিয়ে দিল সাথে আমার সিডিসিটা আর একটা প্রশংসাপত্র। আমি ডলারের পরিবর্তে কিছু ব্রিটিশ পাউন্ড চেয়ে নিলাম। ভাবলাম ব্রিটেন থেকে সাইন অফ করছি যদি কিছু কেনা কাটা করি তাহলে আবার ডলার ভাঙ্গান এক ঝামেলার ব্যাপার হবে। বিকেল চারটায় সবাইকে see you again বলে হাতে বুকে মিলিয়ে আপাত বিদায় (নাবিকেরা সাধারণত বাই বাই বলে না) নিয়ে বাক্স পেটরা ডেকে এনে রেখে ব্রিজে গেলাম। ওয়াচ ডিউটি করছিল ক্যাভেন।
কি খবর ক্যাভেন কোন খবর পেয়েছ?
জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই রেডিওতে ডাকছে
“ওশেনিয়া ওশেনিয়া দিস ইজ প্লিমাউথ কলিং’ ।
ক্যাভেন জবাব দিল
‘প্লিমাউথ বল, আমি তোমাকে পরিষ্কার শুনছি”
বাংলাদেশ থেকে তোমাদের লোক এসেছে, প্লিমাউথ পাইলট ২ তাকে নিয়ে তোমাদের দিকে যাচ্ছে ওকে রিসিভ কর। আচ্ছা প্লিমাউথ, আমরা রেডি আছি। লন্ডন আমাদের জানিয়েছে। তুমি ওদের পাঠিয়ে দাও।
হ্যাঁ হ্যাঁ ওরা আধা ঘণ্টা আগে সেইল কর চলে গেছে।
ক্যাভেনকে আবার দেখা হবে বলে নিচে এসে ডেকে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে দেখি প্লিমাউথ পাইলট আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওটা দেখেই ছন্দার মুখটা বুকের ভিতরে কোথায় যেন ভেসে এলো। না না না শুধু বুকে নয় এ তো দেখছি সারা আটলান্টিক জুড়েই ছন্দার মুখ! যেদিকে তাকাই শুধু ছন্দা ছন্দা আর ছন্দা! কি আশ্চর্য!

রহিম ভাই এলো। ছোট্ট করে একটু কুশল জেনে এবং জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। এজেন্টের ব্যবস্থা অনুযায়ী সে রাতে প্লিমাউথের একটা হোটেলেই থাকতে হল। পরদিন লন্ডন থেকে আমাদের এজেন্ট ফোন করল। ওপাশে হ্যারি বলছে।
আগামী কাল ১৩ তারিখ সকাল সাড়ে সাতটায় BOAC তে প্লিমাউথ থেকে এথেন্স এবং তারপরে এথেন্স থেকে তোমাদের বিমানে ডাইরেক্ট ঢাকা।

ঢাকার ল্যান্ডিং কখন?
কিছু একটা দেখে বলল
উম, সকাল ৫টা
গুড হ্যারি, তুমি জান ১৪ তারিখে আমাদের গ্রেট ফেস্টিভাল এবং আমি তাহলে আমার ফ্যামিলির সাথে সময় মত দেখা করতে পারব।
আশা করি তুমি এর আগেই ঢাকা পৌঁছে যাবে। আজ সন্ধ্যার পর তুমি টিকেট পেয়ে যাবে।
ঠিক আছে, পৌঁছালেই হল।
বিকেলে একটু বের হলাম। প্লিমাউথ ব্রিটন সাইড বাস স্টেশনের কাছের মার্কেট থেকে টুকি টাকি কিছু কেনাকাটা করলাম ছোট বোন আর ছন্দার জন্য। পাশের বুটস থেকে আমার নিজের জন্য একটা সানগ্লাস কিনলাম
১৪ তারিখে বাংলাদেশে ঈদ হলে এখানে ১৩ তারিখ মানে আগামী কাল ঈদ হবার কথা। এখানে ঈদের নামাজ পাব না, কোথায় মসজিদ জানি না আর তাছাড়া এই প্লিমাউথে পরিচিত কেউ নেই। তবে শুনেছি লন্ডনের ব্রিকলেনের জামে মসজিদে সাধারণত সকাল ৮টা থেকে জামাত শুরু হয়ে ১০ টা পর্যন্ত কয়েকটা জামাত হয়। তখন ওই এলাকায় ওটাই সবচেয়ে বড় মসজিদ। এখন ইস্ট লন্ডন জামে মসজিদ হয়েছে, প্রায় ৫০০০ মুসুল্লি এক জামাতে নামাজ পড়তে পারে।

এখানকার জামাত ধরার কোন সুযোগ নেই। ফ্লাইটটা এখান থেকে দুপুর বা বিকেলে হলেও চেষ্টা করতে পারতাম। ওকে নো প্রবলেম! দেশে গিয়ে জামাত ধরতে পারব মনে হচ্ছে। এক ঈদ দুই জায়গায়! এমন অবাক কাণ্ড কয়জনের ভাগ্যে হয়?ঢাকায় যদি ভোর ৫টায় নামতে পারি তাহলে ইমিগ্রেশন, কাস্টম ইত্যাদি এয়ারপোর্টের ঝামেলা সেরে একটা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে মিরপুরে যেয়ে কাটায় কাটায় জামাত ধরতে পারব আশা করি, যদি কোথাও কোন বিভ্রাট না হয়। তবে এথেন্স থেকে বিমান যদি কোন ঝামেলা না করে শিডিউলে থাকে। অবশ্য এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার হবে কারণ বিমান লেট করবে না তাই কি হয়? অন্তত এর আগের ফ্লাইটগুলিতে যা দেখেছি।

এজেন্টের গাড়ি এসে সকালে সাড়ে চারটায় প্লিমাউথ সিটি এয়ারপোর্টে নিয়ে গেল। তখন সিকিউরিটির এত ঝামেলা ছিল না। চেক ইন, ইমিগ্রেশন এসব সেরে সময়মত প্লেনে উঠে বসলাম। একটু পরেই সীট বেল্ট বাঁধা,

আস্তে আস্তে প্লেনের রান ওয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া থেকে এক দৌড়ে আকাশে উড়ে যাওয়া। দিনের বেলা বলে সব দেখলাম জানালার পাশের সিটে বসে। সকালের নাস্তা আর চায়ের পাট শেষ। এখানে প্লেনে বসে আকাশে উড়ে যাচ্ছি দেশে যাবার পথে এথেন্সের দিকে আর পিছনে রেখে এলাম যেখানে ঈদ করছে কত জনে! কি আশ্চর্য এই বিশ্ব! একই সাথে কত জায়গায় কত কি ঘটে যাচ্ছে! আমি রয়েছি এখন আকাশে!
নাস্তা করার সময় ভাবছিলাম ভাগ্য ভাল যে আজকের টিকেট পেয়েছে, না পেলে আজ যদি এখানে থাকতে হত তাহলে এখানেই ঈদ করে যেতে পারতাম। ইংলিশ ঈদ কেমন একটু দেখা হত। সারা রাতে চোখ বুজতে পারিনি। হোটেলের রুমে বসে টেলিভিশনে এই চ্যানেল ওই চ্যানেল করেছি। যদি ঘুম এসে যায় আর এজেন্ট এসে ডাকাডাকি করে সেই ভয়ে। একটু চোখ বন্ধ করেছি আর ওমনিই বিমান বালার সুললিত মার্জিত ইংরেজি কণ্ঠ। লেডিজ এন্ড জ্যান্টল মেনো আপনারা আপনাদের সিট বেল্ট বেঁধে নিন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এথেন্স বিমান বন্দরে নামব ইত্যাদি ইত্যাদি। রাতের অনিদ্রার জন্য মাথা টনটন করছে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখি এড্রিয়াটিক সাগর পিছনে রেখে প্লেন আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছে। সামনে গ্রিসের এথেন্স এয়ারপোর্ট এর রাডার টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। হাতের ঘড়িতে দেখি কোথা দিয়ে এই পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম তার কিছুই টের পেলাম না? তাইতো বলি, এর মধ্যে ছন্দা এসেছিল কি করে? তাহলে কি স্বপ্ন দেখেছি ছন্দাকে? হ্যাঁ তাই হবে। যাক হাতের ব্যাগ গুছিয়ে শীতের কাপড় গায়ে চড়িয়ে সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম।

নিয়ম অনুযায়ী ৮ ঘণ্টার বেশি ট্রানজিটে থাকলে সেই এয়ারলাইনের পক্ষ থেকে লাঞ্চ এবং হোটেল দেয়ার কথা কিন্তু নিয়ম থাকলেও বিমানের কাউকে খুঁজে না পেয়ে নিজের পকেটে থাকা পাউন্ড দিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। এর মধ্যে নাস্তা, চা কফি কয়েকবার খেয়েছি। কোন চিন্তা নেই, পকেটে অনেক ডলার আর পাউন্ড রয়েছে। আরও কয়েক জায়গা থেকে আসা বেশ কয়েকজন এবং এখানকার স্থানীয় কয়েকজন বাঙালি জমা হয়েছে দেখলাম। তাদের মধ্যে যারা আমার মত ট্রানজিট লাউঞ্জে আছে তাদের সাথে খুচরা গল্প করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছি আর বুকের মধ্যে ঢোল বাজছে, দেশে ফিরে ঈদের চিন্তায় ছটফট করছি।
ফ্লাইট রাতে বলে রাতেও এখানেই খেতে হবে। পাউরুটির মত ও দেশের এক রকম রুটি, সবজি সেদ্ধ আর ডিম। দুই বেলায় এই একই খাবার খেয়েছি। ভয়ে অন্য কিছু নেইনি, কি জানি বাবা কি না কি, হালাল হারামের ব্যাপার। কি আছে নাম জানি না, চিনি না।

রাতে খাবার পর বিমানের কাউন্টারে এক লোককে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম
চেক ইন কখন করবেন?
ফ্লাইট ডিলে কাজেই এখনও কিছু বলতে পারছি না
কাল ঈদ, একথা কি আপনারা জানেন না?
একটু বান্দর হাসি দিয়ে (অন্তত তখন আমার তাই মনে হয়েছে)
আমরা এখানে আজই ঈদ করেছি!
কিন্তু আমরা যারা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার তারা দেশে যেয়ে ঈদ করব, তার কি হবে?

দেখুন, এ ব্যাপারে আমি বলতে পারছি না, আসলে ফ্লাইট নিউইয়র্ক থেকেই লেট
সাথে জুরিখ থেকে আসা এক ভদ্রলোক বলেই ফেলল তাহলে আর দেশে ঈদ করা হয়েছে, দেখুন এই এয়ারপোর্টেই ঈদ করতে হয় কিনা!
আমারও তাই মনে হচ্ছে!
নানা জনে নানা ধরনের কথা বলাবলি করছি।
রাতে খেয়ে এসে শুনলাম প্লেন আগামী কাল দুপুর একটার আগে আসছ না।
বাহ! দারুণ খবর শোনালেন ভাই, এবার বাড়ি গিয়ে এক ঘুম দেন, ঈদ তো করেই ফেলেছেন, আর চিন্তা কি?
যান কাউন্টার বন্ধ করে দিন!

সত্যিই একটু পরে দেখি সেই ভদ্রলোক আর নেই, সারা এয়ারপোর্ট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর তাকে পেলাম না।
যারা এথেন্স এর যাত্রী তারা যার যার বাসায় চলে গেল আর আমরা যারা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার তারা ১০/১২ জন হবে মনে হয় ঠিক মনে পরছে না, ওয়েটিং লাউঞ্জের এক পাশে একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে ফ্লোরে বসলাম। পরিষ্কার চকচকে ফ্লোর। কি করব, রাত কাটাতে হবে আর আগামী কাল ঈদ করতে হবে। মিটিং শুরু হল, সাইপ্রাস থেকে আসা এক বয়স্ক ভদ্রলোককে নেতা বানান হল। তখন বড় ভাই কথাটার খুব প্রচলন।
আচ্ছা বড় ভাই আপনি এখন আমাদের নেতা, বলুনতো এখন কি করা যায়?
কি আর করবেন, এখন সবাই ঘুম দিন কাল সকালে যা করার করব।
এখনই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলে ভাল হয় না?
কি সিদ্ধান্ত নেব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।
আমি বললাম আচ্ছা আমি না হয় হটাত করে এসেছি, আমার টিকেট করেছে আমার এজেন্ট তাই এই দিনে এই ফ্লাইটে আসতে হল কিন্তু আপনারা কেন এলেন?
নানা জনে নানা সমস্যা নিয়ে বলল।

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল নামাজ পড়ার কথা ভুলে যান, পথে এভাবে কি আর ষোল কলা পূরণ হয়?
কাল সকালে এখানে পুডিং বা ফ্রুট কাস্টার্ড বা এপল পাই জাতীয় মিষ্টি যা আছে তাই সবাই মিলে একসাথে বসে খেয়ে ঈদ করব। ঠিক আছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভাল আইডিয়া! তাই হবে।
এত রাতে ওয়েটিং লাউঞ্জ সবটাই প্রায় খালি, বিশেষ কেউ নেই। কাছাকাছি সময়ে আর কোন ফ্লাইট আছে বলে মনিটরে দেখা যাচ্ছে না।
আমরা একে একে একেকটা সোফা দখল করে হাতের ব্যাগ মাথার নীচে রেখে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম কি আর এত সহজ? মাঝে মাঝে এ ওকে ডাকছে একটু ইয়ার্কি চলছে কেউ আবার উঠে বসে সিগারেট টানছে আর সময়মত বাড়িতে যেতে না পারার দুঃখে মনে মনে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছে। এই এত লম্বা সময় একসাথে থাকার ফলে নানান শহর থেকে আসা সবার সাথে মোটামুটি একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে।

কারো ঘুম আর আসছে না। ভোরে এথেন্সের পুব আকাশ একটু একটু করে লাল হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে সূর্য উঠতে শুরু করল। এর মানে হল আমাদের দেশের ঈদ শেষ হয়ে গেছে। অনেকেই কুরবানির গরু জবাই করে ফেলেছে। আমরাও সবাইকে ডেকে ওয়াস রুম থেকে মুখে হাতে পানি ছিটিয়ে গেলাম রেস্টুরেন্টে। ঢোকার সময় কাউন্টারে বসা মুটকি বুড়িকে গুড মর্নিং জানিয়ে বললাম আমাদের ঈদের দুর্দশার কথা। বুড়ি শুনে খুব উহ আহ করল। আমরা কিচেনের পাশে অর্ডার দেয়ার জন্য এগুচ্ছি আর তখন বুড়ি এক সুন্দরী ওয়েট্রেসকে ডেকে গ্রীক ভাষায় কি যেন বলল। সুন্দরী ঘার কাত করে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। গতকাল লক্ষ করিনি, আজ দেখলাম অনেক মিষ্টি জাতীয় খাবার। আমাদের যার যা ইচ্ছা অর্ডার করে অপেক্ষা করছি। একটু পরে সবারটা এক সাথে দু/ তিনটা ট্রেতে সাজিয়ে দিল আর ট্রে নিয়ে আমরা জানালার পাশে পূর্ব দিকে এসে বসলাম। গ্রীসের সকাল দেখে ঈদ করব।
আমরা নাস্তা খাচ্ছি। একটু পরে দেখি সেই সুন্দরী দুই হাতে দুইটা ট্রে নিয়ে আমাদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। একটু অবাক হয়ে ওকে বললাম
আমরা আর কিছুর অর্ডার দেইনি, আমাদের সব কিছু নিয়ে এসেছি
সুন্দরী গ্রিক উচ্চারণে বলল
আমি জানি, কিন্তু এগুলি আমাদের ম্যানেজার ইশারা করে দেখিয়ে দিল ওই বুড়ি তোমাদের ফেস্টিভ্যালের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে কমপ্লিমেন্ট দিয়েছে
তাই নাকি? বেশ বেশ!

আমরা খুব খুশী হয়ে ওর হাতের ট্রে থেকে একে একে পেয়ালাগুলি নামিয়ে নিলাম। দেখলাম আইসক্রিম।
সুন্দরীকে বলে দিলাম তোমাকে এবং তোমাদের সবাইকে আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আমরা খুব খুশী হয়েছি।
এর পর সবাই কফির পেয়ালা নিয়ে বসলাম। আমি পকেট থেকে সেই আইরিশ তামাক এরিনমোরের টিন খুলে বসলাম।
তামাকের গন্ধে অনেকেই যারা অধূমপায়ী তারাও দেখলাম একটু লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখে বলল
ভাই আমাকেও একটা বানিয়ে দিন।
জানতাম এমন হবে তাই বেশি করেই কয়েকটা বানালাম।

কফি সিগারেট খেয়ে যখন বাইরে এলাম দেখি বিমানের কাউন্টারে দুই জন লোক দেখা যাচ্ছে। একটু কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
কি ভাই, কোন খবর পেলেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ প্লেন লন্ডন থেকে টেক অফ করেছে। এখানে একটার দিকে পৌঁছাবে আর তার ৪৫ মিনিট পরে আপনাদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ফ্লাই করবে। আপনারা একটু অপেক্ষা করেন। একটু পরেই চেক ইন শুরু করব।
হিসেব করে দেখলাম লোকটা যেমন বলেছে তা যদি ঠিক হয় তাহলে বিকেল নাগাদ ঢাকায় পৌছাতে পারব। তার মানে সেদিন আর ছন্দার সাথে দেখা হবে না। দেখা হবে তার পরদিন মানিকগঞ্জে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৪ টি মন্তব্য (লেখকের ৬টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. মামুন : ১৬-০২-২০১৭ | ২০:৪৪ |

    পড়লাম প্রিয় ভাই।
    জানলাম অজানা কিছু।

    শুভেচ্ছা
    ভালোবাসা https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৬-০২-২০১৭ | ২০:৫৩ |

      আজকে সকালে অফিসে যাবার পথে বাসে বসে বসে একটা ছোট গল্পের প্লট মাথায় এসেছিল কিন্তু এখন লিখতে বসে দেখি কিছুই মনে পরছে না। তাই এই পুরান গল্প চালিয়ে দিলাম।

      GD Star Rating
      loading...
      • মামুন : ১৬-০২-২০১৭ | ২৩:২৭ |

        ভালো করেছেন প্রিয় ভাই।
        এই লেখাটি হোক পুরনো, আমাদের পড়বার ক্ষুধা তো মিটিয়েছে।
        আবারো শুভেচ্ছা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

        GD Star Rating
        loading...
  2. দাউদুল ইসলাম : ১৬-০২-২০১৭ | ২১:০৪ |

    তখন পুকুরের পাড়ে বেতের ঝোপে মশার কামড়ের সাথে বা খড়ের পালার পাশে বসে প্রেমিকের চিঠি পড়ার আনন্দ ছিল ভিন্ন স্বাদের। বুক ঢিব ঢিব করত, এই বুঝি কেউ দেখে ফেলে! তবুও কি যে না বলতে পারার মত একটা ভিন্ন ধরনের স্বর্গীয় আনন্দ তা বোঝান যায় না। সে চিঠি এক বার, দুই বার তিন বার পড়েও যেন আশ মিটত না। কাছেই কারো সারা পেয়ে চিঠি লুকবার যে কি চেষ্টা তা আজকাল কেউ বুঝবেই না। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Paper.gif.gif
    https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gif
    আমি বুঝেছি দাদা ভাই Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৬-০২-২০১৭ | ২১:০৯ |

      হুম! আর একজন পাপি পাওয়া গেল। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. ফকির আবদুল মালেক : ১৬-০২-২০১৭ | ২১:১৩ |

    গল্পটি আগের পড়েছি মনে হয়।

    আবার শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৬-০২-২০১৭ | ২১:২২ |

      হ্যা আপনার ঠিকই মনে আছে দেখছি! আজ সকালে অফিসে যাবার পথে বাসে বসে বসে একটা ছোট গল্পের প্লট মাথায় এসেছিল কিন্তু এখন লিখতে বসে দেখি কিছুই মনে পরছে না। তাই এই পুরান গল্প চালিয়ে দিলাম।

      GD Star Rating
      loading...
  4. মুরুব্বী : ১৭-০২-২০১৭ | ০:৩৪ |

    বিশেষ স্মৃতিচারণই বলবো। রচনা শৈলীর মুন্সিয়ানা লিখাকে প্রাণবন্ত করেছে।
    অভিনন্দন প্রিয় বন্ধু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৭-০২-২০১৭ | ৯:২৫ |

      ধন্যবাদ। প্রবেশ করতে পেরেছেন তাহলে! বেশ বেশ বেশ!https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...
    • মুরুব্বী : ১৭-০২-২০১৭ | ১০:০২ |

      জ্বী জনাব। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_mail.gif

      GD Star Rating
      loading...
  5. মামুনুর রশিদ : ১৭-০২-২০১৭ | ৬:৫০ |

    শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলাম খালিদ ভাই।

    “পুরোন মদে নেশা ভাল হয়!“https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Confused.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৭-০২-২০১৭ | ৯:২৭ |

      হ্যা তাই শূনেছি মদ যত পুরনো হয় ততই মাদকীয় হয়। ধন্যবাদ।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...
  6. Easy Recipe : ১৭-০২-২০১৭ | ১৫:০৪ |

    সারা গল্প জুরেই দেখি ছন্দা! ছন্দা বএওই ভাগ্যবতী!

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৭-০২-২০১৭ | ২০:০৩ |

      হ্যা ছন্দাই যে সব ম্যাডাম!https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...