ছোট্ট যে জন

এমন একজন মানুষের কথা নিয়ে আজ এই লেখা যিনি আমার পরিবারের সবচেয়ে ছোট্ট মানুষটি। যার বয়স এখনও (Saturday, September 17, 2016) সাত মাস হয়নি। সবার চেয়ে ছোট বলেই হয়ত তার চাওয়াগুলিও তেমনি ছোট ছোট। একটুখানি মনোযোগ, একটুখানি
মায়া ভরা হাতের ছোঁয়া কিংবা সুন্দর করে একটু কথা বলা বা মুখের কাছে মুখ নিয়ে একটুখানি মিষ্টি কোন গানের কলি শোনানো। এই একটুতেই তার খিল খিল হাসি যেন পূর্ণিমার চাঁদকেই হার মানিয়ে দেয়। কথা বলতে না পেরে ছোট ছোট হাত পা নেড়ে ঠোট দুটি নেড়ে কত কি যেন বলতে চাওয়ার আকুলতা আর সব কথা বুঝে নেয়ার ভাব যেন বুঝিয়ে দেয় এতেই পৃথিবীতে বেচে থাকার প্রেরণা এবং এটাই শান্তির অপর নাম।

হ্যাঁ, তার কথাই বলছি জন্মের মাত্র ৩৪ দিন পরেই যার মা তাকে এই বিশ্ব মা এর কাছে রেখে চলে গেছে বিশ্বের ওপাড়ে, সেই রাফসান চৌধুরীর কথাই বলছি। বাবা তার বেচে থাকার একান্ত অবলম্বনকে বেশ কিছুদিন ধরেই তার নিজের কাছে নিয়ে যাবার কথা বলে আসছিল কিন্তু নানা কারণে হয়ে উঠছিল না। আজ তাই হতে যাচ্ছে। ছোট খালা মনি কয়েকদিন ধরেই গোছগাছ করছে। দুধ খাবার ফিডার, সবার দেয়া উপহার ছোট ছোট জামা প্যান্ট, গত ঈদে নানার নিজ হাতে বানিয়ে দেয়া পাঞ্জাবি, পাজামা টুপি, জন্মের পর থেকেই খালাদের এক এক করে কেনা নানা খেলনা এমনি নানান টুকি টাকি। মায়ের কেনা হেয়ারব্রাস, চিরুনি, নেইল কাটার, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, ভ্যাক্সিনের কার্ড সব বাক্সবন্দি হলো। সাথে এতদিন ধরে যে ছোট খালা মনি মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছে সেও সঙ্গে যাবে তার কয়েকটা কাপড়চোপড়ও নেয়া দরকার তাই আলাদা একটা বাক্স নেয়া হয়েছে। পথের জন্য ভরে নেয়া হলো একটা বড় ফিডারে করে পানি। মা নেই বলে এতদিন যা খেয়ে বেড়ে উঠেছে সেই দুধের কৌটা, পানির বোতল।
মা যেদিন সকালে চলে যাবে সেদিন কি ও কিছু বুঝতে পেরেছিল? যদি নাই বুঝবে তাহলে সারা রাত না ঘুমিয়ে মায়ের দিকে কেন অমন করে বারবার ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে থেকেছে ওই অতটুক ছেলে!

আমেরিকা যাবার আগে সকালে ছোট চাচা দেখে গেছে। রাতে চট্টগ্রাম থেকে বাবা, বড় চাচা, দাদু এবং ছোট চাচী এসেছে। সঙ্গে মিষ্টি এবং ফলমূল এনেছে। বাড়িতে মেহমানদের জন্য ভালমন্দ রান্না হয়েছে। নাতিকে নিয়ে যাবে। আনন্দের ব্যাপার কিন্তু বেহালার তারে কেমন যেন করুণ সুর বাজছে কিছুতেই এ বাড়ির কেও কোন সুখ খুঁজে পাচ্ছে না। এই ছোট্ট মানুষটা আজ সবার মনে, দৃষ্টিতে। এ বাড়ির সবার চোখ ভেজা, নির্বাক, সবার মুখের ভাষা থমকে গেছে কেও কিছুতে স্বস্তি পাচ্ছে না।

পরদিন দুপুর তিনটার ফ্লাইটে চট্টগ্রাম যাবে। এয়ারপোর্টে যাবার জন্য গাড়ি ঠিক করা হয়েছে। এই এত এত আয়োজন সব এই ছোট্ট মানুষটার জন্য। পথে যেন কোন অসুবিধা না হয়, সবকিছু যেন ঠিকঠাক থাকে সবাই সেদিকে সতর্ক সেই ভাবেই সবকিছু গুছিয়ে নেয়া হয়েছে। সময় গড়িয়ে আসছে দুয়ারে গাড়ি রেডি। নানু চোখ মুছতে মুছতে বুক খালি করে দাদুর কোলে এই ছোট্ট মানুষটাকে তুলে দিল। মনে হলো সবার বুক ভেঙ্গে গেল কিন্তু তবুও দিতেই হবে। কারণ এ যে মেয়ের সন্তান, ছেলের নয়! যার মেয়ের গর্ভে জন্মেছে সে দিয়ে দিচ্ছে আর যার ছেলের সন্তান সে নিচ্ছে! এটাই কি বিচার? প্রকৃতির সকল কিছুই মেনে নিতে কোন কষ্ট হয়নি কিন্তু এই বিধান মেনে নিতে এত কষ্ট কেন লাগছে?

গাড়ি ছেড়ে দিল। সমস্ত বাড়িটা এই এতটুক একজন মানুষের জন্য ফাকা হয়ে গেল! শূন্য, যেদিকেই তাকাই সেদিকেই শূন্য, কোথাও কিছু নেই সব কিছু নিয়ে গেল এই ছোট্ট একজন মানুষ। আদর, স্নেহ, মায়া, ভালবাসা, বোধ বুদ্ধি কোন কিছুই আর নেই সব চলে গেছে এই ছোট্ট মানুষটার সাথে। বাড়িতে তার চেয়ে মাত্র আড়াই মাসের বড় একজন খালাত ভাই আছে সে মাত্রই ভায়ে ভায়ে বলে ডাকতে শিখছিল, ওকে কাঁদতে দেখলে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করত, হাসতে দেখলে নিজেও হাসত সেও কেন যেন বিষণ্ণ, আগের মত হাসছে না, শুধু আড়ি করছে কারো কাছে থাকতে চায় না, এ ঘরে এলে ওঘর দেখিয়ে দেয় আবার ও ঘরে নিয়ে গেলে এ ঘর দেখিয়ে দেয়।

সুখে থাক ভাইয়া। যেখানেই থাক সুস্থ থাক। বিশ্ব মায়ের সকল সন্তানকে ভালবেসো তোমার মা যেমন বাসত। সবার সঙ্গে মিশবে, কথা বলবে, ভাল মন্দের খবর নিবে, সাহায্য করবে। পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূলতা হাসিমুখে ডিঙ্গিয়ে জীবনে অনেক বড় হও, বাবা মায়ের সব সুন্দর স্বপ্ন পূরণ করবে। একজন সুন্দর মানুষ হয়ে বুক ফুলিয়ে বলবে আমিই রাফসান চৌধুরী। আমার মা তানজিমা খালিদ আর বাবা ফয়সাল ওয়াহাব চৌধুরী। অবাক পৃথিবী তোমার দিকে চেয়ে থাকবে। আজকে তোমাকে বিদায় দিয়ে আমি যতটা কষ্ট পেয়েছি ঠিক তার চেয়ে অনেক বেশি রহমত তোমার সঙ্গে থাকবে ইনশাল্লাহ। বাবাকে দেখে রাখবে, বাবার যত্ন নিও তুমিই যে তোমার বাবার প্রদীপ, বাবাকে কখনো একা হতে দিও না। নিজেও ভাল থেকো। মনে রেখ, তোমার এই অসহায় ভাইয়া তোমাকে কিছুই দিতে পারেনি কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের মত তার প্রান ভরা মমতা আর দোয়া অনন্তকাল ধরে তোমার সাথে থাকবে।
ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝে সেতু হয়ে থেকো।
ভাইয়া।
Rafsan Eid Satkania 2016 (1)
(সাতকানিয়ায় নিজ গ্রামের বাড়িতে ২০১৬ কুরবানির ঈদের আগেরদিন বাবার কোলে)
Rafsan Eid 2016 Ctg (33)
(চট্টগ্রামে নানুর কোলে ২০১৬ কুরবানির ঈদের দুইদিন পরে)
(Rafsan Chowdhury)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৪-০১-২০১৭ | ১৯:৫৮ |

    মনটা অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো লিখাটি পড়ে বন্ধু। জীবনে আপনার অনেক বড় ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে। মহান আল্লাহপাক আমাদের শাহেনশাহ রাফসান চৌধুরীকে নিরাপদ সুস্থ্য রাখুন। বাসার সবাই ভালো থাকবেন। ধৈর্য্য রাখুন। অন্যের পাশাপাশি আমরাও আছি।

    মি. রাফসান চৌধুরী। এই যে আপনার জন্য উপহার রইলো। Smile https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৪-০১-২০১৭ | ২০:১৭ |

      কি আর করব ভাই সবই বিধাতার কারুকাজ, মেনে নিতে হবে তাই মেন নিয়েছি কিন্তু মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। এদিকে গত ১৮ই নভেম্বর আমার বাবাও চলে গেলেন। বুঝতেই পারছেন কেমন যাচ্ছে দিন।

      GD Star Rating
      loading...
  2. মামুন : ১৪-০১-২০১৭ | ২১:২৬ |

    মন ভারাক্রান্ত হলো।
    আর কিছু বলতে পারছি না।

    GD Star Rating
    loading...
  3. শামীম বখতিয়ার : ১৪-০১-২০১৭ | ২১:৩৫ |

    এমন বাস্তবতা মানুষকে কষ্ট বিরহ ভারাক্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনা। এমন সত্যের কাছে একমাত্র দর্শনই চির আদর্শের আদর্শীক ভাবনা যুগিয়ে দিতে পারে। এর চেয়ে সত্য আর কিছুই বলতে পারবনা।

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৫-০১-২০১৭ | ১৮:২১ |

      তবুও মেনে নিতে হয়, জীবন এগিয়ে যায়।
      ধন্যবাদ ভাই! ভাল থাকবেন।

      GD Star Rating
      loading...
  4. সালজার রহমান সাবু : ১৪-০১-২০১৭ | ২১:৪০ |

    পাশাপাশি আছি।

    GD Star Rating
    loading...