গতকাল সকালে চার্জার রিকশায় এক জায়গায় যাচ্ছি। দিনাজপুর শহরের সড়কে যাতায়াত করলে উন্নয়নের রোল মডেল প্রত্যক্ষ করা যায়। মোটরসাইকেল, চার্জার রিকশা কিংবা বাইসাইকেলে বেশ উপলব্ধি হয়। একে আমরা বলি উন্নয়নের ঝাঁকুনি। যা হোক এটা সেই গল্প নয়, যা বলতে শুরু করেছি। পথে যেতে যেতে পুবে তাকিয়ে দেখি, দোকানের বারান্দায় টেবিল পেতে যে ম্যাকানিক ছেলেটি, সে অপলক তাকিয়ে আছে। আমি দূর থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, –
‘ভালো আছো রাজু?’
সে মাথা নেড়ে জানাল, ভালো আছে। ছেলেটি আমার কলেজ সহপাঠির একমাত্র পুত্র। আমার কলেজ বন্ধু ইন্টারে পাস করতে না পেরে রেডিও মেকানিকের কাজ শিখে নেয়। ভালো ইনকাম করে। ইলেকট্রিনক্সের উপর দুর্দান্ত আগ্রহ আমার। বাজারে নতুন মডেলের ক্যাসেট রেকর্ডার এলে পুরোনোটা পানির দরে বিক্রি করে নতুন কিনতাম। সেই নেশা অবশ্য এখন নেই। এখন হাতের মোবাইলে দু-তিন হাজার গান। তবে যখন ঢাউস সাইজ ডিলাক্স মডেলের ক্যাসেট রেকর্ডার ছিল, সিডি প্লেয়ার, রেডিও ইত্যাদি সব আমার বন্ধু সার্ভিসিং করে দিত। আমি যথাসম্ভব সম্মানী দিতাম। বন্ধু বলে কথা। তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুখ-দুঃখের গল্পও হতো। সামনের চা স্টল থেকে চা-সামুচা নিয়ে আসতাম। ইত্যাদি। এখন সে খুব কম বসে। তার ছেলেই কাজ করে। সারাদিনে ভালো ইনকাম হয়। সেই ছেলেও বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেনি অথবা করেনি। বাবার কাছে থেকে ইলেকট্রনিক্স মেকানিক বিদ্যা ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে। কখনো তার কাছে বিবিধ সামগ্রী সার্ভিসিং করাতে যাই। কোনো দরদাম করা যায় না। মানসম্মানের ব্যাপার। সে কাজ করে দেয়। আমি তার হাতে টাকা দিই। বন্ধু কোনোদিন দূর থেকে এসে জিজ্ঞেস করে, –
‘কী সমস্যা হলো?’
‘এই চার্জারটা জ্বলছে না, জ্বললেও একমিনিসট পর নিভে যাচ্ছে।’
‘ওর ব্যাটারি গেছে।’
এভাবেই মাঝেমধ্যে টুক-টাক কাজ করিয়ে নিই। দিন কয়েক আগে একটি হেডফোন দিয়েছিলাম। রাজুর সময় হয় না। বড় ব্যস্ত। অবশেষে একসময় বললাম, ‘অবসরে করে ঠিক করে দিয়ো।’ হেডফোনের সমস্যা সামান্য। সম্ভবত রাইট সাইট স্পিকারের কানেকশন লুস বা কেটে গেছে। তিনদিনের মাথায় এক সকালে হেডফোন পেলাম। বাড়ি এসে দেখি চলছে। তবে ভলিউম কন্ট্রোল আগের মতো স্মুথ নয়। সেটা পালটে গেছে। তবু যা হোক চালিয়ে নেওয়া যায়। তিনদিনের মাথায় আবার আগের ডিস্টার্ব। মোবাইল করে বললাম সমস্যার কথা। রাজু জবাব দিল।
‘সময়ের বড় অভাব আঙ্কেল।’
‘তুমি কেমন কাজ করে দিলে, দু-তিনদিনে নষ্ট হয়ে গেল। আরও একবার দেখ, চার্জ যা হয় দেওয়া যাবে।’
‘সেটা বড় কথা নয় আঙ্কেল।…আচ্ছা দিয়ে যাইয়েন।’
একদিন পুনরায় দিয়ে আসলাম। রাজু কাজ ধরে না। আমি আশপাশের কম্পিউটার দোকানে মনোমতো হেডফোন খুঁজে পেলাম না। অনলাইনে হেডফোন পাচ্ছি তো অর্ডার করতে গিয়ে দেখি ‘আউট অব স্টক’। কী আর করা। রাজুকে রিকোয়েস্ট করলাম আরও কয়েকবার।
‘আচ্ছা আঙ্কেল, আগামিকাল সকালে দেখব। আপনার কাজ দিয়েই দিন শুরু করব।’
‘ভেরি গুড।’
পরদিন সকাল প্রায় দশটায় ফোন দিল রাজু। ভাবলাম কাজ হয়ে গেছে। আসলে কিছু হয়নি। সে জানাল, রাইট সাইডের স্পিকার কেটে গেছে। আমি নাকি খুব জোরে বাজাতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেছি। তাকে বললাম, –
‘আমি তো কম্পিউটারে গান শুনি। কারও বিরক্তি যাতে না হয়। তা যা হোক, ঠিক করা যাবে?’
‘স্পিকার পালটাতে হবে।’
‘খরচ কেমন পড়বে বলো।’
‘স্পিকার মনে করেন সাড়ে তিন শত টাকা।’
আমি অবাক। একটি সাধারণ হেডফোন। কিনেছিলাম সাড়ে সাত শ টাকায়। কানেকশন মেরামত বাবদ দুই শত খরচ হলো। এখন স্পিকার পালটাতে সাড়ে তিন শত। মেকানিক চার্জ কম করেও একশ। অর্থাৎ মোট খরচ দাঁড়ায় সাড়ে ছয় শত। মোবাইলে জানালাম আমি যাচ্ছি।
তার কাছে গিয়ে স্পিকার দেখি। একটি বিবর্ণ পুরোনো জিনিস। এটা কখনোই এই হেডফোনের নয়। রাজু আমাকে ভালো মক্কেল পেয়েছে। তাকে বললাম, –
‘ঠিক করার আর দরকার নেই। একটি নতুন কিনে নেব।’
‘এই মডেল তো পাবেন না।’
রাজু বিরস বদনে জবাব দিল। আমি হেডফোন খোলা অবস্থায় ফেরত নিয়ে আসলাম। বাসায় পরিত্যক্ত সামানের মধ্যে রেখে দিলাম। বিদায় বন্ধু। অনেকদিন কানে লাগিয়ে কত না গান শুনেছি। মন আকাশে ভেসে গেছে কত বার আবেগের মোহনায়। আজ তাকে বিদায় জানতে হলো। একদিন সকলকেই বিদায় জানাতে হয়।
গতকালকের একজন তরুনের নিষ্পলক দৃষ্টিতে কী খুঁজে পেয়েছি জানি। আমরা এ কোন সমাজ রেখে যাচ্ছি? কীভাবে মানুষ এমন হয়ে যায়? আমি সব সহ্য করে গেলাম। কখনো মন বলে, কলেজের সহপাঠি বন্ধুকে বলি, ছেলেকে কেন সৎ করে গড়ে তুলতে পারলে না? কখনো ভেবে নিই, কী দরকার, মানুষ তো এমনিই। সততা যার যার জীবন তার তার। মন খুব খারাপ হয়ে গেল।
loading...
loading...
আমাদের আশেপাশে এমন অসংখ্য মানুষ। এবং এমনিই। সততা যার যার জীবন তার তার। ভুলে যান। ভালো থাকবেন নিরাপদে থাকবেন প্রিয় মাহবুব ভাই। বাঁচতে হবে।
loading...
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ভাই। আপনিও ভালো থাকবেন।
loading...
মুগ্ধকর।
loading...
অনেক ধন্যবাদ।
loading...