সিঁড়ি

এখন কীভাবে নিজেকে সেখানে নিয়ে যায়, থই পায় না সখি। দিশেহারা ভাবনা খেই। প্রচণ্ড ভিড়। পিঁপড়ে কিলবিল। তারা এগিয়ে যায়। ছুটোছুটি-হুড়োহুড়ি। কে কাকে ঠেলে ফেলে দেয়, কে পড়ে যায়, কার বুকে কার পা ওঠে; কারও নজর নেই। অনেক ভিড় দেখেছে সখি। কোটি মানুষের ভিড়ে মানুষ একলা পথিক। সখি আজ আবার পথে নেমেছে। পথের মানুষ পথে। আজ ফেরার পথ।
সখি একলা। একদিন শূন্যহাতে এখানে এসেছিল। সন্ধের ট্রেন যাত্রা। তখন ঈশাণ কোণ-ঘেষে একলা চাঁদ। চারিদিক হিম-কুয়াশা ঘোলা আলো। মায়ের জন্য মন কেমন করে। ফিরে যাবে? সে যায়নি। এরপর কেটে গেছে একশ পঁচাশি দিন। আজ ফিরে যেতে এসেছে। একটিবার দেখা। ট্রেনে উঠবে। এখন বেলা তিনটে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। সন্ধেয় উঠবে কি না কে জানে, মানুষ চাঁদের খোঁজে চোখ রাখবে; এদিক-ওদিক খুঁজবে। চাঁদ দেখা দিতে পারে অথবা…। সন্ধে ছয়টা তেতাল্লিশে ইফতার। উনত্রিশ রমযান। সখি এখনো উঠতে পারল না। পারবে কি না জানে না। মাথায় পোকা কামড়ায়। অস্থির মন। কত সময় আছে?
মানুষ আর মানুষ। একদিন মানুষের ভিড়ে এসেছিল। ইট-পাথরের শহর। কেউ কারও দিকে তাকায় না। এখানে চেনা মানুষও অচেনা। ট্রেন চলে। ঝিকঝিক উথাল-পাতাল ভাবনা। তার উপায় নেই। পারা যায় না আর। সেই রাতে কোন্ ভাবনায় অবশেষে বলে ফেলে। মা বিশ্বাস করে না। এমন আবার হয়! এত বড় পাপ! অথচ তেমনই হয়। সখির অসহ্য লাগে। সে পারে না। কী করতে পারে সে? শেষ-পর্যন্ত পরম নির্ভরতার আশ্রয়…বলে ফেলে। কিন্তু পাথর চেহারায় অবিশ্বাস। দোলাচল খেলা। চোখের দৃষ্টিতে ঝাপসা বৃষ্টি। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আর কিছু নেই। রাত নামে। নেমে আসে অন্ধকার। সখি কুণ্ডলিত কুকুরের মতো শুয়ে থাকে। ঘরের পশ্চিম কোণায় চৌকির উপর দু-জন মানুষ ঘুমোয়। গভীর নিশ্বাসে দেয়াল কাঁপে। সখির বুক। এই বুঝি কোনো লোমশ হাত এগিয়ে আসে। তাকে চেপে ধরে। সেই মানুষ তার বাবা। বড় ভরসায় বাবা ডাকে।

‘কি গো বেটি উঠতে পারো নাই?’
‘না গো চাচা। কেমনে উঠুম!’
‘যাবা কই?’
‘দিনাজপুর।’
‘টিকিট নিছো?’
সখি সামনে তাকায়। একজন মানুষ এক মেয়েকে জানালা দিয়ে ভেতরে নিতে ব্যস্ত। এত মানুষ কেমন করে যায়? ট্রেন থেমে আছে। মানুষের ভিড়। ভেতরে যেতে মরিয়া। কেউ ছাদে ওঠে। সখি কি ছাদে উঠবে? সে পাশে তাকায়। লোভে চকচক করে শেষ-দুপুরের দৃষ্টি।
‘তুমি ছাদে যাও। উঠবা?’
‘কেমনে উঠুম? অনেক উঁচা গো চাচা।’
‘এই যে মই আছে। বোঝলা মই না, সিঁড়ি; এডা দিয়া চাঁন্দেও উঠা যায়। স্বর্গেও। তুমি আহো।’
‘আজ চাঁদ উঠব?’
‘উঠবার পারে, না হলে শনিবার ঈদ হইবই। তুমি যাইবা না? আহো ছাদে তুইল্যা দিই। দশ ট্যাহা।’
‘দশ ট্যাহা?’
‘হ স্বর্গের সিঁড়ি দশ ট্যাহা। উঠবা?’
সখির দশ টাকা খরচ করতে অসুবিধে নেই। দশ কেন, কুড়ি পঞ্চশ একশ। মায়ের জন্য মন টানে। কেমন আছে মা? আহা কতদিন মাকে দেখে না! সেই আনন্দময়ী মা বোবা হয়ে গেল। সেই রাতে একটি মানুষ সারাজীবন বিছানায় শুয়ে শুয়ে অবশেষে পালঙ্কে ওঠে। মানুষের কাঁধে হেঁটে যায়। অনেক দূরের দেশ। মুখে কথা নেই। নতুন পোশাকে আতর-লোবান বাতাসে ভেসে যায়। মা কাঁদে। আকাশ-দিগন্তে অদ্ভুত বিষাদ। সোনালি-লাল আলোয় ধূসর অন্ধকার নামে। মানুষেরা বাবাকে নিয়ে যায়। ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে বাঁশবাগান। সেখানে হাজার জোনাকি। রাত পাহারায় জেগে থাকে।
‘মা বাবারে কই নিয়া যাইতাছে?’
‘তোর বাবা যে স্বর্গে যায় গো বেটি। জাদু রে…।’
আকাশের দেয়ালে কান্নার প্রলম্বিত সুর। সখির অবুঝ মায়া চোখ ভাসে। সেও যাবে। বাবার কষ্ট। বাবা কত কথা বলে। সখি শোনে। সখি বলে। বাবার মুখের হাসি। কখনো বিষাদ। কোনো কথা বলে না। চোখের দৃষ্টি কথা কয়। বিছানায় শুয়ে কেটে যায় দিনরাত।
‘ওগুলা কিসের আলো গো মা?’
‘স্বর্গের বাতি মা। মা রে এ্যাহন কি করি?’
‘আমি বাবার কাছে যামু।’
সখি কাঁদে। বাবাকে কোথায় রেখে এলো মানুষেরা? সখি কাঁদে শুধু কাঁদে। তারপর সেই বাড়িঘর-আঙিনা বদলে যায়। মায়ের সঙ্গে হেঁটে এলো দূরের পথ। নতুন ঘরদোর। একজন গাট্টাগোট্টা মানুষ মিটমিট তাকায়। চোয়ালে ঝুলে থাকে অচেনা হাসি। মানুষ কোলে তুলে নেয়।
‘এই হলো তোর বাবা। এ্যাহন থাইক্যা বাবা ডাকবি।’
‘না এ মানুষ আমার বাবা না। আমার বাবা মইরা গেছে।’
‘যে গেছে…গেছে গ্যা। এ্যাহন এই তোর বাপ।’
সখি বাবা ডাকে। এই বাবা হাসে না। চেহারায় কী খেলা করে বোঝে না সখি। তার কেমন লাগে। শিরশির ভয়। মনে হয় একটা সাপ হিম-শীতল ছুঁয়ে রাখে। গালে চুমু দেয়। ঠোঁটে চুমু খায়। সেই মুখ সেই ঠোঁট ধীরে ধীরে নেমে যায়। বুকের কাছে। আরও নিচে। সখির খারাপ লাগে। কখনো ঘুম পায়। অন্ধকার রাত। সে হারিয়ে যায়।
সখি স্কুলে ভর্তি হয়। এলোমেলো পথ ধরে হেঁটে যায়। রোদছায়ায় ক্লান্তি। মাথা আউলায়। মানুষের জীবন জটিল। মা বলে, –
‘চুপ থাক। কাউরে কবি না।’
‘মানুষডা ভালা না। আমি বাবা ডাকি। কিন্তু…।’
‘চুপ যা মা। এগুলা মুখে আনা পাপ।’
সখি বলে না। সে ভাবে। পাপ-পুণ্য কী? একদিন পথে নেমে যায়। ট্রেনে বসে। কেউ জানে না। সে থাকবে না। পালিয়ে যাবে। তখন সন্ধেরাত। পুবকোণায় চাঁদ ওঠে। আজও চাঁদ উঠবে অথবা কাল। মানুষ আকাশে চাঁদ হাতড়ায়। সে ফিরে চলে। মাকে দেখতে মন টানে। কেমন আছে মা? সখি এখনো ট্রেনে উঠতে পারেনি। নিজেকে কেমন করে ভেতরে নেয়? ছাদের ওপর? অবশেষে ছাদেই উঠতে হবে। সেই মানুষ অস্থির। এদিক-ওদিক তাকায়। হাতে মই। সিঁড়ি। কেউ সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠে। সখি অস্থির চঞ্চল। কাল ঈদ। একবার সেই বাঁশবাগানে যেতে সাধ জাগে। সেখানে বাবা শুয়ে থাকে। সখি কয়েকটি মালা নিয়েছে। বুকল ফুলের মালা। এসব ভাবতে ভাবতে পাজামার ফাঁসে হাত রাখে। একটি লালরং নোট।
‘চাচা আমারে উঠায়া দাও।’
‘আইস আইস…সমায় কম গো বেটি।’
মানুষ ছোটে। সখি পেছন পেছন। ব্যস্ত ভিড়। সে যেতে পারে…পারে না। তার হাতে পুটলি। সেখানে বুকলের মালা। তাজা ফুলের মালা। কয়েকটি শুকিয়ে গেছে। ফুলের তবু সুবাস মরে না। সখির মন মরে গেছে। সে বাঁচতে এসেছিল। ইট-পাথরের শহর। এখানে মানুষ বেঁচে থাকে। মানুষ মরে যায়। বকুলের গন্ধ তবু বাঁচে। মাকে মনে পড়ে। মায়ের জন্য মন টানে। বাবার জন্য। বাবা জোনাকি আলোর নিচে ঘুমোয়। বাবার বুকে বকুল ছুঁয়ে দেবে। রেখে আসবে। বাবা খুব ভালবাসত। সখির বুক জুড়ে সুখ। সেই সুখ হারিয়ে গেল। একদিন পালিয়ে আসে। ইট-পাথরের শহর। পথে ঘুরতে ঘুরতে কত কাজ। মানুষ ভালো মানুষ খারাপ। সখি কাজ ছেড়ে দেয়। তারপর পার্কের খোলা বাতাস। সে গাছের নিচে শুয়ে থাকে। সারারাত বকুল ফোটে। তারার আলো। সকালে ফুলের বিছানা। সখি মালা গাঁথে। মন ভাবনা। একটি মানুষ মালা নিয়ে আসে। মা খোঁপায় পরে। মুখে হাসি। সেই মানুষ এখন জোনাকির আলোয় শুয়ে থাকে। মা কেন ভুলে গেল তাকে? মা তুমি কেমন করে বাবাকে ভুলে গেলে? কেন ভুলে গেলে?
অবশেষে উঠতে পেরেছে সখি। সিঁড়ি সরে যায়। যেতে হবে। কাল ঈদ। আনন্দ উৎসব। সখি বসে থাকে। নিচে মানুষজনের ছুটোছুটি। একটি হুইসিল। ট্রেন এগিয়ে যায়। সখির মাথা ঘোরে। অদ্ভুত ঘোর ঘোর দৃষ্টি। আকস্মিক কি হয়? কয়েকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হইহই চিৎকার। সখির মন উন্মন। মায়ের কথা মনে পড়ে। বাবাকে দেখতে সাধ। সে ভিড়ের মধ্যে উঠে দাঁড়ায়। একটি মেয়ে শুয়ে থাকে। হাতে বকুলের মালা। সে রাস্তায় রাস্তায় মালা বিক্রি করে। সুগন্ধ বিলোয়। সে এখন শুয়ে আছে। ওঠে না। তার মুখ থেকে রক্ত কালো রং মাটিতে নেমে যায়। সখি সিঁড়িতে পা রাখে। আলো ঝলমল বহুবর্ণ ধাপ। অনেক উপরে বসে আছে কেউ। সে তার বাবা। সখি ওপরে ওঠে। উঠে যায়।

স্বর্গের সিঁড়ি।
_

(গল্পটি সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৪ জুলাই ২০১৮ ইস্যুতে প্রকাশিত। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যে পোস্ট করা হলো।)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৪ টি মন্তব্য (লেখকের ৭টি) | ৭ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৫-০৭-২০১৯ | ১০:৩১ |

    ছোট গল্পটি পড়লাম মাহবুব আলী ভাই। না বলা কথা পাঠক বুঝে নেবেন আশা করি। কখনও ভাবি আমাদের জীবনটা সহজ হয় না কেন !! বিঘ্নের তরুলতা জীবন ঘিরে রাখে !!

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৬-০৭-২০১৯ | ১৫:৪১ |

      ধন্যবাদ মুরুব্বীভাই। শুভকামনা রইল।

      GD Star Rating
      loading...
  2. সুমন আহমেদ : ১৫-০৭-২০১৯ | ২০:৩৯ |

    অভিনন্দন মাহবুব আলী ভাই। গল্পটি মন খারাপের হলেও গল্প হিসেবেই নিলাম।  

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৬-০৭-২০১৯ | ১৫:৪২ |

      এটা নেহাতই গল্প। মন খারাপের গল্প। জীবন থেকে নেয়া।

      GD Star Rating
      loading...
  3. রিয়া রিয়া : ১৫-০৭-২০১৯ | ২১:০৮ |

    আজকের গল্পটি বিনা বাধায় পড়লাম। বাধা হলো মোবাইলের স্ক্রিণ। ছোট গল্প হওয়ায় খানিক সুবিধে হলো। নিশ্চিত ভাল লিখেছেন। আপনার জন্য শুভকামনা দাদা।

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৬-০৭-২০১৯ | ১৫:৪৩ |

      অনেক ধন্যবাদ। এবং আন্তরিক শুভেচ্ছা।

      GD Star Rating
      loading...
  4. সাজিয়া আফরিন : ১৫-০৭-২০১৯ | ২১:৫০ |

    ধন্যবাদ ভাই। রকমারীতে খোঁজ নিচ্ছি।

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৬-০৭-২০১৯ | ১৫:৪৩ |

      রকমারিতে কী খোঁজ নিচ্ছেন?

      GD Star Rating
      loading...
  5. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১৫-০৭-২০১৯ | ২১:৫২ |

    গল্পটি আমি পড়লাম। 

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৬-০৭-২০১৯ | ১৫:৪৪ |

      অনেক ধন্যবাদ কবি। ভালো থাকুন।

      GD Star Rating
      loading...
  6. আবু সাঈদ আহমেদ : ১৫-০৭-২০১৯ | ২২:৩৭ |

    স্বর্গের সিঁড়ি।

    GD Star Rating
    loading...
  7. শাকিলা তুবা : ১৫-০৭-২০১৯ | ২২:৪৩ |

    আবেগকে আজকাল প্রশ্রয় দিতে চাই না। দুঃখ জীবনে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়। 

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ১৬-০৭-২০১৯ | ১৫:৪৫ |

      আবেগ না থাকলে কবিতা লিখবেন কী করে? আর দুঃখ তো জীবনের সাথি।

      GD Star Rating
      loading...