আম্মা, আমার জ্বর আসছে

পৃথিবীর যেখানেই তুমি থাকো, জ্বর এলে তোমার ঠিক একই রকম অনুভূতি হবে। যে অনুভূতি তোমার বেশ পুরনো। যে অনুভূতি তোমার খুবই পরিচিত। চুলোর উপরে ফুটতে থাকা ভাতের পাতিলের ঢাকনা কাঁপতে কাঁপতে তার ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়া বাষ্পের মত মনে হতে থাকবে তোমার প্রতিটি শ্বাস নিঃশ্বাস। যে খাবারই মুখে নেবে তুমি মনে হবে লবনটা খানিক বেশি হয়ে গেছে বোধহয়, কিংবা লবন দিতেই ভুলে গেছে সারাদিন সংসার গুছানো আম্মাটা।

চোখ মেলে যাই দেখবে তুমি তার উপর ছড়িয়ে থাকবে মিহিন একটা হলদে রঙের আভা। পুরোটা ঘর, জানালার ওপারের আকাশ আর সমস্ত গাছগাছালি ছেয়ে থাকবে সেই মিহিন হলুদের আলো। বেলকনির গ্রীল ছুঁয়ে আসা বাতাস কিংবা মাথার উপর ঘুরতে থাকা একঘেয়ে পাখার বাতাসটাও মনে হবে ফ্রীজের বরফ ভেঙে ভেঙে তোমার মুখের উপর অসহনীয় হয়ে ঝড়ে পড়ছে।

আর অতীতের সকল জ্বরের দিনগুলো একে একে তোমার মনে পড়তে থাকবে। মনে পড়তে থাকবে মাগরীবের পর একদিন সবাই সবক মুখস্ত করছিল আর তুমি এক পাশে একটা তোষকের উপর শুয়েছিলে। তোমার জ্বরাক্রান্ত গরম চোখের পানিতে গাল ভাসিয়ে তুমি সেই হেফজখানার সন্ধ্যায় ভাবছিলে মূলত তোমার আম্মার কথা। মনে পড়বে তোমার এক জ্বরের রাতে তোমার মামা তোমার জন্য সন্দেশ নিয়ে এসেছিলো একটা বাদামী রঙের ঠোঙ্গায় করে। মনে পড়বে জ্বরে ভরা এক বর্ষার মধ্যরাতে তোমার বড়কাকা; যাকে তুমি খুব ভয় করতে তার কাঁধেই মাথা রেখে নেতিয়ে পড়ে ছিলে তুমি। আর উঠানের পাশে আসা বর্ষার পানিতে বড়কাকা তোমাকে টর্চ জ্বেলে দেখাচ্ছিল মাছ কী করে ঘুমায়।

এভাবেই তোমার মনে পড়তে থাকবে আরও অনেককিছু। এগুলো ভাবতে ভাবতেই তুমি হঠাৎ খুব বিরক্ত হয়ে উঠবে তোমার নিকটবর্তী কোন শব্দের যন্ত্রণায়। কারন আশে পাশের খুব ছোটছোট শব্দ গুলোও তোমার কানে এসে অহরহ বারি খেয়ে যেতে থাকবে। কেউ কাউকে ডাকার শব্দ, থালাবাসন রাখার শব্দ, কিংবা রাস্তায় চলাচল করা রিক্সার টুংটাং বেল কিংবা প্রতিবেশীদের হাসিহাসির আওয়াজগুলোও খুব সূক্ষ্ম সূচের মত তোমার কানের পর্দায় এসে বিঁধতে থাকবে। এই সচরাচর আর অতি সাধারণ আওয়াজগুলোও তোমাকে বড্ড যন্ত্রণা দেবে। কারন এসব কোন আওয়াজের সাথেই তুমি প্রতিদিনকার মত আজ আর মিশে যেতে পারছো না। এলোমেলো বাসি বিছানাটা তোমাকে কেমন যেন কারাগারের মতই আটকে রেখেছে। এই কারাগারে কোন তালা নেই তবুও কেন যেন তুমি বেরিয়ে পড়তে পারছো না। মুক্ত এই কারাগারের জীবনটা তালাবদ্ধ কারাগারের চেয়েও কঠিন মনে হতে থাকবে। সময়টাকে মনে হতে থাকবে কেবলই করুণ একটা মহাকাল। বিছানার পাশের রুটির প্যাকেট, ফলের বাটি আর দুধের গ্লাসটা তোমাকে আরও যেন বিষণ্ণ করে তুলবে। প্যারাসিটামলের পাতাটাকে মনে হবে বিষণ্ণতা পেরোনোর ভাঙাচোরা কিন্তু প্রয়োজনীয় একটা মই।

তখন জ্বরের সময়। তখন কিছুই আর ভাল লাগবে না তোমার। নিত্যদিনের পরিচিত পুরো পৃথিবীটাকেই কেবল প্রতিপক্ষ মনে হতে থাকবে। তখন ভালো লাগবে শুধু তোমার গরম কপালে প্রিয় জনের ঠান্ডা একটা হাত। ঘোরলাগা জ্বরের হলুদ পৃথিবীতে শুধু তোমারই জন্য উদ্বিগ্ন হওয়া একটা মুখ। যেই হাতটা তোমার আম্মার। যেই মুখটা তোমার আব্বার। তোমার বোনের, তোমার ভায়ের কিংবা আরও কোন প্রিয় জনের…

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১০ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৬-০৯-২০১৯ | ২০:৩১ |

    অনেক দিন পর শব্দনীড়ে আপনার দেখা মিললো। জীবনের গল্প বলি আর যাপিত সময়ের কথামালা বলি, একরাশ অনুভূতির কথা গুলোন পড়লাম মি. আহমাদ মাগফুর। ভালো থাকুন যেখানে যেমন আছেন। ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।

    GD Star Rating
    loading...
    • আহমাদ মাগফুর : ১৭-০৯-২০১৯ | ১৯:৩৭ |

      জ্বরে পড়লে মানুষের অতীত মনে পড়তে থাকে। তাই ফেলে আসা পথের রতন কুড়াতে কুড়াতে চলে এলাম শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি! ♥

      GD Star Rating
      loading...
  2. সুমন আহমেদ : ১৬-০৯-২০১৯ | ২০:৩৬ |

    'পৃথিবীর যেখানেই তুমি থাকো, জ্বর এলে আমাদের ঠিক একই রকম অনুভূতি হবে।' https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • আহমাদ মাগফুর : ১৭-০৯-২০১৯ | ১৯:৪১ |

      এ এক আজব অনুভূতি। আমাদের জ্বর এলেই কেবল টের পাই। মানুষে মানুষে অনেক ভিন্নতা থাকলেও কিছু অনুভূতিতে সবাই যেন একই রকম দুঃখী, একই রকম সুখী! ভালোবাসা জনাব সুমন! ♥

      GD Star Rating
      loading...
  3. সাজিয়া আফরিন : ১৬-০৯-২০১৯ | ২৩:২১ |

    লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হলাম। টুকটাক অসুস্থ হলে এখনও আমি মায়ের ছবি প্রথমে দেখতে পাই। পরে প্রিয় জন। ধন্যবাদ আপনাকে ভালো থাকুন ভাই। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • আহমাদ মাগফুর : ১৭-০৯-২০১৯ | ১৯:৪৬ |

      পৃথিবীতে অনেক ঘর, অনেক মানুষ, অনেক দরোজা। অসুস্থ হলে সব ঘর সংকীর্ণ, সব মানুষ দূরে আর সব দরজাসমূহ অস্পষ্ট হতে শুরু করে। কেবল মা তার ঘরের দরোজা খুলে ডাকতে থাকে আয়… আয়…

      ধন্যবাদ জনাবা সাজিয়া আফরিন!

      GD Star Rating
      loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১৬-০৯-২০১৯ | ২৩:৫৪ |

    ভীষণ অন্তরমাখা একটি লেখা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. রিয়া রিয়া : ১৭-০৯-২০১৯ | ১৯:১০ |

    ভাল থাকুন দাদা। শুভেচ্ছা রাখি। 

    GD Star Rating
    loading...