গ্রাম বাংলার টুসু উৎসব ... টুসুপূজা ও টুসুগান [দশম পর্ব – দশম পরিচ্ছেদ]

গ্রাম বাংলার টুসু উৎসব ……..টুসুপূজা ও টুসুগান
[দশম পর্ব – দশম পরিচ্ছেদ]
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিস্কার করে চালের গুঁড়ো তৈরী করা হয়। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়।

পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে মেয়েরা গোবর দিয়ে পৌষ বুড়ি তৈরী করে সন্ধ্যেবেলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে গান করতে করতে সারা রাত পৌষ আগলায়। এই পৌষ আগলানো মানে ফসল আগলানো। খেতে পাকা ফসল, পুরুষেরা রাতে সেখানে পাহারায় ফসল আগলানোতে ব্যস্ত। মেয়েরা তাই গৃহের রক্ষক, একা রাত জাগা যায় না। তাই দলবেঁধে উৎসব।

টুসু ঘরের মেয়ে, ফসল রূপী আবাদের দেবী। এই আরাধনা কবে থেকে চলে আসছে তার সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও সম্রাট অশোকের আমলে এই একই ধরনের সমান্তরাল উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ধৌলি ও জৌগাডা শিলালিপিতে পাওয়া যায়। সমগ্র ধলভূম, বরাভূম ও মানভূমগড় জুড়ে একটা প্রচলিত কাহিনী শুনতে পাওয়া যায় কান পাতলেই। কাশীরাজের কন্যা টুসু ও ভাদু ইত্যাদি ইত্যাদি.. কান্তু গবেষনায় স্পষ্ট হওয়া গ্যাছে যে এই গল্প গল্পই।তার কোন সারবত্তা নেই কুড়মি সংস্কৃতি বা রুচির সাথে।

তাই এই ঘরের শস্যরূপী দেবীর কাছেই যত আবদার, অভিযোগ এবং তার কাছেই আনন্দের প্রকাশ। গানগুলিতে তারই প্রকাশ ঘটে।

# চাল উলহাব রসে রসে
মুঢ়ি ভাজব রগড়ে
সতীন মাগি মইরয়েঁ গেলে
কাঠ চালাব সগড়ে
সতীন মইরল্য ভাল হল্য
ছাতির ভাত মর হেঁট হল্য
সতীন ছিল চৈখের বালি
তাই আগে অকে লিল

#
“টুসুর মাচায় লাউ ধরেছ্যে
ধরেছ্যে জড়া জড়া
হাত বাড়াঞে ধইরতে গেলে
পায় জড়া পানের খিলি
জড়া জড়া পানের খিলি
যাঁতি কাটা সুফারি…

# ১) টুসুর চালে লাউ ধইরেছে
লাউ তুল্যেছে বাগালে
যবে বাগাল ধরা যাবি
বড়বাবুর হুজুরে
যখন বাগাল ধরা যায় মা
তখন হামরা বাঁধঘাটে
ঘাটের হল্যৈদ ঘাটে দিঞে
হামরা যাই মা দরবারে
দরবারে যে গেছলে টুসু
মকদ্দমায়ঁ কি হল্য
মকদ্দমায় ডিগরি হল্য
নীলমনি চালান গেল
বা

# ২ )”উপরে পাটা তলে পাটা
তার উপরে দারোগা
ও দারোগা সইরাঞ বস গ
টুসু যাবেক পুরুল্যা
পুরুল্যা যে গেছলে টুসু মকদ্দমায় কি হল্য
মকদ্দমায় ডিগরি হল্য
নীলমনি চালান গেল”(এই দু ভাবেই গাওয়া প্রচলিত)

রাত পোহালে আসে মকর।

“তদের ঘরে টুসু ছিল
দিন করি আনাগনা
কাইল ত টুসু চল্যে যাবে
হবে গ দুয়ার মানা”

গানে গানে টুসু নিরঞ্জন। রঙীন সুদৃশ্য চৌড়লে চাপিয়ে টুসুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় বড়ো জলাশয় বা নদীতে। সবেধন নীলমণি কন্যারত্নটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার সময়, গ্রাম্য রমণীদের সে কি শোকবিহ্বল চেহারা! অশ্রুসিক্ত বদনে তখন সেই মন খারাপের গান-

“আমার বড়ো মনের বাসনা,
টুসুধনকে জলে দিবো না।”
মকর পরবের অপরিহার্য অঙ্গ টুসু গান। মানুষের চিরন্তন আশা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় এইসব টুসু গানে। মানভূমের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের দিনে মানুষকে সচেতন করার কাজে টুসু গানের এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।প্রকৃত অর্থেই টুসু কুড়মিদের মহামিলনের পরব।

1

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
গ্রাম বাংলার টুসু উৎসব ... টুসুপূজা ও টুসুগান [দশম পর্ব – দশম পরিচ্ছেদ], 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৬-০১-২০২৩ | ১০:৪৭ |

    মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম প্রিয় কবি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    GD Star Rating
    loading...