বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (অষ্টম পর্ব)
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
চিৎপুরে যাত্রাপাড়ার অন্দরেও ঘুরে শোনা গেল হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস। কেন? বাঙালি সংস্কৃতির অনেক কিছুই বদলে গেছে। এক দশক আগেও শহরতলি, মফস্সলে চায়ের ঠেকের আড্ডায় শোনা যেত যাত্রার নানা গালগল্প। রঙিন পোস্টার দেখে অমুক অপেরা, তমুক পালার বায়না নিয়ে চলত ক্লাবে ক্লাবে জরুরি আলোচনা। বড়ো মাঠে প্যান্ডেল করে বাঁধা হত যাত্রার মঞ্চ। ভিড়ের চোটে সে প্যান্ডেল খুলেও দিতে হয়েছে কখনও। কিন্তু আজ মাঠে যাত্রা দেখার জন্য লোক হয় না। ক্লাবগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে ফ্রিতে যাত্রা দেখালে তবেই মানুষ জমা হয়। তা-ও খুব ভিড় হয় না। বরং অনেক সস্তার অর্কেষ্ট্রা, চটুল নাচগানের প্রতিযোগিতা বাজিমাত করে দিচ্ছে। কী বলছেন যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজন? মানুষ কেন বলছেন, ‘না, না, না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’? অনেকের মতে, যাত্রা দেখার সেই অভ্যেসটাই হারিয়ে গিয়েছে সন্ধের মেগাসিরিয়ালের দাপটে। আগে বাড়ির প্রমীলাবাহিনীর কাছে যাত্রাই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম এবং বাড়ির থেকে বেরোনোর উপায়।
ইদানীং প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের হাতে উঠে এসেছে টিভির রিমোট এবং অল্প সময়ে অনেক চ্যানেল দেখার দেদার স্বাধীনতা। আবার এই প্রজন্ম স্মার্টফোন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মধ্যে খুঁজে নিচ্ছে যাবতীয় বিনোদন। তাই বাংলার লোকসংস্কৃতির ধারক ও বাহক যাত্রাপালা রয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। সত্যি বলতে তো, বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও স্মার্টফোনের সঙ্গে লড়তে যাত্রা যে পরিমাণ আধুনিক হওয়া উচিত, তা কি যাত্রা হতে পেরেছে?
চিৎপুরের প্রযোজকদের অনেকেই মনে করেন, নবীন নাট্যকারদের কলমেও আগের মতো সংলাপ ফুটে উঠছে না। বরং যাত্রামঞ্চে হানা দিয়েছে অশ্লীলতা, উগ্রতা। অতীতে চিৎপুর ছিল যাত্রার একমাত্র সাম্রাজ্য। ইদানীং যাত্রায় ঘটেছে বিকেন্দ্রীকরণ। চিৎপুরের সীমানা ছড়িয়ে যাত্রা পৌঁছে গিয়েছে নন্দকুমার, তমলুক, নিমতৌড়ি, বেলদা, বারাসাতেও। ফলে চিৎপুরের একচ্ছত্র সাম্রাজ্যে থাবা পড়ছে অন্য তল্লাটের অপেরার। এর পাশাপাশি অনেকে মনে করেন যাত্রায় নতুন প্রতিভার যথেষ্ট অভাব। অশোক কুমার, বীণা দাশগুপ্তা, স্বপন কুমারের পরে যাত্রা তেমন নির্ভরযোগ্য অভিনেতা-অভিনেত্রী পায়নি।
চিৎপুরের যাত্রাসাম্রাজ্য যে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, তা অবশ্য মনে করেন না যাত্রাভিনেত্রী ও নির্দেশিকা রুমা দাশগুপ্তা। তিনি জানালেন, “নোট বাতিলের পরে পরেই বহু অসুবিধার মুখে পড়েছিল যাত্রাদলগুলো। তবে এখন তা কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু তা বলে যাত্রা ক্ষতির মুখে পড়েনি। এই চার-পাঁচ বছরে প্রত্যেক দলই খুব ভালো শো পাচ্ছে।” জানা গেল, এ বার বন্যার প্রকোপে অনেক শো বাতিল হয়েছে। গত কয়েক বছরে চলচ্চিত্র এবং সিরিয়াল থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যাত্রায় ভিড় জমাচ্ছেন। ফলে বাজেটও বেশ বেড়েছে। সে জন্য কম খরচে বিচিত্রানুষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছে ক্লাব সংগঠনগুলো। নিউ যাত্রালোক অপেরার সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা কান্তিময় ভাণ্ডারী জানালেন অন্য রকম অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বললেন, “টেলি সিরিয়ালের শিল্পীদের পাশে যাত্রাভিনেতারা তো নস্যি। সেলফি তোলার হিড়িক, কথা বলার দৌড়ঝাঁপ থেকে ফিতে কাটার আমন্ত্রণ, সবটাই তাঁদের জন্য. অথচ তাঁদের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রম দিই আমরা। ওঁরা গাড়ি হাঁকিয়ে আসেন, শো করে চলে যান, তার আগের বা পরের খবর তাঁরা রাখেন না। এমনকি আমাদের জন্য কোনো সহমর্মিতাও নেই।”
বিডন স্ট্রিট অঞ্চল জুড়ে গড়ে ওঠা যাত্রাপাড়ায় চিত্রবিচিত্র রঙিন পোস্টারের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, সময়টা যেন এখানে থমকে আছে। শপিং মল, ইন্টারনেট সংস্কৃতির পাশে শহরের বুকে টিকে রয়েছে এমন এক চলমান সংস্কৃতি। যাত্রার ইতিহাস তো সেই কবেকার, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সময়কার। কেষ্টযাত্রা, পৌরাণিক যাত্রার যুগ আজ আর নেই। তা-ও চোখে পড়ল দু’-একটা ইতিহাসাশ্রিত পালা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রযোজককে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, “এখন আর এ সব চলে না। পাবলিককে অন্য রকম না দেখালে কেউ আসবে না। আজকাল মানুষ ঘরোয়া জিনিস, স্ক্যান্ডাল, অ্যাকশন এ সব দেখতে চায়।
তাই বাধ্য হয়ে হটসিন রাখতে হয়।” কিন্তু একটা সময় ‘রূপবান’, ‘বেদের মেয়ে জোস্না’ও তো চলত দীর্ঘদিন ধরে? উত্তর আসে, “সে সময়টা মানুষ পিছন ফিরে তাকাতে চেয়েছিল। তাই রাজারাজড়ার গল্পে আগ্রহ পেয়েছিল। আজ তো সে সব দেখার জন্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল আছে। লক্ষ্মী, সারদা, সাঁইবাবা, শনিদেব সবই আছে সেখানে।” পাশ থেকে আরও একজন বলে উঠলেন, “সন্ধে হলেই টিভিতে রানি রাসমনি দেখতে বসে যাচ্ছে লোকে। যাত্রা দেখতে কে ভিড় করবে?” কথাটা ঠিকই।
প্রযুক্তির অগ্রগতি খুবই কোণঠাসা করে দিয়েছে যাত্রার মতো লোকসংস্কৃতিকে। মমতাময়ী অপেরার ম্যানেজার সুধাংশু পাত্র দীর্ঘ ৪০ বছর যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাঁর মতে, “যাত্রায় নতুন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। মেগাসিরিয়ালের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে যাত্রা সামাজিক প্রেক্ষাপট ছেড়ে ভীষণ রকম ঘরোয়া প্রেক্ষাপটে বন্দি হয়ে গিয়েছে।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি জানালেন, যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ।
শিল্পীর স্বীকৃতি নেই, পেনশন নেই, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিও নেই। কিন্তু তা-ও যাত্রায় বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে। চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় এখন মোটামুটি ভাবে যাত্রা উৎসবের রং লেগেছে। পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে যাত্রা উৎসব। টিভি সিরিয়াল কিংবা শহরের আর পাঁচটা বিনোদন ছেড়ে মানুষ যাতে এখানে আসে, সে জন্য সরকারি তরফে প্রচার, প্রচেষ্টা চলছে। যাত্রাপাড়াও খুব আশাবাদী। দেখা যাক, সময় কী বলে!
loading...
loading...
অনন্য
loading...
নিবন্ধটি পড়লাম কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী। শুভেচ্ছা সহ শুভ সকাল।
loading...