পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- নবম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- নবম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

টুসু উৎসব এক প্রকার লোক উত্সব। এটি প্রচলিত বিশ্বাস ও শস্যকাটার আনন্দোৎসবের এক সমন্বিত রূপ। টুসু উৎসব শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে, আর শেষ হয় পৌষ-সংক্রান্তি বা মকর-সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে।

টুসু একজন লৌকিক দেবী এবং তাঁকে কুমারী বালিকা হিসেবে কল্পনা করা হয়। কুমারী মেয়েরা টুসুপূজার প্রধান ব্রতী ও উদ্যোগী। মাটির মূর্তি বা রঙিন কাগজের চৌদল দেবীর প্রতীকরূপে স্থাপন করা হয়। পূজার উদ্যোগী বালিকা ও তরুণীরা প্রচলিত আচারবিধি অনুযায়ী পূজার যাবতীয় কর্ম সম্পন্ন করে। টুসু অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক এবং অব্রাহ্মণ্য এক উৎসব।

টুসু অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেয়েরা টুসু সঙ্গীত পরিবেশন করে, যা এ উৎসবের বিশেষ অঙ্গ ও মূল আকর্ষণ। টুসু গান আকারে ছোট হয় এবং গ্রাম্য নিরক্ষর নারীরা সেগুলি তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে রচনা করে। গানগুলি পল্লিবাসীর লোকায়ত সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার এক অনন্য প্রকাশ। উৎসবান্তে প্রতিমা বিসর্জন খুবই বৈচিত্র্যময় ও বেদনাদায়ক হয়। এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য মেলাও বসে।

টুসু শব্দটির উদ্ভব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। ধানের তুষ থেকে ‘টুসু’ শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত পৌষালি উৎসব ‘তুষতুষালি ব্রতকথা’র মধ্যে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়। টুসু দ্রাবিড় অস্ট্রিক ভাষাবর্গের কোল, মুণ্ডা, ওরাওঁ, সাঁওতাল, ভূমিজ, ভুঁইয়া, কুর্মি, মাহাতো প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবী বলে সাধারণ জনমত প্রচলিত।

পশ্চিম বঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান ও হুগলি জেলার গ্রামাঞ্চলে টুসু পূজা প্রচলিত। বাংলার লোকসংগীত ও সংস্কৃতিতে টুসু গান ও টুসু উৎসবের বিশেষ স্থান রয়েছে।


লিখেছেন: [অঞ্জলিকা মুখোপাধ্যায়]
তথ্যসূত্র: বাংলা পিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ

বিশেষ প্রতিবেদন: পৌষ আসতে না আসতেই লখাই মাহাত, শান্ত আহিরদের খামার ভরে ওঠে সোনালি ধানে৷ সার দিয়ে পালই দিয়ে সাজানো হয় মাঠ থেকে কেটে আনা ধান৷ চারমাসের পরিশ্রম ও অপেক্ষার পর ফসল ঘরে তুলে টুসু ও বাঁদনা পরবে মাতে পুরো জঙ্গলমহল৷ শীতের শুরুতেই জঙ্গলমহলের গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে টুসু৷ কিন্তু কে এই টুসু? কেনই বা একমাসের জন্য তিনি ফেরেন জঙ্গলমহলের গ্রামে?

টুসু জঙ্গলহলের নিজের মেয়ে৷ তাঁর বাপের বাড়ি আসাকে কেন্দ্র করে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয় টুসু পরব৷ ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়৷ অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন৷

তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর রেখে স্থাপন করা হয়৷ পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন৷ পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন৷ টুসু গান লোকগীতি হিসেবেও বিশেষ জনপ্রিয় জঙ্গলমহলে৷

আর পাঁচটা পুজোর থেকে কোথায় আলাদা এই পুজো? সাধারণত আমরা পুজো করে থাকি দেবতাদের সন্তুষ্ট করে কাঙ্খিত বর লাভের উদ্দেশ্যে৷ কিন্তু টুসু পুজো সেখান থেকে একেবারেই আলাদা৷ চারমাসের পরিশ্রমির পর সাধারণ চাষিরা কাঙ্খিত ফসল ঘরে তুলতে পেরে আনন্দে মেতে ওঠেন এবং টুসু দেবতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উৎসবে মাতেন৷ কবে টুসু পুজার প্রচলন হয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি৷ তবে প্রথম দিকে টুসু পুজোতে মুর্তি পুজোর চল ছিল না৷ এখন নতুন ধানের শিষের সঙ্গে মাটির মুর্তিও ব্যবহার হচ্ছে টুসু পুজোতে৷ জঙ্গলমহলের মেয়েরা নিজেরায় টুসু পুজো করে থাকেন৷ সাধারণ লৌকিক আচারেই এই পুজো হয়৷

জঙ্গলমহলে বিশেষ জনপ্রিয় টুসু পুজোর পরদিন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন গ্রামে মেলা বসে৷ অনেক জায়গাতে যা ‘আখান মেলা’ নামে পরিচিত৷ আখানের আগের রাতে টুসু পুজোর শেষদিনে সারা রাত ধরে টুসু গান গাওয়া চলে৷ প্রতিযোগিতা চলে কার টুসু ঠাকুর সবচেয়ে ভালো৷ দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখের কথা উঠে আসে এই টুসু গানে৷ তবে বয়স হয়ে যাওয়া লখাই মাহাতদের আক্ষেপ ডিজে এবং ফেসবুক , টুইটারের সংস্কৃতির যুগে ক্রমশ ঔজ্বল্য হারাচ্ছে গ্রাম বাংলার এই প্রাচীন উৎসব৷

তথ্যসুত্র: কলকাতা ২৪X৭

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৭-০১-২০২০ | ৯:৪৪ |

    টুসু উৎসব বা আমাদের আমাদের লোকজ উত্সবের কয়েকটি পর্ব মিস করেছি। সময় করে পড়ে নেবার ইচ্ছে রইলো। অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য মি. ভাণ্ডারী। শুভ সকাল। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১৭-০১-২০২০ | ১৪:৩৩ |

      সুন্দর মন্তব্যে আপ্লুত হলাম।
      অনুপ্রেরণা পেলাম।
      আশীর্বাদ কাম্য।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...