আমার পরবর্তী নতুন বিভাগ “ভারত সূর্য ডুবে গেল হায়!” পর্বে পর্বে প্রকাশ দেওয়ার আশা রাখি। সকলের সহযোগিতা ও আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে নতুন বিভাগটি আজ থেকে নিয়মিত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত করা হলো। শেষাংশে সংযোজিত করা হয়েছে ভারতের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবন আলেখ্য গীতি নাটকের দৃশ্যায়ন।
সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!
ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
প্রথম পর্ব।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭): একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাসঃ (প্রথম পর্ব)
১০০ বছর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক শোষনঃ (দ্বিতীয় পর্ব)
৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষনঃ (তৃতীয় পর্ব)
পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (চতুর্থ পর্ব)
স্বাধীন ভারত ও ভারতবাসীর স্বপ্ন (পঞ্চম পর্ব)
ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাসঃ (প্রথম পর্ব)
মুলতঃ ইংরেজরা ১৬০৮-এ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। আস্তে আস্তে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে তাদের বিচরণ শুরু হয়। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধ হয় তাতে বাংলার নবাবের করুন মৃত্যু দিয়ে এই ভুখন্ডে অর্থাত্ ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়।
এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় ইংরেজদের পক্ষ থেকে লর্ড ক্লাইভ। এবং তাকে সহায়তা করে নবাব সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ সহ অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতকতার পুরষ্কার স্বরূপ মীরজাফর বাংলার নবাব হয় এবং লর্ড ক্লাইভ তত্কা লীন ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করে। এর পরে লর্ড ক্লাইভ ইংল্যান্ড চলে যায় আবারো ফিরে আসে ১৭৬৫ সালের মে মাসে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। একজন কেরানী থেকে সে গর্ভনর হয়।
ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।
সংগ্রহ ও সম্পাদনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
প্রথম অঙ্ক-প্রথম দৃশ্য
যবনিকা উত্তোলনের অব্যবহিত পূর্বে আবহ সংগীতের পটভূমিতে নেপথ্যে ঘোষণা :
ঘোষণা : এক স্বাধীন বাংলা থেকে আর এক স্বাধীন বাংলায় আসতে বহু দুর্যোগের পথ আমরা পাড়ি দিয়েছি; বহু লাঞ্ছনা বহু পীড়নের গ্লানি আমরা সহ্য করেছি। দুই স্বাধীন বাংলার ভেতরে আমাদের সম্পর্ক তাই অত্যন্ত গভীর। আজ এই নতুন দিনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিস্মৃত অতীতের পানে দৃষ্টি ফেরালে বাংলার শেষ সূর্যালোকিত দিনের সীমান্ত রেখায় আমরা দেখতে পাই নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। নবাব সিরাজের দুর্বহ জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনি আমরা স্মরণ করি গভীর বেদনায়, গভীর সহানুভূতিতে। সে কাহিনি আমাদের ঐতিহ্য। আজ তাই অতীতের সঙ্গে একাত্ম হবার জন্য আমরা বিস্মৃতির যবনিকা উত্তোলন করছি।
১৭৫৬ সাল; ১৯এ জুন।
প্রথম দৃশ্য
সময় : ১৭৫৬ সাল, ১৯এ জুন। স্থান : ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ।
[শিল্পীবৃন্দ: মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-ক্যাপ্টেন ক্লেটন, ওয়ালি খান, জর্জ, হলওয়েল, উমিচাঁদ, মিরমর্দান, মানিকচাঁদ, সিরাজ, রায়দুর্লভ, ওয়াটস]
(নবাব সৈন্য দুর্গ আক্রমণ করছে। দুর্গের ভেতরে ইংরেজদের অবস্থা শোচনীয়। তবু যুদ্ধ না করে উপায় নেই। তাই ক্যাপ্টেন ক্লেটন দুর্গ প্রাচীরের এক অংশ থেকে মুষ্টিমেয় গোলন্দাজ নিয়ে কামান চালাচ্ছেন। ইংরেজ সৈন্যের মনে কোনো উৎসাহ নেই, তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।)
ক্লেটন : প্রাণপণে যুদ্ধ করো সাহসী ব্রিটিশ সৈনিক। যুদ্ধে জয়লাভ অথবা মৃত্যুবরণ, এই আমাদের প্রতিজ্ঞা। ভিক্টরি অর ডেথ, ভিক্টরি অর ডেথ।
(গোলাগুলির শব্দ প্রবল হয়ে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্লেটন একজন বাঙালি গোলন্দাজের দিকে এগিয়ে গেলেন)
ক্লেটন : তোমরা, তোমরাও প্রাণপণে যুদ্ধ করো বাঙালি বীর। বিপদ আসন্ন দেখে কাপুরুষের মতো হাল ছেড়ে দিও না। যুদ্ধ করো, প্রাণপণে যুদ্ধ করো ভিক্টরি অর ডেথ।
(একজন প্রহরীর প্রবেশ)
ওয়ালি খান : যুদ্ধ বন্ধ করবার আদেশ দিন, ক্যাপ্টেন ক্লেটন। নবাব সৈন্য দুর্গের কাছাকাছি এসে পড়েছে।
ক্লেটন : না, না।
ওয়ালি খান : এখুনি যুদ্ধ বন্ধ করুন। নবাব সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ না করলে দুর্গের একটি প্রাণীকেও তারা রেহাই দেবে না।
ক্লেটন : চুপ বেইমান। কাপুরুষ বাঙালির কাছে যুদ্ধ বন্ধ হবে না।
ওয়ালি খান : ও সব কথা বলবেন না সাহেব। ইংরেজের হয়ে যুদ্ধ করছি কোম্পানির টাকার জন্যে। তা বলে বাঙালি কাপুরুষ নয়। যুদ্ধ বন্ধ না করলে নবাব সৈন্য এখুনি তার প্রাণ নেবে।
ক্লেটন : হোয়াট? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা?
(ওয়ালি খানকে চড় মারার জন্যে এগিয়ে গেল। অপর একজন রক্ষীর দ্রুত প্রবেশ)
জর্জ : ক্লেটন, অধিনায়ক এনসাইন পিকার্ডের পতন হয়েছে। পেরিন্স পয়েন্টের সমস্ত ছাউনি ছারখার করে দিয়ে ভারী ভারী কামান নিয়ে নবাব সৈন্য দুর্গের দিকে এগিয়ে আসছে।
ক্লেটন : কী করে তারা এখানে আসবার রাস্তা খুঁজে পেলো?
জর্জ : উমিচাঁদের গুপ্তচর নবাব ছাউনিতে খবর পাঠিয়েছে। নবাবের পদাতিক বাহিনী দমদমের সরু রাস্তা দিয়ে চলে এসেছে, আর গোলন্দাজ বাহিনী শিয়ালদহের মারাঠা খাল পেরিয়ে বন্যাস্রোতের মতো ছুটে আসছে।
ক্লেটন : বাধা দেবার কেউ নেই। (ক্ষিপ্তস্বরে) ক্যাপ্টেন মিনচিন দমদমের রাস্তাটা উড়িয়ে দিতে পারেননি?
জর্জ : ক্যাপ্টেন মিনচিন, কাউন্সিলার ফাকল্যান্ড আর ম্যানিংহাম নৌকোয় করে দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছেন।
ক্লেটন : কাপুরুষ, বেইমান। জ্বলন্ত আগুনের মুখে বন্ধুদের ফেলে পালিয়ে যায়। চালাও, গুলি চালাও। নবাব সৈন্যদের দেখিয়ে দাও যে বিপদের মুখে ইংল্যান্ডের বীর সন্তান কতখানি দুর্জয় হয়ে ওঠে।
(জন হলওয়েলের প্রবেশ এবং জর্জের প্রস্থান)
হলওয়েল : এখন গুলি চালিয়ে বিশেষ ফল হবে কি, ক্যাপ্টেন ক্লেটন?
ক্লেটন : যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেওয়া ছাড়া আর উপায় কি, সার্জন হলওয়েল?
হলওয়েল : আমার মনে হয় গভর্নর রজার ড্রেকের সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করাই এখন যুক্তিসঙ্গত
ক্লেটন : তাতে কি নবাবের অত্যাচারের হাত থেকে আমরা রেহাই পাব ভেবেছেন।
হলওয়েল : তবু কিছুটা আশা থাকবে। কিন্তু যুদ্ধ করে টিকে থাকবার কোনো আশা নেই। গোলাগুলি যা আছে তা দিয়ে আজ সন্ধে পর্যন্তও যুদ্ধ করা যাবে না। ডাচদের কাছে, ফরাসিদের কাছে, সবার কাছে আমরা সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু সৈন্য তো দূরের কথা এক ছটাক বারুদ পাঠিয়েও কেউ আমাদের সাহায্য করল না।
(বাইরে গোলার আওয়াজ প্রবলতর হয়ে উঠল)
ক্লেটন : তা হলে আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমি গভর্নর ড্রেকের সঙ্গে একবার আলাপ করে আসি।
(ক্লেটনের প্রস্থান। বাইরে থেকে যথারীতি গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। হলওয়েল চিন্ততভাবে এদিক-ওদিক পায়চারি করছেন।
হলওয়েল : (পায়চারি থামিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে) এই কে আছ?
(রক্ষীর প্রেবেশ)
জর্জ : ইয়েস, স্যার।
হলওয়েল : উমিচাঁদকে বন্দি করে কোথায় রাখা হয়েছে?
জর্জ : পাশেই একটা ঘরে।
হলওয়েল : তাঁকে এখানে নিয়ে এসো।
জর্জ : রাইট, স্যার
(জর্জ দ্রুত বেরিয়ে চলে যায় এবং প্রায় পর মুহূর্তেই উমিচাঁদকে নিয়ে প্রবেশ করে)
উমিচাঁদ : (প্রবেশ করতে করতে) সুপ্রভাত, সার্জন হলওয়েল।
হলওয়েল : সুপ্রভাত। তাই না উমিচাঁদ? (গোলাগুলির আওয়াজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। হলওয়েল বিস্মিতভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন) নবাব সৈন্যের গোলাগুলি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন বলুন তো?
উমিচাঁদ : (কান পেতে শুনল) বোধহয় দুপুরের আহারের জন্যে সাময়িক বিরতি দেওয়া হয়েছে।
হলওয়েল : এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে উমিচাঁদ। আপনি নবাবের সেনাধ্যক্ষ রাজা মানিকচাঁদের কাছে একখানা পত্র লিখে পাঠান। তাঁকে অনুরোধ করুন নবাব সৈন্য যেন আর যুদ্ধ না করে।
উমিচাঁদ : বন্দির কাছে এ প্রার্থনা কেন সার্জন হলওয়েল? (কঠিন স্বরে) আমি গভর্নর ড্রেকের ধবংস দেখতে চাই।
(জর্জের প্রবেশ)
জর্জ : সার্জন হলওয়েল, গভর্নর রাজার ড্রেক আর ক্যাপ্টেন ক্লেটন নৌকা করে পালিয়ে গেছেন।
হলওয়েল : দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছেন?
জর্জ : গভর্নরকে পালাতে দেখে একজন রক্ষী তাঁর দিকে গুলি ছুঁড়েছিল, কিন্তু তিনি আহত হননি।
উমিচাঁদ : দুভার্গ্য, পরম দুর্ভাগ্য।
হলওয়েল : যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেবেন বলে আধ ঘণ্টা আগেও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ক্যাপ্টেন ক্লেটন। শেষে তিনিও পালিয়ে গেলেন।
উমিচাঁদ : ব্রিটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিলেন, এ বড় লজ্জার কথা।
হলওয়েল : উমিচাঁদ, এখন উপায়?
উমিচাঁদ : আবার কি? ক্যাপ্টেন কর্নেলরা সব পালিয়ে গেছেন, এখন ফাঁকা ময়দানে গাইস হাসপাতালের হাতুড়ে সার্জন জন জেফানিয়া হলওয়েল সর্বাধিনায়ক। আপনিই এখন কমান্ডার-ইন-চিফ। (আবার প্রচণ্ড গোলার আওয়াজ ভেসে এল)
হলওয়েল : (হতাশার স্বরে) উমিচাঁদ।
উমিচাঁদ : আচ্ছা, আমি রাজা মানিকচাঁদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছি। আপনি দুর্গ প্রাকারে সাদা নিশান উড়িয়ে দিন।
(উমিচাঁদের প্রস্থান। হঠাৎ বাইরে গোলমালের শব্দ শোনা গেল। বেগে জর্জের প্রবেশ)
জর্জ : সর্বনাশ হয়েছে। একদল ডাচ সৈন্য গঙ্গার দিককার ফটক ভেঙে পালিয়ে গেছে। সেই পথ দিয়ে নবাবের সশস্ত্র পদাতিক বাহিনী হুড় হুড় করে কেল্লার ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
হলওয়েল : সাদা নিশান ওড়াও। দুর্গ তোরণে সাদা নিশান উড়িয়ে দাও।
(জর্জ ছুটে গিয়ে একটি নিশান উড়িয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নবাব সৈন্যের অধিনায়ক রাজা মানিকচাঁদ ও মিরমর্দানের প্রবেশ)
মিরমর্দান : এই যে দুশমনরা এখানে থেকেই গুলি চালাচ্ছে।
হলওয়েল : আমরা সন্ধির সাদা নিশান উড়িয়ে দিয়েছি। যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে-
মিরমর্দান : সন্ধি না আত্মসমর্পণ?
মানিকচাঁদ : সবাই অস্ত্র ত্যাগ কর।
মিরমর্দান : মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও।
মাকিনচাঁদ : তুমিও হলওয়েল, তুমিও মাথার ওপর দুহাত তুলে দাঁড়াও। কেউ একচুল নড়লে প্রাণ যাবে।
(দ্রুতগতিতে নবাব সিরাজের প্রবেশ। সঙ্গে সসৈন্যে সেনাপতি রায়দুর্লভ। বন্দিরা কুর্নিশ করে এক পাশে সরে দাঁড়াল। সিরাজ চারদিকে একবারে ভালো করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে হলওয়েলের দিকে এগিয়ে গেলেন।)
সিরাজ : কোম্পানির ঘুষখোর ডাক্তার রাতারাতি সেনাধ্যক্ষ হয়ে বসেছে। তোমার কৃতকার্যের উপযুক্ত প্রতিফল নেবার জন্যে তৈরি হও হলওয়েল।
হলওয়েল : আশা করি নবাব আমাদের ওপরে অন্যায় জুলুম করবেন না।
সিরাজ : জুলুম? এ পর্যন্ত তোমরা যে আচরণ করে এসেছ তাতে তোমাদের ওপরে সত্যিকার জুলুম করতে পারলে আমি খুশি হতুম। গভর্নর ড্রেক কোথায়?
হলওয়েল : তিনি কলকাতার বাইরে গেছেন।
সিরাজ : কলকাতার বাইরে গেছেন, না প্রাণ নিয়ে পালিয়েছেন? আমি সব খবর রাখি, হলওয়েল। নবাব সৈন্য কলকাতা আক্রমণ করবার সঙ্গে সঙ্গে রজার ড্রেক প্রাণভয়ে কুকুরের মতো ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কৈফিয়ত তবু কাউকে দিতেই হবে? বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবার স্পর্ধা ইংরেজ পেলো কোথা থেকে আমি তার কৈফিয়ত চাই।
হলওয়েল : আমরা নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইনি। শুধু আত্মরক্ষার জন্যে-
সিরাজ : শুধু আত্মরক্ষার জন্যেই কাশিমবাজার কুঠিতে তোমরা গোপনে অস্ত্র আমদানি করছিলে, তাই না? খবর পেয়ে আমার হুকুমে কাশিমবাজার কুঠি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্দি করা হয়েছে ওয়াটস আর কলেটকে। রায়দুর্লভ।
রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা।
সিরাজ : বন্দি ওয়াটসকে এখানে হাজির করুন।
(কুর্নিশ করে রায়দুর্লভের প্রস্থান)
সিরাজ : তোমরা ভেবেছ তোমাদের অপকীর্তির কোনো খবর আমি রাখি না।
(ওয়াটস সহ রায়দুর্লভের প্রবেশ)
ওয়াটস।
ওয়াটস : ইওর এক্সিলেন্সি!
সিরাজ : আমি জানতে চাই তোমাদের অশিষ্ট আচরণের জবাবদিহি কে করবে? কাশিমবাজারে তোমরা গোলাগুলি আমদানি করছ, কলকাতার আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম তোমরা নিজেদের দখলে আনছ, দুর্গ সংস্কার করে তোমরা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছ আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণবল্লভকে তোমরা আশ্রয় দিয়েছ, বাংলার মসনদে বসবার পর আমাকে তোমরা নজরানা পর্যন্ত পাঠাওনি। তোমরা কি ভেবেছ এইসব অনাচার আমি সহ্য করব?
ওয়াটস : আমরা আপনার অভিযোগের কথা কাউন্সিলের কাছে পেশ করব।
সিরাজ : তোমাদের ধৃষ্টতার জবাবদিহি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে তোমাদের বাণিজ্য করবার অধিকার আমি প্রত্যাহার করছি।
ওয়াটস : কিন্তু বাংলাদেশে বাণিজ্য করবার অনুমতি দিল্লি বাদশাহ আমাদের দিয়েছেন।
সিরাজ : বাদশাকে তোমরা ঘুষের টাকায় বশীভূত করেছ। তিনি তোমাদের অনাচার দেখতে আসেন না।
হলওয়েল : ইওর এক্সিলেন্সি নবাব আলিবর্দি আমাদের বাণিজ্য করবার অনুমতি দিয়েছেন।
সিরাজ : আর আমাকে তিনি যে অনুমতি দান করে গেছেন তা তোমাদের অজানা থাকবার কথা নয়। সে খবর অ্যাডমিরাল ওয়াটসন কিলপ্যাট্রিক, ক্লাইভ সকলেরই জানা আছে। মাদ্রাজে বসে ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটির সঙ্গে যে পত্রালাপ করে তা আমার জানা নেই ভেবেছো? আমি সব জানি। তবু তোমাদের অবাধ বাণিজ্যে এ পর্যন্ত কোনো বিঘ্ন ঘটাইনি। কিন্তু সদ্ব্যবহার তো দূরের কথা তোমাদের জন্যে করুণা প্রকাশ করাও অন্যায়।
ওয়াটস : ইওর এক্সিলেন্সি আমাদের সম্বন্ধে ভুল খবর শুনেছেন। আমরা এ দেশে বাণিজ্য করতে এসেছি। উই হ্যাভ কাম টু আর্ন মানি। এ্যান্ড নট টু গেট ইনটু পলিটিক্স। রাজনীতি আমরা কেন করব।
সিরাজ : তোমরা বাণিজ্য কর? তোমরা কর লুট। আর তাতে বাধা দিতে গেলেই তোমরা শাসন ব্যবস্থায় ওলটপালট আনতে চাও। কর্ণাটকে, দাক্ষিণাত্যে তোমরা কী করেছ? শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করে অবাধ লুটতরাজের পথ পরিষ্কার করে নিয়েছ। বাংলাতেও তোমরা সেই ব্যবস্থাই করতে চাও। তা না হলে আমার নিষেধ সত্ত্বেও কলকাতার দুর্গ-সংস্কার তোমরা বন্ধ করনি। কেন?
হলওয়েল : ফরাসি ডাকাতদের হাত থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে চাই্
সিরাজ : ফরাসিরা ডাকাত আর ইংরেজরা অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি, কেমন?
ওয়াটস : আমরা অশান্তি চাই না, ইওর এক্সিলেন্সি
সিরাজ : চাও কি না চাও সে বিচার পরে হবে। রায়দুর্লভ।
রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা!
সিরাজ : গভর্নর ড্রেকের বাড়িটা কামানের গোলায় উড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিন। গোটা ফিরিঙ্গি পাড়ায় আগুন ধরিয়ে ঘোষণা করে দিন সমস্ত ইংরেজ যেন অবিলম্বে কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। আশপাশের গ্রামবাসীদের জানিয়ে দিন তারা যেন কোনো ইংরেজের কাছে কোনো প্রকারের সওদা না বেচে। এই নিষেধ কেউ অগ্রাহ্য করলে তাকে গুরুতর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
রায়দুর্লভ : হুকুম, জাঁহাপনা।
সিরাজ : আজ থেকে কলকাতার নাম হলো আলিনগর। রাজা মানিকচাঁদ, আপনাকে আমি আলিনগরের দেওয়ান নিযুক্ত করলাম।
মানিকচাঁদ : জাঁহাপনার অনুগ্রহ।
সিরাজ : আপনি অবিলম্বে কোম্পানির যাবতীয় সম্পত্তি আর প্রত্যেকটি ইংরেজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নবাব তহবিলে বাজেয়াপ্ত করুন। কলকাতা অভিযানের সমস্ত খরচ বহন করবে কোম্পানির প্রতিনিধিরা আর কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এখানকার প্রত্যেকটি ইংরেজ।
মানিকচাঁদ : হুকুম, জাঁহাপনা।
সিরাজ : (উমিচাঁদের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে) আপনাকে মুক্তি দেওয়া হলো, উমিচাঁদ।
(উমিচাঁদ কৃতজ্ঞতায় নতশির)
আর (মিরমর্দানকে) হ্যাঁ, রাজা রাজবল্লভের সঙ্গে আমার একটা মিটমাট হয়ে গেছে। কাজেই কৃষ্ণবল্লভকেও মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করুন।
মিরমর্দান : হুকুম জাঁহাপনা।
সিরাজ : হলওয়েল।
হলওয়েল : ইওর এক্সিলেন্সি।
সিরাজ : তোমার সৈন্যদের মুক্তি দিচ্ছি, কিন্তু তুমি আমার বন্দি। (রায়দুর্লভকে) কয়েদি হলওয়েল, ওয়াটস আর কলেটকে আমার সঙ্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে আমি তাদের বিচার করব।
রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা।
(সিরাজ-বেরিয়ে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবাই মাথা নুইঁয়ে তাঁকে কুর্নিশ করল।)
[দৃশ্যান্তর]
loading...
loading...
দৃশায়ণ এর চাইতে ইতিহাসের অংশটুকু পুনরায় পড়তে পেরে ভালো লেগেছে।
loading...
সুন্দর মন্তব্যে আপ্লুত হলাম। ঈদ মোবারক।
পবিত্রতম ঈদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
জয়গুরু!
loading...
ভারতসূর্য ডুবে যাবার ঘটনা সমূহ আমি যতবার পড়ি আমার দুঃখ হয়। মাত্র গুটি কয়েক লোক আর প্রাসাদীয় গম্ভীর ষড়যন্ত্র আমাদের দুশো বছর পরাধীন করে ফেললো। পিছিয়ে দিলো শত সহস্র বছর। আমাদের মনোবল ভেঙ্গে খান্ খান্ করে দিলো। ইতিহাস ওদের কখনও ক্ষমা করতে পারে না।
loading...
সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। সাথে থাকবেন। দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশের পথে।
ঈদ মোবারক। পবিত্রতম ঈদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
জয়গুরু!
loading...
আলেখ্য গীতি নাটকের দৃশ্যায়ন পড়লাম। ভালো হয়েছে ভান্ডারী দা।
loading...
সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। সাথে থাকবেন। দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশের অপেক্ষায়।
ঈদ মোবারক। পবিত্রতম ঈদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
জয়গুরু!
loading...
ভারতের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবন আলেখ্য গীতি নাটকের দৃশ্যায়ন।
loading...
ইদ মোবারক।
loading...
পড়লাম।
loading...