পালাকীর্তন ও বাউল গান সপ্তম অধ্যায়

পালাকীর্তন ও বাউল গান সপ্তম অধ্যায়

আজকের আলোচ্য বিষয় পালা কীর্তন ও শ্রী কৃষ্ণের বাল্যলীলা।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতে পূতনা, তৃণাবর্ত, বৎসাসুর ও বকাসুর বধ:

নন্দরাজ ছেলের জাতোৎসব সমাপন করে গোপদিগকে গোকুল রক্ষার ভার দিয়ে কর প্রদানের জন্য মথুরায় গমন করলেন।নন্দরাজ আসার সংবাদ পেয়ে বসুদেব নন্দরাজের সাথে সাক্ষাত করলেন। তাদের মধ্যে কুশল বিনিময় হলো। নন্দরাজবসুদেবকে সান্তনা দিয়ে দু:খ না করে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা কথা বললেন। বসুদেবন বললেন,” কংসরাজের কর প্রদান করাহয়েছে। এখানে আপনার আর থাকার প্রয়োজন নেই। গোকুলের অবস্থা ভাল নয়। শ্রীঘ্র প্রস্থান করাই উত্তম। তারপর নন্দরাজবৃষবাহ্য শকটে করে গোকুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। যাত্রা পথে নন্দরাজ স্মারণ করলেনবসুদেবের বচন মিথ্যা হয় না।অজানা আশংকায় নন্দরাজের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠল।বসুদেবের বচন সত্য হলো। কংস কর্তৃক প্রেরিত হয়ে পূতনা রাক্ষুরী গোকুলে প্রবেশ কর। মায়াযোগে পূতনা নিজেকে একঅপরূপা নারীতে পরিণত করল। ফলে যে কোন গৃহে প্রবেশ করা তার পক্ষে অসম্ভব বিষয় ছিল না। তার রূপ ও হাসি দিয়েব্রজবাসীদের হৃদয় হরণ করল। তাকে বাঁধা দেয়ার মত কোন শক্তিই যেন তাদের ছিলনা। পূতনা অন্দরে প্রবেশ করে ঐবালকটি অন্বেষণ করতে লাগল। পরিশেষে নন্দরাজের গৃহে শিশুটিকে দেখতে পেল। শিশুরূপী ভগবান ঠিকিই জানলেন এ তোনারী নহে! এ তো শিশুহন্তাকারী। তাই তিনি চক্ষু নিমীলন করে রইলেন। তারপর পূতনা রাক্ষুরী আদর করে তাকে ক্রোড়ে তুলেপরম সোহাগে বিষ মাখানো স্তন পান করাতে লাগলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে পূতনা রাক্ষুরীর স্তন এমনভাবে দলিত,মথিত করতে লাগল যে, পূতনা তা সহ্য করতে পারছিলনা। তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মৃত্যু যন্ত্রনায় হাত পা ছুড়তে লাগল।দুই চক্ষু রক্ত বর্ণ হয়ে বের হয়ে আসছে। পূতনা রাক্ষুরীর মৃত্যু যন্ত্রনার শব্দ শ্রবণ করে আকাশ পাতার প্রকম্পিত হচ্ছে। মৃত্যুরসময় পূতনা ছলনার আশ্রয় ছেড়ে নিজস্ব মূর্তি ধারণ করল। পূতনার দেহ অতিশয় ভয়ানক ছিল। তার দেহ দর্শন করে গোপগণভীত হলো। কিন্তু মৃত রাক্ষুরীর বক্ষের উপর শিশুটি ক্রীড়ারত দেখে শশব্যস্ত হয়ে যশোদা ও রোহিনী যুগপৎ ছুটে এসে ছুঁ মেরেশিশুটিকে তুলে নিল। গোপীনারা শিশুটির রক্ষার জন্য অনেক স্তুতিবাক্য প্রয়োগ করল। তারপর মাতা যশোদা তনয়কে স্তন পানকরিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ঠিক এ সময় নন্দরাজ মথুরা থেকে ব্রজে আগমন করলেন। আসার পথে পূতনার বিরাট দেহ তারাদেখতে পেলেন। নন্দরাজ উপলদ্ধি করলেন বসুদেবের কথা। তারপর গোপরা সকলে মিলে পূতনার দেহ খন্ড খন্ড করে দাহ করল। ব্রজবাসীগণ বিস্মিত হলেন যে চিতা হতে চন্দন তুল্য সুরভি ছড়াতে লাগল। তার কারণ শ্রীকৃষ্ণ পূতনার দেহে ভোজনকরেছিলেন; তার ফলে তার সমস্ত পাপ মুক্ত হলো।শকট ভঞ্জন: নন্দালয়ে অঙ্গ পরিবর্তন উৎসবে বিরাট মহোৎসবের আয়োজন চলছে। গোপীনিদের আগমন ঘটল। যশোদা তাদের নিয়ে গীত ও ব্রাহ্মণ মন্ত্রবাচন দ্বারা সুমঙ্গল করে শিশুর অভিষেক করলেন। তারপর ব্রাহ্মণ ভোজন ও সামগ্রী দান করেতাদের পূজা করলেন। শিশুর নয়নে ঘুম ঘুম ভাব দেখে যশোদা তাকে কোলে করে একটি শকটের নীচে শুইয়ে দিলেন।শকটের নীচে শিশু রোদন করছে তা কারো কর্ণপাত হলো না। স্তন না পেয়ে বালক তার পা যুগল উর্ধ্বদিকে উত্থিত করল।কোমল পায়ে ছোঁয়ায় শকটটি উর্ধ্বদিকে উঠে নীচে পড়ে আশে পাশের যে পাত্র ছিল তা ভঙ্গ হল। যশোদা ও ব্রজনারী যারা এ অনুষ্ঠানে এসেছিলে তারা ঘটনা অবলেকন করে বিস্ময়াভূত হলেন। তারা পরস্পরের মধ্যে আলোচনাকরতে লাগল কিভাবেশকটটি ঊর্ধ্বে উঠে উল্টিয়ে গেল। তারা কেহ বিশ্বাস করতে পারছে না যে ঐ কর্মটি শিশুটিই করেছে। কিন্তু ঐ শিশুর যে অনন্তশক্তি তা তো গোপগণ জানে না। যশোদা মাতা ক্রন্দনরত শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে এলো। শিশুর মঙ্গল কামনায় যশোদামাতা ব্রাহ্মাণ ভোজন, দান করলেন।

তৃণাবর্ত বধ:
একদিন যশোদা মাতা পুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে আদর করছিলেন। কেন জানি হঠাৎ যশোদা মাতার মনে হলো তারপুত্রটিকে পাহাড়সম ভার মনে হচ্ছে। তিনি তাকে ক্রোড়ে রাখতে পারছেন না। তাই তিনি পুত্রকে মাটিতে রেখে অজানা আশংকাথেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মহাপুরুষের ধ্যান করতে লাগলেন। ঠিক এ সময়ে কংসের আদেশে তৃণাবর্ত নামক এক ভীষণ দৈত্যএখানে এসে শিশুটি হরণ করল। তৃণাবর্ত চক্রাকালে সমস্ত ব্রজধামকে আন্দোলিত করতে লাগল। ধূলির ঘুর্ণনে চারিদিকঅন্ধকার হয়ে গেল। যশোদা মাতা যেখানে পুত্রকে রেখেছিলন সেখানে পুত্রকে না পেয়ে রোদন করতে লাগল। যখন ধূলি ঘূর্ণনকমল তখন যশোদা মাতার ক্রন্দন শুনে ব্রজবাসীগণ দ্রুত আসলেন। কিন্ত শিশুটি তারা দেখতে পেলেন না। আর যশোদা মাতাআর্ত্তস্বরে রোদন করছেন। এদিকে তৃণাবর্ত চক্রবায়ুর রূপ ধারণ করে শ্রীকৃষ্ণকে হরণ করে নিয়ে চলল। কিন্তু ভূভার হওয়ারফলে তার বেম কমতে আরম্ভ করল। আকাশ পথ অতিক্রম করার পর সে আর যেতে সমর্থ হলো নাএ বালককে তার পর্বততুল্য মনে হতে লাগল। ঐ বালক তার গলদেশে অবস্থান নিয়ে ছিল; তাকে ত্যাগ করতে ইচ্ছা করলেও তা পারল না। অচিরেইতার চক্ষু বাহির হয়ে এলো। অব্যক্ত ধ্বনি করতে করতে বালকসহ ব্রজ ভূমিতে নিপতিত হলো। শিলা তলে পতিত হওয়ায়দানবের সমস্ত শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেল। তারপর ব্রজবাসীগণ বোদন করতে করতে যেখানে দৈত্য আছড়িয়ে পড়েছিলসেখানে আসল। তারা শ্রীকৃষ্ণকে তার বক্ষস্থল হতে তুলে নিয়ে মা যশোদার কাছে দিল। এ রকম ভয়ানক দানব হতে বালকনিরাপদে ফিরে এসেছে দেখে ব্রজবাসী সকলেই স্বস্তিবোধ করল এবং আনন্দে আত্মহারা হলো।

বৎসাসুর বধ ( কৌমার লীলা):
গোকুলে দৈত্য দানবের উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় গোপগণ উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ল। একদিনগোপগণ একত্রে মিলিত হয়ে নন্দালয়ে আসলেন। নন্দারাজ সহ সকলে পরামর্শ করতে লাগল কিভাবে এ উৎপাত থেকে রক্ষাপাওয়া যায়। গোপদের মধ্যে উপানন্দ বয়সে জ্যেষ্ঠ এব বুদ্ধিমান। তিনি রামকৃষ্ণের হিতকামনায় বলতে লাগলেন,” গোকুলেরকল্যাণের জন্য আমাদের এ স্থান ত্যাগ করা উচিৎ। কারণ ক্রমান্বয়ে উৎপাত বেড়েই চলছে। পূতনার হাত হতে বালকটি মৃত্যুরহাত হতে রক্ষা পেয়েছে। ভগবান শ্রীহরির কৃপায় শকট ভেঙ্গে পড়ার পরও আমাদের বাছাধন রক্ষা পেয়েছে। তৃণাবর্তের হাতহতে আমাদের বালক কেবল ভগবানের কৃপায় রক্ষা পেয়েছে। যমলার্জুন ভেঙ্গে পড়ার পরও বালক শ্রীহরির কৃপায় রক্ষাপেয়েছে। সুতরাং আর কোন উৎপাত ঘটার পূর্বেই আমাদের এ স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র যাওয়া খুবই আবশ্যক। বৃন্দাবন,বৃন্দাবন নামক বন পশু সকলের জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর। সেখানে প্রচুর নবীন বন আছে, পবিত্র পর্বত আছে, প্রচর +তৃণ ও লতাআছে, তৎস্থল গোপগণের উপযুক্তই হবে। আর সময় নষ্ট না করে আমাদের অতিশ্রীঘ্রই বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা উচৎ।সকলে শকট তৈরী কর।” উপানন্দের কথা সকলে সায় দিলেন। যথা সময়ে নিজ নিজ শকট তৈরী করে তার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অরোপিত করল। গো-বৎস অগ্রে দিয়ে সারি সারিস শকটে ব্রজবাসীগণ তূর্যধ্বনিসহ শিঙ্গা বাজাতেবাজাতে লাগল। গোপীনিগণ আনন্দে চিত্তে কৃষ্ণলীলা গীত আরম্ভ করল। গোপীগণ নানা আভরণে ভূষিত ছিল। শরীরে কুম্কুমবিলেপিত থাকায় তাদেরকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। পোষাক-পরিচ্ছদ ছিল পরিপাটি। তারপর যশোদা ও রোহিনী রামকৃষ্ণসহ শকটেআরোহণ করল। গোপীগণ গোকুলের বসতি স্থাপন করল বৃন্দাবনে। বৃন্দাবন সব সময়ইসুখময়। গোবর্ধন পর্বত, যমুনা নদীঅবলোকন করে রামকৃষ্ণের মনে প্রীতি জন্মিল। একদা রাম ও কৃষ্ণ যমুনা নদীর তীর অন্যান্য গোপবালকদের সাথে বৎসচড়াতে ছিল। হঠাৎ করে একটি দৈত্য তাদের হিংসা করার বাসনায় এখানে উপস্থিত হলো। বৎসরূপধারী সেই দৈত্যকে বৎসযুধমধ্যে (গরুর পালের মধ্যে) দেখে বলরামকে দেখিয়ে দিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এমন ভান করলেন যেন তিনি কিছুই জানেতে পারেনি; ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৎসাসুরের পিছনের পা দুটি ও লেজ একত্রে করে এমনভাবে কিছুক্ষণ চক্রাকারে ঘুরালেন যাতে তার প্রাণ নিগত হয়। তারপর মৃত প্রায় করে বেল গাছের দিকে নিক্ষেপ করলেন। পরে গতাসু(মৃতপ্রায়)বৎসাসুরকে কপিথ বৃক্ষের উপর নিক্ষেপ করলেন। বৎসাসুরের বিশাল দেহের ভাবে ঐ বৃক্ষ ভেঙ্গে পড়ল এবং সাথে সাথে বৎসাসুরের দেহ ভূমিতে পতিত হলো। গোপবালকগণ মৃত বৎসাসুরের বিশাল দেহ দেখে বিস্মিত হলো এবং সাধূ সাধু বলতে লাগল।সুরলোক হতে অমর নিকরগণ পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগল।

বকাসুর বধ (কৌমরা লীলা):
একদিন রাম ও কৃষ্ণ প্রাতরাশ সাথে নিয়ে গোপবালকসহ বৎসসকলকে জল পান করানোর জন্য জলাশয়ের নিকট গেল; বৎসদের জল পান করিয়ে নিজেরাও জল পান করল। তখন হঠাৎ গোপবালকগণ অদূরেই একটি পবতসম পাখি দেখতে পেল। পাখিটি আকারে প্রকান্ড ছিল। তার ঠোট ছিল তীক্ষ্ণ। পাখিটি দেখে বালকগণ ভয় পেল। সেটি পাখি নয় পাখিরুপধারী একটি মহাসুর যার নাম বকাসুর। সে অসুর কৃষ্ণকে দেখামাত্রই দ্রুত বেগে এসে তাকে গিলে ফেলল। গোপবালকগণ এ দৃশ্যে দেখে অচেতন হলো। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বকের মুখে মধ্যে অবস্থিত হয়ে অগ্নির ন্যায় বকের তালুমুল দগ্ধ করতে লাগল। তৎক্ষণাৎ তাকে বমন করে ফেলল। তারপর কৃষ্ণকে অবিক্ষত দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ঠোট দ্বারা আঘাত করার জন্য পুনরায় অক্রমন করল। তারপর শ্রীকৃষ্ণ দুই বাহু দ্বারা ঠোটদ্বয় ধারণ করে বালকগণের সম্মুখে ধীরণবৎ (তৃণের ন্যায়) বিদারণ করে ফেলল। সে সময়ে সুরলোকবাসী সমুদ্বয় লোক, নন্দন-কাননের মল্লিকাদি পুষ্পসকল বকশত্রু শ্রীকৃষ্ণের উপর বষণ করতে লাগল এবং শঙ্খ ও দুন্দভি ধ্বনি ও বিবিধ স্তোত্র দ্বারা স্তব করতে দেখে গোপবালকগণ যার-পর-নাই বিস্মিত হলেন।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বকাসুরের মুখ হতে বের হয়ে আসতে দেখে গোপবালকগণ খুশীতে আলিঙ্গন করল। ব্রজে আগমন করে গোপবালকগণ সকলকে এ ঘটনা বলল।

অঘাসুর বধ (কৌমার লীলা):
একদিন বনে ভোজনের ইচ্ছা পোষণ করে শ্রীকৃষ্ণ প্রাত:কালে সকল গোপবালককে জাগ্রত করে বৎসসকলকে যুথবদ্ধ করে গোষ্ঠে গমন করল। বৎস চড়াতে চড়াতে বালকগণ নানাবিধ ক্রীড়া করতে লাগল।বালকদের এরম সুখক্রীড়া দেখে অঘাসুর নামে এক মহাসুর তথায় উপস্থিত হলো।অঘাসুর পূতনা ও বকাসুরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা।কৃষ্ণসহ গোপবালকগণকে দেখে অঘাসুর মনে মনে ভাবল- কৃষ্ণই আমার ভগ্নী পূতনা ও ভ্রাতা বকাসুরকে বধ করেছে। আমি আমি সকল বালকসহ কৃষ্ণকে বধ করব।অঘাসুর নিজেকে অজগর সাপে পরিণত করল এবং তার বিশাল দেহে পবতের গুহাসদৃশ বদন প্রসারিত করে রইল।সপরুপী অঘাসুরকে দেখে বালকদের মধ্যে অনেকে ভয় পেয়ে পালাতে আরম্ভ করল। কিন্তু তাদের আশ্বাস দিয়ে অন্য বালকের বলল- এটি একটি প্রাকৃতি শোভা-সম্পদ। তবে দেখতে অনেকটা অজগর সাপের মত। আমাদেরকে গ্রসা করলে কৃষ্ণ আমাদেরকে রক্ষা করবে এবং বকাসুরের মত অঘাসুকেও বধ করবে।ইহা মনে করে ভগবানের কমনীয় মুখ স্মরণ করে হাসিতে হাসিতে ব্রজ বালকগণ অগ্রে গমন করল।এদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপবালকগণের কথা স্মারণ করে বুঝলেন এটি অজগর সাপ কিন্তু বালকদের কাছে অজগর সদৃশ বলে মনে হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকল বালক বৎসসহ অজগরের উদরে প্রবেশ করল কিন্তু অজগর সাপ এদেরকে গিলে ফেল না। কারণ সে শ্রীকৃষ্ণের প্রবেশের অপেক্ষা করছে। অঘাসুর ইচ্ছা করলেই বালকগণকে গলাদকরণ করতে পারত কিন্তু তাহলে কৃষ্ণকে গলাদকরণ করতে পারবে না। কৃষ্ণ জেনে যাবে, সে জন্যেই অসুর বালকগণকে গলাদকরণ করেনি। কিন্তু অঘাসুর তো আর জানে না বালক কৃষ্ণকে।খলের জীবন হানি ও সাধুর জীবন রক্ষা এরুপ চিন্তা করে কৃষ্ণ অঘাসুরের মুখে প্রবেশ করলেন। তখন দেবতাগণ হাহাকার করতে লাগল আর রাক্ষসগণ আনন্দ করতে লাগল।তারপর কৃষ্ণ নিজের শরীর দ্রুত বর্ধিত করল। ফলে অঘাসুরের মুখাদির সকল পথ নিরুদ্ধ হলো, চক্ষুদ্বয় বাহির হয়ে গেল। তার দেহের মধ্যে বায়ু পূণ হয়ে গেল এবং ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে বর্হিগত হলো। সেই ছিদ্রপথে সকল ইন্দ্রিয়সকল বাহির হলো।মৃত বালকগণকে ও বৎসগণকে নিজের অমৃতবর্ষিণী দৃষ্টি দ্বারা জীবন দান করলেন। সর্পের স্থূল দেহস্থ শুদ্ধ সত্ত্বময় অদ্ভূত মহৎ জ্যোতি স্বীয় তেজে দশ দিক উজ্জ্বল করে ভগবানের বিনিগম প্রতীক্ষায় আকাশে দশনকারী দেবগণ সমক্ষে তা সেই শ্রীকৃষ্ণকে গিয়ে প্রবেশ করল।তারপর দেবতাগণ আনন্দিত হয়ে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। অঘাসুর অসুর হয়েও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্পর্শে পূতনার ন্যায় মুক্তি লাভ করল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা কথামৃত শ্রবণ করলে পাপ ক্ষয় হয়।
(সংকলিত)

পালাকীর্তন ও বাউলগান সপ্তম অধ্যায়

বাউল উত্সনবে, দশ বারো জন বাউল শিল্পী পর পর মঞ্চে এসে গান করে নেমে যাওয়ার পর, ঘোষিকার কন্ঠে “এবার মঞ্চে আসছেন শ্রী পূর্ণ….” বলতেই, শ্রোতার অবিশ্রান্ত হাততালির শব্দে, ঢাকা পড়ে যায় তাঁর ঘোষণা। নড়ে চড়ে বসেন অনেকেই, কেউ কেউ ফিসফিস করে ওঠেন, “আসলে অনুষ্ঠানটা শুরুই হচ্ছে এখন” ।

এজন্যই তিনি অগ্রদূত, তিনি প্রবাদপ্রতিম, তিনি কিংবদন্তী, তিনি বাউল সম্রাট “ পূর্ণ চন্দ্র দাস ”।
বিশ্বের দরবারে, গ্রাম বাংলার বাউল গানের যে পরিচিতি, তার কৃতিত্ব এই মহান শিল্পীরই। বহুবার বহুদেশে তিনি অনুষ্ঠান করতে গেছেন। শুধু আমেরিকাতেই গেছেন আটচল্লিশ বার, ওখানে তৈরী হয়েছে “বাউল একাডেমি”। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী, যাঁরা বর্তমান প্রজন্ম, ওখানে বাউল গান শেখেন। তবে, এদেশে কেন তিনি এটা করলেন না, সে ব্যাপারে বিস্তৃত আলোচনায় যাবো না।

“পূর্ণ দাস বাউল” ছাড়াও ভারতে এবং বাংলাদেশে অনেক বিশিষ্ট “বাউল গান”,”লোকগীতি”র গায়ক, গায়িকা আছেন এবং তাঁরা ও বিভিন্ন জায়গায় এসব গানের মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন, গানের প্রচারে চেষ্টা চালিয়ে যান, তবু ও বাউল গানের ক্ষেত্রে “পূর্ণদাস”ই অগ্রদূত। “অগ্রদূত” বলার কারণ, একসময়ে প্রচণ্ড দারিদ্রের সাথে লড়াই জারি রাখতে, তিনি ট্রেনে এক কামরা থেকে আর এক কামরায়, ঘুরে ঘুরে, বাউল গান গেয়ে, অর্থ সংগ্রহ করেন, তখন তাঁর পেশা হয়ে উঠে “ভিক্ষাবৃত্তি”। সেটা দেখেই শুরু হয়, ট্রেনে গান করে অর্থ সংগ্রহের রেওয়াজ, তিনি বিদেশে যান অনুষ্ঠান করতে, সেটা দেখে শুরু হয় বিদেশে গিয়ে বাউল গানের অনুষ্ঠান করার চল, তিনি যেমন পোশাক পড়ে, মঞ্চে আসেন, চালু হয়ে যায়, সেরকম পোশাক পড়ে মঞ্চে হাজির হওয়া, এসবই অনুকরণ করা যায়, কিনতু, অনুকরণ করা যায় না যেটা, সেটা হচ্ছে তাঁর গলার আওয়াজের স্বতন্ত্রতা, স্বরের দ্যুতির যে অসাধারণ বিচ্ছুরণ তিনি ঘটান, সেটা অনুকরণ করা যায় না, বা হয়তো যাবেও না কোনোদিন চেষ্টা করেও।

শহরাঞ্চলে সেরকম ভাবে না হলেও, আজ ও গ্রামাঞ্চলে বাউল, ভাটিয়ালী, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া এসব গান শোনা যায়।
আগে এসব গান যাঁরা করতেন, তাঁরা গান কে একটা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতেন, নিজেকে জানা অর্থাত্‍ আত্মপোলব্ধি তথা সমাজের কল্যাণে যে শিক্ষা কাজে লাগে, তারই বার্তা দিয়ে যেতেন এসব গানের মাধ্যমে । ফলে, এসব গান তাঁদের জীবনে “সাধনা” হয়ে উঠতো । জীবন যাপনের ধারা, মানসিক বৃত্তি, গান, সবকিছু সামগ্রিকভাবেই সাধনার স্তরে বিরাজ করতো । ফলে তখন তাঁদের বলা হতো “সাধক বাউল”। কিনতু, ধীরে ধীরে এই “সাধক বাউল” হয়ে উঠেন “শিল্পী বাউল”। সাধনার পথ তখন পরিবর্তিত হয়, নিজেকে শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার পথে । ফলে, এসব গানের মুখ্য উদ্দেশ্য অনেকটাই বিপন্ন হয়ে পড়ে । আত্মপ্রচার তথা লোকের মনোরঞ্জন করাই প্রাধান্য পেয়ে যায়। বাউল গান, লোকগীতি, ফকিরি, ভাওয়াইয়া এসব তখন “সমাজে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা” থেকে দূরে সরে আসে অনেকটাই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে উঠে শিল্পীর আত্মপ্রচার এর মাধ্যম। এভাবেই এই জাতীয় গানগুলির ব্যাপ্তি সংকুচিত হতে শুরু করে।

অনেক নিত্য নতুন সঙ্গীত শিল্পীর আগমন ঘটছে, কিনতু বর্তমান প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার মতো, লোকগীতি, বাউল গানের শিল্পী থাকলেও, সংখ্যায় খুব কমই । পরিস্থিতি যেমনই থাক, ব্যস্ততা যতোই থাক, মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো বাউল গান বা লোকগীতি হলে, বর্তমান প্রজন্মও এই গানে আকৃষ্ট হবেন আশা করা যায়। ঠিক যেমনটি ঘটে বিদেশের বর্তমান প্রজন্মের ক্ষেত্রে। সবকিছুকে একপাশে সরিয়ে রেখে, কিছুটা সময় বের করেই নেন, আমাদের এই গ্রাম বাংলার গানকে শেখার জন্য, শোনার জন্য। ওখানে, স্কুলের, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নিয়ম করেই শেখেন এসব । আর তার জন্যই তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে তৈরী করেন “বাউল একাডেমী”, “লোকগীতি শিক্ষা কেন্দ্র”।

এ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধা জানাতে হয়, “আনন্দ গোপাল দাস বাউল”কে যিনি প্যারিসে স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ম করেই শেখান “ কানাই, পার করে দে আমারে”, বপন করে যান, বিদেশের রক্ত মজ্জায় অস্থিতে, গ্রামবাংলার এই চিরায়ত লোকসংস্কৃতির “বীজ”টি।

আমাদের দেশে এরকম টা সেভাবে হয় না। যে নিষ্ঠা এবং শ্রদ্ধা এই গানের প্রতি জাগরূক হওয়া দরকার, সেটা হয় না। কারণ ? কারণ, গেরুয়া পাঞ্জাবী, গলায় তুলসী মালা, কপালে চন্দন, পায়ে নুপুর, হাতে খমক নিয়ে যে বাউল শ্রোতার মনে আশা জাগিয়ে, মঞ্চে উঠেন, শুরু করার আগে “বাউল গান হচ্ছে আমাদের পরম্পরা”, বলে নিয়ে, শুরুটাই করেন, “রেললাইনে বডি দেবো, মাথা দেবো না” দিয়ে।

“বাউল” গান করতে গিয়ে যে “ফাউল” টা করে ফেলেন, সেটা বুঝতেই পারেন না। মঞ্চ, ধ্বনি, আলো, বাহ্যিক বাউলরুপী পোশাক আশাক, সবাই তখন একে অন্যকে জিজ্ঞেস করে, “বাউল গান কি ? বাউল তো ?” প্রশ্ন ওঠে “ গেরোয়া পোশাক পড়লেই, “বাউল” হওয়া যায়” ?

গ্রামবাংলার এই অমূল্য রত্নের ভাণ্ডারকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে আকর্ষনীয় করে তোলার ক্ষেত্রে কোনো কোনো স্তরে বিভিন্ন রকমের উদ্যোগ নেয়া হয় বা হচ্ছে। অনেক শিল্পী আছেন, যাঁরা হয়তো মনে প্রাণেই সেই চেষ্টাটাই চালিয়ে যান। তবে, “উদ্যোগ” এর খুব একটা তেমন প্রয়োজন হবে না, কারণ,“সৃষ্টি” যদি “অনুপম” হয়, তার প্রচারের জন্য উদ্যোগের প্রয়োজন হয় না। লোকের মুখে মুখে, নিজে থেকেই সেই সৃষ্টি স্বমহিমায়ই বেঁচে থাকে।

ওই “রেললাইনে বডি ফেলে দিয়ে, মাথাটাকে সাইড করে রাখার” বা “মাউথ পিস স্ট্যান্ড” নিয়ে মঞ্চে, “যে জন প্রেমের ভাব জানেনা” বলে চিল্লাচিল্লি করে, দক্ষযজ্ঞ করার মতো বাহাদুরি করে, প্রমাণ করতে হয় না যে “আমি একজন শিল্পী” বা প্রমাণ করা যায় না, সত্যি সত্যি গ্রাম বাংলার এই লোকগীতি, বাউলগীতি, লালনগীতি এসব গান অমূল্য রতনেরই ভাণ্ডার।
“বাউল গান” গাইতে পারলে, গাওয়ার আগে “আমি বংশ পরম্পরায় বাউল” বলে গৌরচন্দ্রিকা রাখার দরকার হয় না, গান গাওয়ার দক্ষতাই জানিয়ে দেয় যে তিনি বংশ পরম্পরায় বাউল। “যে জন প্রেমের ভাব জানে না” গাইতে পারলে, “উল্লুকের ও থাকিতে নয়ন” বুঝানোর জন্য উল্লুকের মতোই মঞ্চ থেকে হাইজাম্প মেরে নীচে পড়তে হয় না, গানে শিল্পীর দক্ষতাই প্রাঞ্জল ভাবে বুঝিয়ে দেয় “উল্লুক কেন রবির কিরণ এর মাহাত্ম বোঝে না ?” ।

বেঁচে আছি প্রমাণ করার জন্য, মরে যাওয়ার দরকার হয় না, কারণ বেঁচে থাকাই জানান দেয় যে “মরি নাই”। আর এই জানানটা দেয়ার জন্য দরকার হয় তাঁদের। কাদের ? ওই যিনি প্রশ্নটা তুলেছেন, বা যাঁরা “মনসুর ফকির” এর গান শুনে বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়েও নির্বিদ্বিধায় মন্তব্য করেন,” কান পবিত্র হয়ে যায়, মন বিশুদ্ধ হয়ে যায়। জাতি, ধর্ম, দেশ, কাল সব একবিন্দু তে এসে মেশে” বা “এ গান শোনার জন্য বহু পথ হেঁটে আসা যায়”। কারণ, তাঁরা মনে প্রানেই বিশ্বাস করেন যে গ্রাম বাংলার এসব গান এখনো বেঁচে আছে এবং বাঁচিয়ে রাখাটা দরকার, বর্তমান তথা ভবিষ্যত্‍ প্রজন্মের স্বার্থেই।
ধন্যবাদ । সকলেই সাথে থাকবেন। জয়গুরু।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৫ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৫-০৭-২০১৯ | ১৮:৩৩ |

    শেয়ার করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  2. সুমন আহমেদ : ২৫-০৭-২০১৯ | ১৯:২১ |

    আজকের আলোচ্য বিষয় পালা কীর্তন ও শ্রী কৃষ্ণের বাল্যলীলা পড়লাম। আজকাল বড় লেখা দেখলে ভয় লাগে। পড়তে গেলে ক্লান্তি চলে আসে। ছোট লেখা চাই কবি। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  3. সাজিয়া আফরিন : ২৫-০৭-২০১৯ | ২০:০৫ |

    অভিনন্দন কবি। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ২৫-০৭-২০১৯ | ২০:১৪ |

    ২৫০৩ শব্দ। রহম্ করুন ভাণ্ডারী দা। মন্তব্য করছি ঠিকই তবে পড়িনি। Frown

    GD Star Rating
    loading...
  5. রিয়া রিয়া : ২৫-০৭-২০১৯ | ২০:৫৩ |

    অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...