যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-১০ (প্রথম খণ্ড)

যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-১০

‘যাত্রা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ গমন বা গমনার্থে পদক্ষেপ গ্রহণ। অতীতে কোন স্থানে গমন উপলক্ষে যেসব উৎসব করা হত তা বুঝাতে যাত্রা শব্দটির আবির্ভাব ঘটে। প্রাচীন ভারতে কোনো দেবতার উৎসব উপলক্ষে নৃত্যগীতপূর্ণ যে শোভাযাত্রা বের করা হতো তাকেও যাত্রা বলা হতো। অষ্টাদশ শতক থেকে যাত্রা বিশেষভাবে প্রসার লাভ করতে থাকে। এসময়ের যাত্রাজগতে শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবল দাস প্রভৃতি প্রসিদ্ধ নাম।বিশশতকের শুরুর দিকে বাংলার জনপ্রিয় যাত্রা লেখক ছিলেন মুকুন্দ দাস। তিনি যাত্রার ভেতর দিয়ে দেশাত্মবোধ, রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রাম ও সমাজ সংস্কারের কথা প্রচার করেন।

যাত্রাদলের উদ্যোক্তাকে বলা হয় ‘মালিক’ এবং এর সর্বময় কর্তাকে বলে ‘অধিকারি’। শিল্পী কলাকুশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারি মিলে প্রায় ৫০-৬০জন মিলে তৈরি হয় একটি যাত্রাদল।খোলা আসরে সোচ্চার কণ্ঠে গান, বাধ্যযন্ত্র ও অভিনয় সহযোগে যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে যাত্রায় আধুনিক বাদ্যযন্ত্র যেমন হারমোনিয়াম, তবলা, অর্গান, বাঁশি, বেহালা, কঙ্গো ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। যাত্রা সাধারণত গভীর রাতে শুরু হয়ে ভোর পর্যন্ত চলে। যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, যাত্রার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।

যাত্রা বাংলাদেশের এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের একটি ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় লোকনাট্য ধারা। ধর্মীয় বা অন্য কোনো উৎসবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি সেখান থেকেই যাত্রা শব্দের উৎপত্তি । উচ্চ শব্দ, চড়া আলো, অতি নাটকীয় ভাবভঙ্গি ও দৈত্যাকার মঞ্চে উপস্থাপন- যাত্রার মূল বৈশিষ্ট্য। বাংলার কৃষক, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমার রাতের পর রাত জেগে যাত্রার কাহিনী, অভিনয়, গানের মাধ্যমে লোকজ নীতিবোধ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব নিয়ে যাত্রা দেখেছে। ষোড়শ শতকে অভিনয় কলা হিসেবে যাত্রার উদ্ভব হলেও এর বিকাশ শুরু হয় অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। একবিংশ শতকের গোড়ার দিকেই নানাকারণে যাত্রা শিল্পের অগ্রগতি থমকে যায়।

শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ় , বঙ্গ , গৌড় , সমতট , পুণ্ড্র , হারিকেল , চন্দ্রদ্বীপ , শ্রীহট্ট সহ সমগ্র ভূখণ্ডে,পালাগান এবং পালার অভিনয় প্রচলিত ছিল। তখন শিবের গাজন, রাম যাত্রা, কেষ্ট যাত্রা, সীতার বারোমাসি, রাধার বারোমাসি ইত্যাদি প্রচলিত ছিল । সে সময় মূলত পৌরাণিক কাহিনী অভিনয় করে দেখানোর মধ্য দিয়েই যাত্রা শিল্পের শুরু হয়। রক্ষিণী হরণ নামক এক কৃষ্ণ যাত্রায় চৈতন্যদেব স্বয়ং রক্ষিণী চরিত্রে অভিনয় করতেন। যাত্রার ঐতিহ্য সংরক্ষনের ক্ষেত্রে কৃষ্ণকমল গোস্বামীর নাম গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৬০ সালে তার রচিত স্বপ্নবিলাস ও দিব্যউন্মাদ পালার মাধ্যমে যাত্রা নতুন প্রান পায় । তার রচিত পালা দুটো ১৮৭২ ও ১৮৭৩ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। ১৮৭৪ এ প্রকাশিত হয় তার রচিত বিচিত্র বিলাস যাত্রা পালা । এই তিনটি পালা নিয়ে গবেষণা করে নিশিকান্ত চট্টোপধ্যায় পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।

অষ্টাদশ শতকে, যাত্রা বাংলা ভূখণ্ডের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ে শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবলদাস ছিলেন যাত্রা শিল্পের নামকরা লোক। উনবিংশ শতাব্দিতে পৌরানিক কাহিনীভিত্তিক যাত্রা খ্যাতি পায়। উনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে দেশপ্রেমমূলক কাহিনীর অভিনয় শুরু হয়। এক্ষেত্রে সবচে প্রসিদ্ধ মুকুলন্দ দাস । তিনি যাত্রার মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজ সংস্কারমূলক বক্তব্য, যেমন- পণ প্রথা,জাতিভেদ এবং ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী বক্তব্য প্রচার করেন। তার প্রচলন করা স্বদেশী যাত্রার জন্য তাকে কারাভোগও করতে হয় । সে সময় যাত্রার মূল বিষয়গুলোতে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে এবং ধর্মীয় ও কল্পকাহিনী ছাড়াও যাত্রায় সামাজিক ও রাজনৈতিক কাহিনী জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। সে সময় ‘ইশা খাঁ’, ‘প্রতাপ চন্দ্র’, ‘বারো ভুঁইয়া’, ‘সোনাভান’, ‘সিরাজ উদ দৌলা’, ‘ক্ষুদিরাম’ ও অন্যান্য বিপ্লবীদের নামে কাহিনী অভিনয় হতে থাকে । এই সময়টাতেই, যাত্রা ‘ঐতিহাসিক’ এবং ‘রাজনৈতিক’ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

ব্রজেন্দ্র কুমার দে’কে বলা হয় ঐতিহাসিক পালার সার্থক রুপকার। ১৯৪২ সালে, তিনি রঞ্জন অপেরার জন্য লেখেন, কাল্পনিক পালা ‘রাজনন্দিনী’ । এই কাল্পনিক পালা থেকে ঐতিহাসিক পালার বিস্তার সম্পর্কে, তিনি লেখেন “আমার বর্ণিত স্বর্ণযুগে প্রথম যে পরিবর্তন এল তা হল কাল্পনিক পালার প্রবর্তন“। রঞ্জন অপেরায় অভিনীত ‘রাজনন্দিনী’র মাধ্যমে এর শুরু হয়। প্রথমদিকে, পালা পৌরাণিক ধাঁচে লেখা হত। যারা পালা রচনা করতে গিয়ে পৌরাণিক আখ্যান খুঁজে হয়রান হতেন, তাদের কাছে এক নতুন পথ খুলে গেল । যাত্রারসিকরা সঙ্গে সঙ্গে নতুন পদ্ধতিকে স্বাগত জানালেন । ক্রমে এই কাল্পনিক পালার প্রসার ঐতিহাসিক পালা রূপেও বিস্তৃত হল ।“ এছাড়াও ব্রজেন্দ্র কুমার দে’র ‘কলিঙ্গ বিজয়’ , ‘সুলতান রিজিয়া’ , ‘আধারে মুসাফির’ , ‘বর্গী এলো দেশে’ , ‘সোহরাব রুস্তম’ , ‘নবাব হোসেন শাহ্‌’ , ‘রাখীভাই’ , ‘হে অতীত কথা কও’ প্রভৃতি পালা সুখ্যাতি অর্জন করেছিল।
বাংলাদেশের যাত্রামঞ্চে সর্বাধিকবার মঞ্চস্থ হওয়া যাত্রাপালা, ‘নবাব সিরাজ উদ দৌলা’। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত নাটকটি লিখেছিলেন থিয়েটার মঞ্চের জন্য। এছাড়াও বাংলাদেশে যাত্রা শিল্পের অবদানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন, মহেন্দ্র নাথ গুপ্ত কানাই লাল শীল, শান্তি রঞ্জন দে, আনন্দময় বন্দোপধ্যায়, নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, চারুবিকাশ দত্ত, উৎপল দত্ত, ভৈরবনাথ গঙ্গপধ্যায়, জিতেন্দ্রনাথ বসাক, গৌড়চন্দ্র ভড়, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, বিপিন সরকার, কানাই লাল নাথ প্রমুখ । তারা প্রত্যেকেই তাদের রচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের যাত্রা শিল্পকে প্রসিদ্ধ করেছেন । দিগিচন্দ্র বন্দ্যোপধ্যায় রচিত দুরন্ত পদ্মা পালাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পালাটি রচিত হয় । এই পালাটি ‘সোভিয়েত দেশ নেহ্রু পুরস্কার” লাভ করে । এছাড়াও নিরাপদ মন্ডল রচিত ‘মুক্তিফৌজ’, সত্যপ্রকাশ দত্তের “ বঙ্গবন্ধু মুজিবুর” যাত্রা শিল্পে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিল রুপে সংরক্ষিত ।

সত্তর দশকের শেষ দিকে এবং আশির দশকে যাত্রা শিল্পে এক নতুন ধরণের পরিবর্তন শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে যাত্রাপালার সাথে জুয়া-হাউজি চালু হয়। ধারণা করা হয়, ১৯৭৮-৭৯ সালে এ ধরণের পরিবর্তন শুরু হয়েছে অধিক মুনাফা প্রত্যাশীদের মাধ্যমে। দেশ অপেরার মালিক মিলন কান্তি দে’র মতে, “ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে । যেখানে ৩০০ টির বেশি দল ছিল সেখানে এখন ৩০ টি দলও সংগঠিত হচ্ছে না । যাত্রা শিল্পের নেতারা জানান ১৯৭৫ সালের পর থেকেই যাত্রাপালা আয়োজনের ওপর বিধিনিষেধ আসতে থাকে –প্রশাসন এখন যাত্রার নামই শুনতে চায় না । যাত্রা শিল্পের সাথে জড়িত শত লেখক , শিল্পীর জীবন , জীবিকাও এখন ধ্বংসের পথে।“

বর্তমানে টিকে থাকা কিছু যাত্রা দল হল যশোরের আনন্দ অপেরা , চ্যালেঞ্জার অপেরা , অগ্রগামী নাট্য সংস্থা , মাগুরার চৈতালী অপেরা , নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথ যাত্রা সম্প্রদায় , কহিনূর অপেরা , খুলনার স্বদেশ অপেরা রাজমহল অপেরা , রঙমহল অপেরা , লক্ষীপুরের কেয়া যাত্রা প্রভৃতি । যাত্রা বাংলার লোকজ সংস্কৃতির মুল্যবান সম্পদ। তাই যাত্রাপালার ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পরুপ, জীবন-যাপন, কলা-কৌশল ইত্যাদি নিয়ে বিশদ গবেষণা ও পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

‘বিশেষ কোনও যাত্রা কোম্পানি কিংবা বিশেষ কোনও হিরো-হিরোইনের সাফল্যে বিভ্রান্ত হবেন না’, বললেন মঞ্জরী অপেরার নেপাল সরকার, ‘যাত্রাশিল্পের আয়ু আর বড় জোর কয়েক বছর। তার পর একে একে ঝাঁপ বন্ধ করবেন অনেক মালিক, ম্যানেজার। ডাউনফল শুরু হয়েছে অনেক দিন। চিৎপুরে ১০ বছর আগে যাত্রা কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৩৬। গত বছরেও ছিল ৬১টা। এ বার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮-এ। আমার মনে হয়, সামনের বছর যাত্রাদলের সংখ্যা হবে ২৫।’

বাংলার জল-মাটির আপন ঐতিহ্যে গড়া যে বিনোদন শিল্প, সেই যাত্রা নিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করে চলেছেন প্রভাত দাস। যাত্রা বাঁচবে? প্রশ্ন শুনে থমকে গেলেন প্রভাত। বললেন, ‘কী করে বাঁচবে বলুন? অন্ধকার রাতে বিশাল প্যান্ডেলের মধ্যে শয়ে শয়ে মানুষকে বসিয়ে রাখার মত গল্প কোথায়? মন মাতানো গল্প লেখার লোক কোথায়? একদা তেমন শক্তিশালী কলম নিয়ে ময়দানে এসেছিলেন ব্রজেন্দ্রকুমার দে। তাঁর উত্তরসূরি যদি কেউ হন, তিনি ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। তার পর? না, তেমন শক্তিশালী আর কেউ এলেন না। যাঁরা এলেন তাঁরা উপহার দিলেন কিছু নাচ-গান, হইহুল্লোড়। ব্যস, ওই দিয়েই ভাবলেন, বেশ সমসাময়িক করে তোলা গেল যাত্রাকে। ঘণ্টা! মানুষ শুনতে চায় গল্প। চরিত্র কিংবা আদর্শের সংঘাত। কেবল কিছু মানুষের স্টেজে হাঁটাচলা দিয়ে কিস্যু হবে না।’

মহাভারতে ভীষ্ম চোখের সামনে তিলে তিলে ক্ষয়ে যেতে দেখেছিলেন আস্ত এক রাজবংশ। বাঙালির যাত্রা শিল্পেও আছেন এক ভীষ্ম। ইন্ডাস্ট্রি তাঁর নাম দিয়েছে ‘বড়দা’। বড় ভাই নয়, প্রপিতামহ বলা যায় তাঁকে। বয়স ৮৩। তিনি মাখনলাল নট্ট। ঠিকানা শোভাবাজার। হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট। থাকেন যে বাড়িখানায়, তার বয়স সওয়াশো বছর, খসে পড়েছে পলস্তারা। সিঁড়িতে আলো নেই, দিনের বেলাতেই ঝুঁঝকো আঁধার। পা টিপে প্রায় হাতড়ে তিনতলায় উঠতে হল ভীষ্মের দেখা পেতে। ফোন করা ছিল। পৌঁছতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন নট্ট কোম্পানির মাখনলাল। কী জানতে চাই, তা শুনে চোখের দিকে সোজা তাকালেন।

বিড়বিড় করে বললেন, ‘যাত্রার বাঁচার আশা নেই।’ বলছেন একটা শিল্প নিয়ে। কিন্তু কণ্ঠস্বরে আবেগ শুনে মনে হল যেন নার্সিংহোমে আইসিইউ-তে শয়ান আত্মীয়ের খবর দিচ্ছেন। মাখনলাল দায়ী করলেন যাত্রা কোম্পানির মালিকদের। বললেন, ‘অব্যবসায়ীর হাতে ব্যবসা পড়লে ফল যা হয়, তা-ই হয়েছে। মালিকরা ধরে ধরে আনছেন টিভি সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের। কই, যাত্রার হিরো-হিরোইনদের তো সিরিয়ালওয়ালারা ডাকছেন না! যাত্রা-মালিকরা টিভির হ্যাংলামি ছাড়বেন না, তাই যাত্রাও আর বাঁচবে না।’

যাত্রাকে তা হলে বাঁচাবে কে? পুঁজি? একটু-আধটু হলেও, যাত্রা-পুনরুজ্জীবনে সহযোগিতার হাত কিন্তু বাড়িয়েছিল ব্যবসা সাম্রাজ্য। মাল্টিন্যাশনাল। তাঁদের প্ররোচনায় যাত্রার সংলাপে গুঁজে দেওয়া হচ্ছিল ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন। কী ভাবে? ধরা যাক, বৃদ্ধ স্বামী নিরুদ্দেশ। অনেক দিন পরে ঘরে ফিরলেন তিনি। তাঁকে দেখে ছুটে এলেন স্ত্রী। ‘ওগো কোথায় ছিলে?’ স্বামীর উত্তর, ‘সে অনেক কথা, পরে বলছি, আগে জল দাও।’ শুনে স্ত্রীর জবাব, ‘জল খাবে কেন গো, তোমার জন্য অমুক কোল্ড ড্রিংক আনছি!’ বা, বাচ্চা ছেলে অসুস্থ। তার মা স্বামীর উদ্দেশে বললেন, ‘ছেলিডারে এট্টু তমুক এনার্জি ড্রিংক খাওয়ানি লাগে। তা পাই কই?’ দরিদ্র স্বামী অনেক কষ্টে জোগাড় করে আনেন বলবর্ধক পানীয়টি এবং সারা স্টেজ ঘুরে স্ত্রীকে দেখাতে থাকেন। স্পটলাইটের আলো পড়ে বোতলের গায়ে ব্র্যান্ডের উপর। অবশ্য, বেশি দিন এগোয়নি এই ব্যবস্থা। মরা গাঙে যে আর কখনও বান আসবে না, সেটা বুঝে গিয়ে ব্র্যান্ড মালিকরা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন যাত্রা থেকে।

এখন কোনও আশ্চর্য নতুন এনার্জি ড্রিংক যাত্রাকে আবার চনমনে করে তুলবে, সে আশা কারও নেই। বাঙালির আদরের এক শিল্প, অতএব, এখন দাঁড়িয়ে লাস্ট সিনে।
যবনিকার অপেক্ষায়।

যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-১০

সামাজিক যাত্রাপালা

অনল চক্রবর্তী-কাকলি চৌধুরী এই মুহূর্তে যাত্রার উত্তম-সুচিত্রা। ওঁদের পালা নাকি ফ্লপ হয় না। কলকাতায় যাত্রা উৎসবেও ওঁদের শো হাউসফুল। অনল আবার আওড়ান না অন্যের লেখা সংলাপ। পালার কাহিনিকার তিনি। পরিচালকও তিনি। কেন? জবাবে অনল শোনান এক কাহিনি। বছর দশেক আগে, গাঁয়ের মাঠে বসেছে আসর। এগিয়েছে কয়েক সিন। নায়ক অনল গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন ডায়ালগ। হঠাৎ থার্ড রো-এ বসে এক ছোকরা হাত উচিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘বেশ বেশ অনলদা। দারুণ হচ্ছে। এর পরে তো রাজা হিন্দুস্তানি? বুঝে গেছি।’ কোনও রকমে পালা শেষ করে সাজঘরে মাথা হেঁট করে বসে পড়েছিলেন অনল। ‘যুবকটি আমাকে নয়, গালে চড় মেরেছিল বাংলার যাত্রাশিল্পকেই। সে রাতে ধিক্কার দিচ্ছিলাম আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে। ভাবছিলাম, আমাদের পালার কাহিনি যা, তা তো সত্যিই বলিউডের ফিল্ম ‘রাজা হিন্দুস্থানি’র টুকলি। ছেলেটির কী দোষ? পালার কাহিনি যদি হয় চোরাই মাল, খদ্দের তা কিনবে কেন?’ সে রাতেই অনল ঠিক করেন, চিৎপুরে থাকুন যতই স্বঘোষিত সেলিম-জাভেদ, তাঁদের লেখা পালায় আর অভিনয় করবেন না তিনি। নিজেই লিখবেন কাহিনি। পরিচালনাও করবেন।

সেই ইচ্ছারই এক ফসল ‘সেদিন ঠিকানা হারিয়ে’। গল্প মিলনান্তক নয়। বরং ট্র্যাজিক। শেষ দৃশ্যে নায়ক-নায়িকা যখন বসবে বিয়ের পিঁড়িতে, তখন ফাঁস হয় এক মর্মান্তিক সত্য। ওরা ভাই-বোন। অতঃপর আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু দু’জনের। এ কেমন পালা? ইচ্ছেপূরণ নেই, ফর্মুলা স্টোরি নয়। জার্ক বলে জার্ক! সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, এ পালা হিট। কেন? প্রশ্ন শুনে খেপে গেলেন অনল। বললেন, ‘খবর রাখেন কি, গত তিন-চার দশকে মানুষের মন কতটা বদলে গেছে? গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখন ফেসবুক করে। সস্তা কমেডি কিংবা জগঝম্পে ওরা আজ আর খুশি হতে পারে না।’

‘কাকলি-অনল’ জুটির একসঙ্গে যাত্রায় মঞ্চযাপনে কেটে গেল দু-দশক। জনমনোরঞ্জনে বিনোদনের রঙিন পশরা নিয়ে গোটা রাজ্য পরিক্রমা জুটি বেঁধে ২১টা বছর। রেকর্ড সময়। বিনোদন জগতে এই রেকর্ড নেই কোনও শিল্পীর ঝুলিতে। চিৎপুর যাত্রা ফ্যাক্টরিতে ‘কাকলি-অনল’-এর জুটি বেঁধে দৌড় শুরু হয়েছিল সত্যনারায়ণ অপেরায় ‘মেনকা মাথায় দিল ঘোমটা’ পালার সৌজন্যে। সেই দৌড় চলতি ১৪২৪ সনেও অপ্রতিরোধ্য অব্যাহত। নতুন নাট্য সৃজনে তাঁরা ক্লান্তিহীন। নানান দল ঘুরে, কাকলি চৌধুরি-অনল চক্রবর্তী জুটির সত্যনারায়ণে, নতুন ইনিংসে এটা তৃতীয় বছর।

যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-১০

2
ময়লা টাকার লক্ষ্মী
সামাজিক যাত্রাপালা

ময়লা টাকার লক্ষ্মী সামাজিক যাত্রাপালার সংক্ষিপ্ত আলোচনা

পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই পালা একটা জ্বলন্ত দলিল। বলছেন জনপ্রিয় পালাকার-নির্দেশক-নায়ক অনল চক্রবর্তী। পালার নাম ‘ময়লা টাকার লক্ষ্মী’। পরিবেশনায় দিলীপ দাসের সত্যনারায়ণ অপেরা। ১২টি দৃশ্যে সাজানো এই পালাগানের সময়সীমা তিন ঘণ্টা। পালার নামভূমিকায় কাকলি চৌধুরী।

পালাকার-নির্দেশক অনল চক্রবর্তী জানেন পালা জমিয়ে দেওয়ার ‘পাসওয়ার্ড’। পাশাপাশি মঞ্চযাপনে কাকলি-অনল জুটির রসায়নও প্রশংসনীয়। ময়লা টাকার লক্ষ্মী পালার ভরকেন্দ্র কাকলি। ভুবনডাঙার মাস্টারমশাই বিভূতি মুখোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে পারো এক দুর্ঘটনার কারণে পনেরো বছর আগে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। আশ্রয় খুঁজে পায় এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর কাছে। নিজেকে সমৃদ্ধ করে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে। ‘নারীমুক্তি’ সমাজসেবী সংস্থার হয়ে আবার ফিরে আসে ভুবনডাঙায়। পারো এখন লক্ষ্মী। এলাকার জানদরদি বিধায়ক কেনারাম মণ্ডল তাঁকে আশ্রয় দেয় ধানকলে। এখান থেকেই টানাপোড়েন—কাহানিমে ট্যুইস্ট।

ওদিকে ছোট মেয়ে শতাব্দীর সঙ্গে সংঘাত, মন কষাকষি বিভূতি মাস্টারের। শতাব্দী ঋত্বিকের সঙ্গে নাটক-সিনেমায় অভিনয় করতে চায়। পালাকার- নির্দেশক অনল চক্রবর্তী এখানে বিধায়ক কেনারাম মণ্ডল। পালার খলনায়ক রোমিও চৌধুরি। ‘কানা কার্তিকের’ চরিত্রে পাল্লা দিয়ে প্যান্ডেল কাঁপাচ্ছেন সুদর্শন গায়ক-নায়ক রোমিও চৌধুরী। তিনিও এবছর দলবদল করেননি। অভিনয়ে অন্যান্যরা হলেন, অনীক বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্পা দে, প্রীতম বিশ্বাস, সপ্তমিতা প্রমুখ। কৌশিকের কথায় সুরারোপ স্বপন পাকড়াশির। আলো-ধ্বনি এস সরগম। প্রযোজনা দিলীপ দাস।

যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-১০ (শেষ পর্ব) আজ শেষ করলাম। আগামী দুর্গাপূজার মরশুমে আবার এর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ দেওয়ার আশা রাখি। সাথে থাকবেন। পাশে রাখবেন।
জয়গুরু!

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১২ টি মন্তব্য (লেখকের ৬টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৬-০৭-২০১৯ | ১৬:৫২ |

    যাত্রাপালা-১০ শেষ পর্বের চমৎকার আলোচনাটি পড়লাম। নিরন্তর শুভকামনা কবি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১৭-০৭-২০১৯ | ১৫:৪১ |

       

      সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম আর অনুপ্রাণিত হলাম।

      প্রীতি, শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন জানাই
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  2. সুমন আহমেদ : ১৬-০৭-২০১৯ | ২১:১৮ |

    সমায়াভাবে পুরোটা পড়ার মনযোগ দিতে পারলাম না। পরে এসে পড়ে নেবার চেষ্টা করবো।আপনার শেয়ারিংকে অভিনন্দন জানালাম দাদা। ধন্যবাদ। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১৭-০৭-২০১৯ | ১৫:৪২ |

      সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম আর অনুপ্রাণিত হলাম।

      প্রীতি, শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন জানাই
      সাথে থাকবেন প্রিয়।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  3. রিয়া রিয়া : ১৬-০৭-২০১৯ | ২১:২৫ |

    যাত্রা বাংলাদেশের এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় লোকনাট্য ধারা।

    শহুরে জীবনে সেই ঐতিহ্য থেকে আমরা অনেকটা সরে এসেছে এটা স্বীকার করতেই হবে। আমিও বিস্মৃতপ্রায়। যতটুকু যা জানছি সেটা এই আপনার পোস্টে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১৭-০৭-২০১৯ | ১৭:৩৬ |

      সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম সতত সাথে থাকবেন প্রিয় কবিবোন।
      অনুপ্রেরণা দিয়ে উত্সাহিত করবেন।
      প্রীতি আর শুভেচ্ছা রইল।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১৬-০৭-২০১৯ | ২১:৫৬ |

    পুনশ্চ অভিনন্দন কবি ভাণ্ডারী দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১৭-০৭-২০১৯ | ১৭:৩৭ |

      আপনার সুন্দর মন্তব্যে বিমুগ্ধ হলাম প্রিয়কবি । সাথে থাকুন।
      আন্তরিক প্রীতি আর শুভেচ্ছা জানাই।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  5. সাজিয়া আফরিন : ১৬-০৭-২০১৯ | ২২:০৬ |

    শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১৭-০৭-২০১৯ | ১৭:৩৯ |

      সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম সতত সাথে থাকবেন প্রিয় কবি।
      অনুপ্রেরণা দিয়ে উত্সাহিত করবেন।
      প্রীতি আর শুভেচ্ছা রইল।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  6. শাকিলা তুবা : ১৬-০৭-২০১৯ | ২৩:৪১ |

    দেখতে দেখতে দশম পর্ব পড়া হলো।

    GD Star Rating
    loading...
  7. লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১৭-০৭-২০১৯ | ১৭:৪০ |

    যাত্রাজগতে সুদিন ফিরে আসছে। দিন আগত। সেদিন আসছে।

    দেশের সরকার যেভাবে সহায়তা করছেন
    তাতে যাত্রাশিল্পের মানোন্নয়ন হবেই।

    আমরা সেইটাই আশা করি।

    সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ দিদিভাই।
    জয়গুরু!

    GD Star Rating
    loading...