যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-৫

যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-৫

রথযাত্রার দিন দূর-দূরান্তের গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন ক্লাব, লাইব্রেরি বা অন্য ধরনের সংগঠন দল বেঁধে যাত্রাপালা বুকিং করতে আসেন। বুকিং করার সময় একটা টাকা দিয়ে বুকিং করেন। সুতরাং রথযাত্রার তিথি আসলে চিত্পুুরের যাত্রা দলগুলির অগ্রিম রোজগারের একটা দিন। নায়েক পার্টিদের অগ্রিম বুকিংয়ের সঙ্গে মিষ্টির প্যাকেট, ক্যালেন্ডার ও পোস্টার দেওয়া হয় – যাতে তাঁরা তাঁদের জায়গায় ফিরে গিয়ে প্রচার শুরু করতে পারেন। নায়েক পার্টি বুকিংয়ের বিনিময়ে একটা নির্দিষ্ট হারে কমিশন পেয়ে থাকেন। প্রায় আড়াই দশক চিত্পুরের সঙ্গে যুক্ত থাকার সূত্রে একজনকে জানতাম — যাঁর নাম ‘নিরাপদ দাস’ এবং যিনি গর্ব করে বলতেন যে বরাহনগর মিউনিসিপ্যালিটিতে তিনিই সবচেয়ে বেশি কর দেন তাঁর সম্পত্তির জন্য। নিরাপদবাবু ভারতী অপেরার গদিতে বসতেন এবং নায়েক পার্টিদের সঙ্গে যাত্রাপালার মালিকের যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে কমিশন নিতেন।

রথযাত্রার দিন মালিকরা পালাকার, সুরকার – এঁদের প্রত্যেককে কিছু অগ্রিম দিতেন। এই অগ্রিম দেওয়াকে বলা হয় ‘সাইদ’ করা। অনেক দলে সুরকারের রথের দিন একটু সুরও করে দিতে হতো। একে বলা হত ‘সুরভাঙা’ অনেক দলে নাটকও পড়া হত।

চিত্পুরের যাত্রাদলে ষাট, সত্তর এমনকি আশির দশকে গদিঘর ছিল। অর্থাত্‍ একটা বড় তক্তপোশ থাকত। তার ওপর মোটা তোশক থাকত ধবধবে সাদা চাদর ঢাকা। আর থাকত কয়েকটা তাকিয়া। ঘরে চেয়ার ও লম্বা বেঞ্চি থাকত। মালিক গদিতে বসতেন। অতিথি যদি বিশিষ্ট হন তবে গদিতে বসবেন, অন্যথায় চেয়ার বা বেঞ্চিতে। কালের প্রকোপে এখন আর সেই পুরনো গদিঘর নেই। এখন সব অফিস হয়েছে আধুনিক চেয়ার-টেবিল দিয়ে।

আগে রথযাত্রার দিন চিত্পুরের যাত্রাপাড়ায় লোকে লোকারণ্য হত। শিল্পী ও সুরকার ও পালাকারদের পকেট গরম হতো। নায়েক পার্টিরা বড় থলে ভরে মিষ্টির প্যাকেট, ক্যালেন্ডার ও পোস্টার নিয়ে ঘরে ফিরে যেতেন বুকভরা আশ্বাস নিয়ে। যাত্রাপালার গান হলে পাড়ার ভেঙে পড়া ক্লাবঘরটার ছাউনি হবে, লাইব্রেরির বই কেনা যাবে। আগে যাত্রা হতো ষষ্ঠী থেকে জ্যৈষ্ঠি। অর্থাত্‍ দুর্গাপুজোর ষষ্ঠি থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস অবধি। কমবেশি একশো আশি দিন থেকে দুশো দিন। এখন হোম এন্টারটেনমেন্টের যুগে পুরনো যাত্রার সে সুদিন আর নেই। তবু বাংলার যাত্রা আছে, ছিল এবং থাকবে। লোকশিক্ষা ও মনোরঞ্জনের মাধ্যম হয়ে।

যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-৫
‘ভালো মানুষের ভাত নেই’

‘ভালো মানুষের ভাত নেই’ যাত্রাপালার সংক্ষিপ্ত কথাসার।

ভারতে নোট বাতিল নিয়ে মোদি-মমতার চলমান দ্বন্দ্ব এবার উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের যাত্রাপালায়। যাত্রার মাধ্যমে নোট বাতিল নিয়ে মোদি-মমতার বাকযুদ্ধ যাত্রাশিল্পীদের অভিনয়ে নিপুনভাবে ফুটে উঠেছে যেন। কলকাতার যাত্রাপাড়া চিৎপুরের যাত্রাশিল্পীদের দল ‘আনন্দবীণা অপেরা’ নোট বাতিল নিয়ে এ যাত্রাপালাটি মঞ্চায়ন করছে। যাত্রার নাম ‘ভালো মানুষের ভাত নেই’।

খোলা জায়গায় মঞ্চায়িত এই যাত্রাপালায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখার জন্য ভিড় করছেন দর্শকরা।

আনন্দবীণা অপেরা কর্তৃপক্ষ জানায়, ভারতে নোট বাতিলকে কেন্দ্র করে নানা কাহিনীর বাঁকবদলের মাধ্যমে সময়ের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই যাত্রাপালার মাধ্যমে। যাত্রার পালাকার মঞ্জিল ব্যানার্জি জানান, ‘ভালো মানুষের ভাত নেই’ যাত্রাপালায় শ্রেয়া নামের এক নারীচরিত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে প্রতিবাদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

যাত্রাপালার কাহিনী পরম্পরায় যেখানে নোটবাতিলের পর শ্রেয়ার বিয়ের জন্য তাঁর বাবা ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গিয়ে টাকা না পেয়ে ফিরে আসে। তারপর টাকার অভাবে বিয়ের দিন প্যান্ডেলের লোকেরা শ্রেয়ার বাড়ি থেকে প্যান্ডেল খুলে নিয়ে যায়। লগ্নভ্রষ্টা মেয়ের কথা ভেবে অসুস্থ হয়ে যায় শ্রেয়ার বাবা।

আর ঠিক এখান থেকেই শুরু হয় শ্রেয়ার আন্দোলন। যে আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। যাত্রাপালার শেষঅবধি জারি থাকে শ্রেয়ার নোট বাতিলবিরোধী আন্দোলন। অন্যদিকে এই নাটকে বীরেন্দ্র নামের এক চরিত্রে দেখা মিলে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির। আছে মোদির ঘনিষ্ট ব্যবসায়ীরাও। আছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, আছে রাইটার্স বিল্ডিংও।

এ ছাড়া যাত্রাপালার শুরুতেই দেখা মিলবে ভগবানরূপী কাল্পনিক এক চরিত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সব মিলিয়ে জমজমাট এই পালায় এখন মেতে উঠতে আরম্ভ করেছে যাত্রাপ্রেমী মানুষ। এই যাত্রা পালার প্রযোজক ও নির্দেশক কনক ভট্টাচার্য জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে যাত্রা মোটামুটি চার থেকে পাঁচ মাসের ব্যবসা। কিন্ত গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ভারতে নোট বাতিল ঘোষণা হওয়ার পর যাত্রা জগতে ঘোর অমানিশা নেমে আসে। টাকার অভাবে যাত্রাপালার বুকিং বন্ধ হয়ে যায়।

যাত্রাশিল্পী ও কলাকুশলীরা চূড়ান্ত অনিশ্চয়তায় পড়ে যান। ঠিক সেখান থেকেই নোট বাতিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাবনায় এই ‘ভালো মানুষের ভাত নেই’ যাত্রা পালা সূচনা। গত শনিবার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসতে চলতি মওসুমে প্রথম মঞ্চস্থ হলো এই ‘ভালো মানুষের ভাত নেই’ যাত্রা পালা। ভিড়ে ঠাসা দর্শক ছিল সেই পালায়।

কনক ভট্টাচার্য বলেন, প্রথম শোতেই আমাদের পালা উতরে গেছে। আমরা এরইমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে বুকিং ফোন পাচ্ছি। আসলে নোট বাতিল নিয়ে মোদি-মমতার দ্বন্দ্বকে সাধারণ মানুষ এখন ভীষণভাবে দেখতে চাইছে। তাই শুধু বাস্তবের মাটিতেই নয়, মোদি-মমতা রণংদেহী রূপকে যাত্রারমঞ্চে দেখতে এখন মানুষ দলে দলে ছুটছে এই পালার পেছনে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১১ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১০-০৭-২০১৯ | ১১:৩৩ |

    শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ কবি মি. ভাণ্ডারী।

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১০-০৭-২০১৯ | ১৫:৫০ |

      আপনর সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধতা ও অনুপ্রেরণা পাই।

      আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করুন।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
       জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  2. সুমন আহমেদ : ১০-০৭-২০১৯ | ১১:৩৭ |

    যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালার ৫ম অধ্যায়ও পড়লাম। ভালো সংযোজন। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১০-০৭-২০১৯ | ১৫:৫১ |

      সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম ও অনুপ্রেরণা পেলাম।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  3. সাজিয়া আফরিন : ১০-০৭-২০১৯ | ১১:৪১ |

    পড়লাম কবি দা। 

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১০-০৭-২০১৯ | ১৫:৫২ |

      মন্তব্যে মুগ্ধ ও আবেশিত হলাম। শুভেচ্ছা রইল।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১০-০৭-২০১৯ | ১১:৪৭ |

    ভালো শেয়ারিং ভাণ্ডারী ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১০-০৭-২০১৯ | ১৫:৫৩ |

      মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম দাদা। আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  5. রিয়া রিয়া : ১০-০৭-২০১৯ | ১১:৫৫ |

    পড়ার সুযোগ দানে শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১০-০৭-২০১৯ | ১৫:৫৪ |

      সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম ও অনুপ্রেরণা পেলাম।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

      GD Star Rating
      loading...
  6. শাকিলা তুবা : ১০-০৭-২০১৯ | ২১:৫৮ |

    ধন্যবাদ দাদা। আমার লেখায় আপনার মন্তব্য নেই। Smile

    GD Star Rating
    loading...