যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-৪
পঞ্চাশের শতকেও পশ্চিম বাংলার তথ্য এ দেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মুখে উচ্চারিত হতো নট্ট কোম্পানীর যাত্রা গানের কথা। এ নট্ট কোম্পানী ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশার পাঁজিপুঁথিপাড়া গ্রামের বাবু শশীভূষণ নট্ট এবং তার ভাই হারান চন্দ্র নট্ট প্রতিষ্ঠা করেন।
তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার শ্রেষ্ট যাত্রা দল নট্ট কোম্পানী। তখন সামাজিক বেড়াজাল পেরিয়ে মহিলারা যাত্রা পালায় অংশ নিতে পারতেন না। সে কারণে মহিলা চরিত্রে ছেলেদের দিয়ে অভিনয় করানো হতো। শিল্পসম্মত অভিনয়, কাহিনী বিন্যাস ও বিবেকের গান বেশির ভাগ ঐতিহাসিক ও সামাজিক কাহিনী নিয়েই রচিত হতো।
প্রথম দিকে যাত্রাপালার শুভ যাত্রা শুরু হয় জমিদার বাড়ীর অভ্যন্তরীণ আঙ্গিনায়। এর পর নট্ট কোম্পানী ঝালকাঠি সদরসহ দেশের বিভিন্ন শহর বন্দরে যাত্রা পালা করে অল্পদিনেই বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এরপর কোলকাতাসহ পশ্চিম বাংলার প্রায় সর্বত্র যাত্রা পালা করে নট্ট কোম্পানী অচিরেই শ্রেষ্ট যাত্রা দলের স্বীকৃতি লাভ করে।
সামাজিক পালায় চলমান সমাজের ন্যায়-অন্যায়, অসঙ্গতি-অসঙ্গতি, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ প্রভৃতি বিষয়। সামাজিক পালারচনায় সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন রঞ্জন দেবনাথ। তাঁর গলি থেকে রাজপথ, নীচুতলার মানুষ, এরই নাম সংসার, পৃথিবী আমারে চায়, আজকের সমাজ, বধূ এলো ঘরে, সংসার কেন ভাঙে, আমরাও মানুষ, শশীবাবুর সংসার, একটি গোলাপের মৃত্যু, স্বামী সংসার সন্তান, বন্দী বিধাতা, বিদূষী ভার্যা বা মেঘে ঢাকা তারা, কন্যাদায়, প্রিয়ার চোখে জল, সন্ধ্যা প্রদীপ শিখা, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ, কলঙ্কিনী বধূ বা জীবন নদীর তীরে, মায়ের চোখে জল, অনুসন্ধান, জেল থেকে বলছি, সংসার আদালত, বিবেকের চাবুক, এ পৃথিবী টাকার গোলাম, জোড়াদিঘির চৌধুরী পরিবার, সাত পাকে বাঁধা, নন্দরানীর সংসার, চরিত্রহীন, কোন এক গাঁয়ের বধূ, মায়ের চোখে জল প্রভৃতি পালা খুবই মঞ্চসফল।
সামাজিক পালায় ভৈরবনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কৃতিত্বও উল্লেখ করার মতো। তাঁর একটি ফুলের মৃত্যু, কান্না-ঘাম-রক্ত. ময়লা কাগজ, অভাগীর সংসার, অচল পয়সা, মা মটি মানুষ, নিহত গোলাপ, পাঁচ পয়সার পৃথিবী, বাঁচতে চাই, অশ্রু দিয়ে লেখা, প্রভৃতি পালা সকল শ্রেণীর দর্শক-শ্রোতার কাছেই জনপ্রিয়।
নির্মল মুখোপাধ্যায়ের সোনাডাঙ্গার বউ, প্রেমের সমাধি তীরে, পথের ছেলে, জীবন থেকে নেয়া, আজকের বাঙালি, মমতাময়ী মা, গরিব কেন মরে, জুয়াড়ি, মা যদি মন্দ হয়, ভাঙছে শুধু ভাঙছে, অমানুষ, কলঙ্কিনী কেন কঙ্কাবতী, মানবী দেবী প্রভৃতি পালা যাত্রামোদী মানুষের কাছে অতি প্রিয়।
কমলেশ ব্যানার্জীর বাঈজীর মেয়ে, হাসির হাটে কান্না, জবাব দাও, আমার ছেলে ফিরিয়ে দাও, কূল ভাঙা ঢেউ, বিশ্বাসঘাতক, হারানো সুর, সমাজ পালা পেশাদার-অপেশাদার সকল দলেই অভিনীত হয়।
প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের পৃথিবীর পাঠশালা, মানুষ পেলাম না, একফোটা অশ্রু, পেটের জ্বালা; চণ্ডীচরণ ব্যানার্জীর হকার, সিঁদুর পরিয়ে দাও, গফুর ডাকাত, নয়নতারা, প্রতিমা; নন্দগোপাল রোয় চৌধুরীর জনতার রায়; মহাদেব হালদারের সম্মান হারা মা, লক্ষ টাকার লক্ষ্মী, স্বামী ভিক্ষা দাও; রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগুন, অমানুষ, লাল সেলাম; শম্ভুনাথ বাগের পৃথিবী তোমায় সেলাম, অসুস্থ পৃথিবী; কানাইলাল নাথের গাঁয়ের মেয়ে, আমি মা হতে চাই, মা ও ছেলে; সত্যপ্রকাশ দত্তের বধূ কেন কাঁদে, দুই টুকরো বৌমা; জিতেন্দ্রনাথ বসাক মানুষ, জীবন জ্ঞিাসা, সোনার হরিণ, জানোয়ার; স্বদেশ হালদারের ঝাড়–দার, ঘুমন্ত সমাজ, আজকের দুনিয়া; বলদেব মাইতির অভিশপ্ত প্রেম, কাজল দিঘির কান্না; অনিল দাসের সোনার সংসার; শিবাজী রায়ের সিঁদুর পেলাম না; সঞ্জীবন দাসের শূন্য বাসরে বধূ, হতভাগিনী মা এবং স্বপনকুমার চট্টোপাধ্যায়ের শ্মশানে হলো ফুলশয্যা, অচল পয়সা, অভাগীর কান্না দুই বাংলার মঞ্চে সমানভাবে আদৃত হয়েছে।
পূর্ণেন্দু রায়ের দস্যুরানী ফুলনদেবী ও ওগো বধূ সুন্দরী, দুটি পয়সা, ফুলশয্যার রাতে প্রভৃতি পালা বিভিন্ন যাত্রাদলে অভিনীত হয়ে আসছে। দস্যুরানী ফুলনদেবী পালাটি সামাজিক পালা হলেও এতে ভারতে ‘দস্যুরানী’ হিসেবে আলোচিত ও পরবর্তীতে লোকসভার সদস্য ফুলনদেবীর জীবনকাহিনী অবলম্বনে রচিত। বাংলাদেশের পরিতোষ ব্রহ্মচারীও এই কাহিনী নিয়ে যাত্রাপালা রচনা করেন। পশ্চিমবঙ্গের অজিত গঙ্গোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের শাহজাহান বিশ্বাস একই কাহিনী নিয়ে একই নামে পালা রচনা করেন। পরিতোষ ব্রহ্মচারীর এক যুবতী হাজার প্রেমিক, আবার দরিয়া ডাকে, বেদের মেয়ে জ্যোছনা, ডিসকো কুইন, ছোটমা ও বিরাজবৌ (শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে), রিক্তের বেদন (কৃষ্ণগোপাল বসাকের উপন্যাস অবলম্বনে) ও বর্ণমালা মা আমার সামাজিক পালা হিসেবে তুষার অপেরা-সহ প্রথম শ্রেণীর পেশাদার বিভিন্ন যাত্রাদলে অভিনীত হয়।
যাত্রার আসর যাত্রামঞ্চ যাত্রাপালা-৪
মমতার ডাকে দিল্লি চলো
‘মমতার ডাকে দিল্লি চলো’ যাত্রাপালার সংক্ষিপ্ত কথা
“মমতার ডাকে দিল্লী চলো”। এটি একটি যাত্রাপালার নাম। নাম দেখেই মনে হচ্ছে এই পালাটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েই রচিত। উল্লেখযোগ্য, এ যাত্রায় পার্শ্বচরিত্র হিসেবে রয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। রয়েছেন সোনালী গুহ, সুব্রত বক্সী প্রমুখ চরিত্ররাও। মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম, জঙ্গলমহল, শবর জীবন – এসবই রয়েছে এই যাত্রাপালায়। রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে গৃহীত রূপশ্রী-কন্যাশ্রীর মত প্রকল্পের কথাও।
রাহুর গ্রাসে দেশ। গ্রহণ কাটাতে মমতার ডাকে মিলিত হচ্ছে দেশের আগামীর চালিকা শক্তি। সে–শক্তি সঞ্চয়ে অর্থাৎ অশুভ ও দানব শক্তির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে ফের যাত্রামঞ্চে ঝলসে উঠল সত্যের শাণিত কৃপাণ। পালাকার অশোক দে–র ‘মমতার ডাকে দিল্লি চলো’ পালার প্রথম মঞ্চ পরিবেশনা সাড়া ফেলল জনমানসে। ‘লোকবন্দনা অপেরা’র এই কাহিনীর মূল চরিত্র মমতা ব্যানার্জির চরিত্রে অভিনেত্রী সীতা ঘোষ অবিকল মমতাই। মহড়া–পর্বে বেশ রপ্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক জীবন এবং তাঁর যাবতীয় ন্যায়–নীতি। নাটকের অন্য সব চরিত্রের অভিনয়ও ছুঁয়েছে দর্শক–মন। যা স্পষ্ট বৃহস্পতিবার হলদিয়ার ক্ষুদিরাম স্মৃতিরক্ষা কমিটি আয়োজিত ক্ষুদিরাম মেলার অনুষ্ঠানে। এটা ছিল এ–পালার প্রথম মঞ্চ পরিবেশনা।
যে–ছবি দেখতে অভ্যস্ত যাত্রাপ্রিয়রা— পালা শেষের আগেই হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন দর্শক। হলদিয়ার মঞ্জুশ্রী ময়দানের যাত্রামঞ্চে অবশ্য দেখা গেল বিরল চিত্র। যাত্রা শেষ ঘোষণা না করেই কলাকুশলীরা দর্শকের অনুভূতি জানতে অপেক্ষা করছিলেন সাজঘরে। মিনিট ৫ পরও ছবির বদল না দেখে সীতা ঘোষ–সহ পালার সমস্ত কুশলী মঞ্চে এসে জানালেন যাত্রা–সমাপ্তির কথা। সীতাই জানালেন, এ যাত্রাপালার উদ্দেশ্য। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে যাত্রার বিবেকের যে–শক্তি, এর কোনও বিকল্প নেই। এই যাত্রার হাত ধরেই পরাধীন জাতিকে মুক্তির গান শুনিয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমান বাঙালি জনমানসে যাত্রার সেই ধারাবাহিকতা অনেকটাই সচল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অন্যায়–অসত্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আঙ্গিকে ও বিন্যাসে লোকায়ত জনপদকে আন্দোলিত করতেও বেশ উদ্যোগী।
বিপন্ন যাত্রাশিল্প অনেকটাই সক্ষম হয়েছে ঘুরে দাঁড়াতে। যার প্রতিদান দেওয়ার যাত্রাপালা বলে দাবি অভিনেত্রী সীতা ঘোষের। তিনি বলেন, ‘দেশের মাথায় এখন রাহুর বাসা। গ্রহণ কাটাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির যজ্ঞে শামিল হতে তাঁদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।’ যাত্রাশিল্পীরা আশাবাদী, ‘মমতার ডাকে দিল্লি চলো’ যাত্রাপালা বেশ জনপ্রিয় হবে গ্রামবাংলায়। যা দেখার পর সম্প্রীতি রক্ষা, শান্তি এবং উন্নয়নের তাগিদে মমতার হাত জনতা শক্ত করবে বলেও মনে করেন তাঁরা। এই যাত্রাপালায় মমতার চরিত্রে দৃপ্ত সীতার অভিনয় সকল অগণিত দর্শকের মন জয় করার অধিকার রাখে।
loading...
loading...
যদিও সংশ্লিষ্ট অঞ্চল অথবা দেশের মানুষ আমি নই; তারপরও রিভিউটি পড়ে অনেক কিছু জানা গেলো। ধন্যবাদ মি. ভাণ্ডারী।
loading...
আপনর সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধতা ও অনুপ্রেরণা পাই।
সশ্রদ্ধ অভিনন্দন ও প্রণতি জানাই।
সাথে থাকবেন। জয়গুরু!
loading...
বাঙালী সংস্কৃতির অব্যহত ধারার কিছু আলাপ পড়লাম দাদা। আপনার লেখনীর সাফল্য কামনা করি।
loading...
সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম ও অনুপ্রেরণা পেলাম।
সাথে থাকবেন। জয়গুরু!
loading...
অজানা বিষয় সমূহ মাথায় বাড়িয়ে নিলাম আপনার প্রকাশনা বা রিভিউটি পড়ে।
loading...
মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম ও শুভেচ্ছা জানাই।
সাথে থাকবেন। জয়গুরু!
loading...
পড়লাম কবি দাদা।
loading...
মন্তব্যে মুগ্ধ ও আবেশিত হলাম। শুভেচ্ছা রইল।
সাথে থাকবেন। জয়গুরু!
loading...
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...
মন্তব্যে মুগ্ধ ও আনন্দিত হলাম। প্রীতি আর শুভেচ্ছা জানাই।
সাথে থাকবেন। জয়গুরু!
loading...