ভালবাসা শুধু ভালবাসা (সপ্তম পর্ব)

ভালবাসা শুধু ভালবাসা (সপ্তম পর্ব)

রক্তে নদীর ধারা (অমর ভালবাসা)
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

অজয়ের জলে নৌকা চলেছে পাল তুলে। নদীতে বসে দুই কিশোর কিশোরী। যাত্রীদের কেউ কেউ বসে আছে পাটাতনে। ছুটে চলেছে নৌকা তীব্রগতিতে।

মাঝি গাইছে-
জীবন পথের পথিক ওরে- বাঁধলি কেন ঘর,
জীবন নদীর ঝড় তুফানে (তোর) ভাঙবে খেলাঘর।

মাঝনদীতে এসেই নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠল। নৌকা ডুবু ডুবু। মাঝি বেহাল দেখে নদীতে ঝাঁপ দিল। দেখতে দেখতে নৌকাটি অতল তলে তলিয়ে গেল।

অবশেষে সেই দুই কিশোর-কিশোরী ভাসতে ভাসতে নদী কিনারায় এসে পৌঁছাল। এক মৌলভী সাহেব তাদের দুজনকে টেনে পারে আনলো। দুইজনেই তখন তাদের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

মৌলভী সাহেব বলে- “হে খোদা, দীন দুনিয়ার মালিক। তুমি এদের ভালো করে দাও আল্লাতালা। তা নইলে যে তোমার আশমান কালো কালিতে কাল হয়ে যাবে। তুমি রহমত করো খোদা।”

মৌলভী সাহেবের করুণ দোয়ায় বেহেস্তে খোদার আসন টলমল করে উঠলো। আর কিছুক্ষণ পরেই তাদের দুজনের জ্ঞান ফিরে এলো। চোখ মেলতেই মৌলভীকে দেখে বললো –কে আপনি? ধীরে ধীরে তাদের মনে পড়ে তারা নৌকায় চড়ে নদী পার হচ্ছিল। তারপর কি হয়েছিল তারা দুইজনে কেউ কিছুই জানে না।

মৌলভী তাদের মসজিদে নিয়ে গেল। কলমা পড়িয়ে তাদের দুজনকে ইসলামে পরিণত করলো। তারপর দুজনের দুটি হাত একসাথে মিলিত হলো। তাদের নাম রাখা হলো রহমত খাঁ আর রহিমা খাতুন।

মৌলভী সাহেব ওদের দুজনের সম্মতিক্রমে দুইজনের একসাথে নিকাহ করিয়ে দিল। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা প্রয়োজন- তারা ছোটবেলা থেকেই একে অপরকে ভালবাসত। কিন্তু সমাজ তা মেনে নেই নি। তাই তারা হিন্দু সমাজ ত্যাগ করে মুসলমান হলো। কিন্তু ভালবাসার মৃত্যু নেই। তাই সমাজের উপর চরম প্রতিশোধ নিতে তারা দুজনেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে উঠল।

মৌলভী সাহেব তাদের আরও বলেছিল- “যে হিন্দু সমাজ তোমাদের দুজনের খোয়াব বরবাদ করে দিয়েছে, তোমাদের কুত্তা মাফিক বের করে দিয়েছে। তোমাদের রঙিন আশমান কালো কালিতে কালো করে দিয়েছে, সে সমাজের উপর তোমরা চরম প্রতিশোধ নাও। আজ তোমাদের পরিচয় তোমরা হিন্দু নও, তোমরা মুসলমান নও, তোমাদের একমাত্র পরিচয় তোমরা একে অপরকে ভালবাসো। তোমাদের ভালবাসার মৃত্যু নেই।

”চলে আয়, বেটা রহমত, চলে আয় বেটি রহিমা। আজ থেকে আমি তোদের আব্বা, তোদের আব্বাজান”। ওরা দুজনেই আব্বাজানের সাথে সুখেই দিন কাটাতে লাগলো। ওরা ভুলে গেছে অতীতকে। অতীতের বিষাক্ত স্মৃতি আজও ওদের মন থেকে মুছে যায় নি।

দিল্লির মসনদে বাংলার নবাব তখন হুসেন শাহ। মহানুভব সম্রাটের মহান আদেশ ছিলো- মন্দির মসজিদ পাশাপাশি থাকবে। হিন্দু মুসলমান একে অপরকে ভালবাসবে। কিন্তু তদানীন্তন পুরোহিত আর মৌলভী মিলে দুটো শক্তিশালী জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দিল বিদ্রোহের বিষ। জ্বলে উঠলো আগুন! হিন্দুরা হলো বিদ্রোহী।

বাংলার নবাবের ফৌজদার রহমতের হাতে উন্মুক্ত তরবারি দিয়ে বললো-“ছুটে যাও রহমত, দিল্লির পথে প্রান্তরে, সর্বত্রই ঘোষণা করে দাও- যে যেখানে দেবমন্দির দেখবে অবাধে লুণ্ঠন করো। মন্দির ভেঙে মসজিদ বানাও। আঘাতে আঘাতে হিন্দু সমাজটাকে ভেঙে খান খান করে দাও। সুখ পাবে রহমত, শান্তি পাবে। মেহেরবান খোদার দোয়ায় বেহেস্তে স্থান পাবে। আর এটাও মনে রেখো জাহানের সেরা ধর্ম ইসলাম।”

রহমতের সাথে তরবারি হাতে নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রহিমা। গোটা হিন্দু জাতটার জন্যে তাদের সবুজ স্বপ্ন ভেঙে চুরে তছনছ হয়ে গেছে। আজ সেই জাতটাকে নির্মূল করার জন্য উভয়েই ছুটে চলেছে কিসের নেশায়? ওরা জানে, যে ধর্ম, যে জাতি তাদের দুজনকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সঠিক পথের সন্ধান। সেই জাতি আর ধর্মের জন্য তারা বিদ্রোহ করবে। তাই তারা আজ হিন্দুত্যাগী বিধর্মী মুসলমান হয়েও সেই ধর্ম আর জাতটাকে বহুগুণে শ্রদ্ধা করে।

আগুন জ্বলছে, মন্দিরে মন্দিরে দেববিগ্রহ জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে। ধর্মে ধর্মে আজ জেহাদ ঘোষণা করেছে। হিন্দুরা আজ মরীয়া। মুসলমানরাও পিছিয়ে নেই। রহমত খাঁ তরবারি ঘুরিয়ে প্রকাশ্যে দেবমন্দির লুণ্ঠণ করে চলেছে। দেববিগ্রহের চোখে জল। ওরা কাঁদছে। অভিশাপ দিচ্ছে। আর সেই অভিশাপে……..

এক পুজারী ব্রাহ্মণ কোষাকুষি ছুঁড়ে রহমতকে আঘাত করলো। রহমতের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে অবাধ গতিতে। রহিমাকেও কে বা কারা আঘাত করেছে। সেই আঘাতে তার মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। রক্তের রং লাল। আর সেই রক্তের হোলি খেলা চলছে দেবমন্দিরে। দুটি নিষ্প্রাণ দেহ দেবমন্দিরে লুটিয়ে পড়ল। রহিমার কোলে মাথা রেখে রহমত শেষ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। রহিমা রহমতকে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকলো তাদের অমর ভালবাসা।

ভগবান নেই। খোদা মরেছে। খোদা আর ভগবানের নাম করে একদল জাতি আর এক জাতির প্রতি বেইমানি করে আসছে যুগ যুগ ধরে। মানুষ হয়ে উঠেছে মানুষের শত্রু। গল্প এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। কিন্তু এটা তো গল্প নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা।

আসুন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াই। আসুন, আমরা সকলেই সোচ্চার কণ্ঠে বলি- সব হিন্দু আমার ভাই, সব মুসলমান আমার ভাই। আসুন, জাতিগত বিরোধ ভুলে আমরা পরস্পর সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হই। আমরা এক জাতি, আমাদের ধর্ম একটাই। সে জাতির নাম মানুষ জাতি। সে ধর্মের নাম মানুষের ধর্ম। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু! জয়গুরু! জয়গুরু!

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৫ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৯-০৪-২০১৯ | ১৯:৩৪ |

    জাতিগত বিরোধ ভুলে আমরা পরস্পর সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হই। আমরা এক জাতি, আমাদের ধর্ম একটাই। মানুষ জাতি। সে ধর্মের নাম মানুষের ধর্ম।

    আপনার এই আবাহনের সাথে কোন তর্ক বা বিপক্ষ আমি নই। কিন্তু ভালোবাসার গল্পে এই উদার বার্তাটি খুব বেশী মানানসই মনে হলো না। কাহিনীটিও দূর্বল কাঠামোর। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  2. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০৯-০৪-২০১৯ | ১৯:৪৪ |

    অজয়ের জলে যে প্রেমের কাহিনি বিধৌত হয়েছে তা পড়লাম। আহ্বানও পরিস্কার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. সুমন আহমেদ : ০৯-০৪-২০১৯ | ২০:৫০ |

    জাতি স্বত্ত্বা বা ধর্মের ব্যবহারে ভালোবাসার গল্পে ইতিহাসও যুক্ত হয়েছে। দিল্লীর মসনদে বাংলার কোন শেষ নবাব ছিলো কিনা আমার জানা নেই। ধন্যবাদ। নাকি কেবলই গল্পের প্রয়োজনে কল্পনার আশ্রয় ? 

    GD Star Rating
    loading...
  4. রিয়া রিয়া : ০৯-০৪-২০১৯ | ২১:১২ |

    সম্প্রীতিতে ভরা থাক আমাদের সমাজ। আমাদের ভারতবর্ষ। 

    GD Star Rating
    loading...
  5. শাকিলা তুবা : ০৯-০৪-২০১৯ | ২১:২৬ |

    গল্প এবং ইতিহাসের অংশবিশেষ পড়লাম কবি।

    GD Star Rating
    loading...