আমার রবীন্দ্রনাথ

_11

সদ্য রবীন্দ্র তিথি গেলো। সবাই তাঁকে নিয়ে পোস্ট করছেন। আমারও শখ হলো পোস্টাতে। একটা বছর তিন-চারের পুরোনো, প্রকাশিত লেখা।

আমার রবীন্দ্রনাথ
ভালো বই শিক্ষকের সমান। যে মানুষ বই পড়েন তাঁর অনেক শিক্ষক। আমাদের মাথার উপর অনেক দিকনির্দেশক ছায়ার হাত ছিল। সেইসব হাত আমরা ঠেলে সরিয়েছি। অধীত জ্ঞান আর বিদ্যাকে জীবনে ক’জনই বা প্রয়োগ করতে পারি? শুধু সব অনুভবের অনুভবী সর্বগ্রাসী রবীন্দ্রনাথকে সবটুকু ঠেলে ফেলতে পারি নি।

আজ ঘর-বারের এমন ওলঢাল দেখে তোমাকেই রবিঠাকুর, মনে পড়ে যায় গো ! সামনে – কাছে – দূরে অজস্র যে পথ ও জীবন, – সব দিকেই তোমার বাণীমূর্তি। তোমায় কত সামান্য পড়েছি, কত সামান্য পরিমাণে ভেবেছি। তোমার ভাব আর অনুভবকে ধারণ ও বহন করতে না পারার দীনতা আমার। তবু যেটুকুও ধরা দাও – সে তোমারই প্রসাদ গুণ।

“সহজ পাঠ” দিয়েই জীবনের শুরুতে সুষমাকে চিনেছিলাম। তারপর “শিশু”, “শিশু ভোলানাথ”…! বইএর পাতা থেকে চট করে আঙুলটা সরিয়ে নিয়ে রহস্যময় হাসিটি হেসে, ‘দাঁড়াও, এক্ষুনি আসছি। ততক্ষণ তুমি …” বলেই ধাঁ হয়েছিলে।

তারপর এই অকূল সমুদ্র-তীর। কড়া রোদে পুড়ে যাচ্ছি, তেষ্টায় ছাতি ফাটছে। পা পুড়ে যাচ্ছে তপ্ত বালিতে। কত কথাই বলে চলেছি তোমার উদ্দেশ্যে, সেসব কথার পাতা হাওয়ার পাগল উড়িয়ে দিল এদিক ওদিক। অথচ দেখ, একটা যদি মেঘছায়া দিন হতো ! … ধরো, খুনসুটির বাতাসে চুল উড়ছে – আঁচল উড়ছে… গাছের ডালে সবুজ কচিকাঁচারা কী উজ্জ্বল! আহা! কেন এমন করে পা ভেজানো নীলাম্বুরাশি আমায় খুশী দিল না বলো তো?

শুধু দেহে নয়, মনেও তো বাঁচতে চাওয়া! আমার মনের কোনে – বাইরে দূরে – আমার অতীত বর্তমান ভবিষ্যত – আমার সকাল সন্ধ্যা – আমার গ্রীষ্ম বর্ষা – সব স-ব-খানে, আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় তোমার পদছাপে চোখ রেখে পথের নির্দেশ পেতে চাইলাম। ভাঙা নৌকায় বৈঠাহীন ঝড়ের রাতে তুমি একটিবার এলে না, ব্যর্থ অভিসার! তবু তোমাকেই বিশ্বাস করতে চেয়েছি যে, সবই শেষ পর্যন্ত পরমের দিকে এগিয়ে যায়।

সারা শ্রাবণ মাথায় নিয়ে একা জিওল রাস্তায় গোধূলি ভেঙে চললাম কোনো এক শৃঙ্গজয়ের দিকে তাকিয়ে। তুমি কুপি জ্বেলে দোরে এলে, আর যদিও তোমার খোয়াই সাজানো ভেজা দুয়ারে বসতে পারলাম এক মুহূর্ত, তবু ভবিতব্য এই যে, বর্ষাভেজা হাঁসশরীর সেই গেরস্থালীর পালকই ঝেড়ে চলেছে।

কার জীবন কে যাপন করছে তা-ই বুঝি না! তোমার কুমুদিনীকে মনে পড়ে যায়। জাগরণে কাতরাতে কাতরাতে জ্বালা জ্বালা চোখ খুলে প্রস্তুত হই। তার মতো করে ভাবি যে স্বামীসঙ্গে সফল করে তুলব আজকের যাপন, তোমার লাবণ্যর মতো পেলব করে তুলব – ইহ গচ্ছ ইহ তিষ্ঠ – সে দিনটি। অথচ সেই দম দিয়ে দেওয়া পুতুল। ক্রমাগত ছুট ছুট রান্নাঘর – নিজের ঘর ( নিজের!) – খাবার না দেখেই মুখ থেকে দু-গ্রাস পেটে চালান। তারপর ঘাম মুছতে মুছতে চক-ডাস্টার। যদি পড়াতে চাইলাম কবিতা, কিংবা কম নম্বর পাওয়া মেদুর চোখের ছাত্রীটির মধ্যে ফটিককে দেখে কাশের ডাঁটা চিবুতে চিবুতে নদীর ধারে হাঁটতে চাইলাম, অমনি সিলেবাস দরজার সামনে কড়া চোখে এসে দাঁড়াল। … দিনশেষে দেখি সব প্রস্তুতি গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছেন “মধুসূদন”। তোমার কথা মানলে হয়তো এও ব্যর্থ নয়!

অন্ধকার ঘরে কখনো কখনো তুমি সাগর সেন বা দেবব্রত-র গলায় বেজে চলো। সারারাত। আমি যখন তোমাতেই বাস করি, যখন আবদার করি, সপসপে ভিজে কাঁপতে থাকা আমাকে তুমি শুশ্রূষায় টেনে ভিজে মাথা মুছিয়ে দাও তোয়ালেতে – তখন আমার পিতা তুমি। আমার জ্বরো কপালে জলপট্টি দিয়ে কখনো তো পাশে বসেছ মায়ের মতো! আর ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে যখন বেজেছে, ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু হে প্রিয়’, পরানসখা, আমার হাত ধরে পথ চলার অঙ্গীকার চেয়েছি।

তুমি ‘আসছি’ বলে চলে গেলেও আমি বাধ্য ছাত্রীর মতো সেই পাঠ থেকে তোমার অসীমের দিকে যেতে চেয়েছি – তোমাকেই ছোঁব বলে। সেই এক রহস্যময় হাসি আমার প্রাণে সুর তুলল। নির্জন, একান্ত নিজের দুপুর আর রাতগুলোতে উপভোগ করি তোমার নির্মাণের পাকা কতবেল; সেসব সেই ধুলোবেলা থেকেই সব উপকরণে মজে উঠেছে।

মাটির ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে একদিন দেখে ফেলেছি “জনহীন প্রান্তর” পার হয়ে “জ্যোৎস্না সমুদ্রের” চাঁদের নৌকো আমার ঘাটে এসে লাগতে। ‘সহজ পাঠ’ কতটা সহজ হলে মদিরতার মউল ফুল ছড়িয়ে পড়ে বালিকা হৃদয়েও। কাল যে ডাল খালি ছিল আজ কী করে ফুলে ভরে বিস্ময়ের পরম্পরায় সে অবাক ঘোর আজও কাটল না। গাছের ভেতর রয়ে গেল সম্ভাবনার কুঁড়ি। বায়োস্কোপে একটার পর একটা পালটে যাওয়া ছবির মতো কবিতায় পরতের পর পরতে কল্পনার দৃশ্যপট খুলে গেছে। আবার গদ্যে অনুপ্রাসের ঠমকে বোষ্টমী, বিশ্বম্ভরবাবু, শম্ভু, নিস্তারিণী দেবীর কাহিনীর রসের ভাঁড় টুপিয়ে হাতের খুদে তালু শুধু ভরে দেয় নি, মনের কোণে ছন্দের মৌমাছিও চাক বেঁধে ফেলেছিল। তাই স্বীকারোক্তির পায়রা উড়িয়ে দিই – মধুর তোমার শেষ যে না পাই -।

তুমি ডাক শুনেছিলে ‘জীবন দেবতার’। আমি আসি তোমার ডাকে। “স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা পান করাবে …” – তাই কি ডেকেছ, আমার প্রিয়টি?

আধভাঙা চাঁদ ভাসিয়ে দিচ্ছে চরাচর। পিউ কাঁহা বুকের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা রোদনপুঞ্জ ভেঙে দিচ্ছে কাতরতা দিয়ে। বেদনার সুখ এত মধুর! তুমি এত শেখাও তাকে কী করে আঁজলা ভরে চুমকে পান করতে হয়। বেদনাকে সানন্দ নান্দনিক করে তুলে কতখানি বিশ্বজনীন করা যায় তা তুমিই দেখালে। তবু শিখতে পারি নি, বরং নৈর্ঋতে বা ঈশানের দিকে পালিয়েছি কতবার! তার মুখোমুখি হয়ে চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে পারি নি। তুমি আমার পালিয়ে যাওয়ার পথে পথে গাছ হলে, হাঁফধরা কর্মক্লান্ত চাষির মতো একটু জিরিয়ে নিতে বসেছি তোমারই ছায়াতলে।

তুমি শিখিয়েছ ‘আমি ‘ও ছোট নই। তুমি বললে ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে।’ ‘অসীম ধন’ তোমার হাতে, সে ধনে আমারও যে সত্ত্ব – ইচ্ছাপত্র লিখলে। তাই নিজেকে চিনতে নিজেকেই চিঠি লিখি ; ভাঁজের পর ভাঁজ খুলে, রেখার পর রেখা টেনে সম্পূর্ণ করে দেখতে চাই। এসবের সঙ্গে তোমাকেও পড়ে চলেছি, চিনে চলেছি। তুচ্ছ এই আমার ‘আমি’কে চেনাজানারও শেষ নাই। একটা ক্ষয়া হলদেটে পাতার আকাশের সীমা ছোঁয়ার ক্ষমতা কোথায়?

তোমার কড়ে আঙুল ধরে আসন বগলে ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর ধপধপে উঠোনের লেবুতলায় গিয়ে বসেছিলাম। তুমি অপেক্ষায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে। একদিন বাসস্টপে বাসে তুলে দিয়ে হাত নাড়লে।… বাড়ি ফিরতে দেরি হলে শাসন করলে। তারপর যেদিন জানলা জুড়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার দিন, বুকের ভেতর চাঁদ আটকালো – সেদিন আবার বুঝলাম তোমার কাঁধের বিস্তার। সহর্ষ রাত কাটিয়েছি নির্ঘুম। ডালপালা মেলে তুমিও সারারাত জেগে থেকে প্লাবন সামলালে। আনন্দে – বেদনায় – হতাশায় – জয়ে – পরাজয়ে তুমি আমার কাছে দু-এক কলিতেই ফিরে ফিরে আসো আমার ধারণ ক্ষমতা খুব সামান্য বলে! আমার খরচের বহর, চার্বাক মেনে ঋণের পর ঋণ জমে যায় তোমার কাছে। শুধতে ভারি ভয়েই গেছে! সেই ঋণেই তো জীবন চলছে।

তবু এই দরিদ্র আমি কতবার বলেছি, ‘তোমায় কিছু দেব বলে চায় যে আমার মন / নাই বা তোমার থাকল প্রয়োজন’। দ্যাখো, মন কেমন টুসটুসে হয়ে গেল! ভালো লাগার কবোষ্ণ হাত পাঁজর ছুঁয়ে গেলে চিরকাল কেন কান্না পেল, ঠাকুর?

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
আমার রবীন্দ্রনাথ, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৩-০৫-২০২৩ | ১৪:০৫ |

    আনন্দে – বেদনায় – হতাশায় – জয়ে – পরাজয়ে তুমি আমার কাছে দু-এক কলিতেই ফিরে ফিরে আসো আমার ধারণ ক্ষমতা খুব সামান্য বলে! আমার খরচের বহর, চার্বাক মেনে ঋণের পর ঋণ জমে যায় তোমার কাছে। শুধতে ভারি ভয়েই গেছে! সেই ঋণেই তো জীবন চলছে। ___ চমৎকার পোস্ট। অশেষ শুভ কামনা বন্ধু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ৩০-০৫-২০২৩ | ১:১৬ |

    ‘তোমায় কিছু দেব বলে চায় যে আমার মন / নাই বা তোমার থাকল প্রয়োজন’।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...