চিপ্পুস

ডিম ফুটে যেমন বাচ্চা বের হয়ে আসে তেমনই তাদের দৃষ্টি ফুটে লোভ আর লালসার লালা বের হয়ে আসতে থাকে। মেয়েদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে লেপ্টে থাকা তাদের লালসা সিক্ত দৃষ্টির আলোয়ান থেকে টপটপ ঝরতে থাকে অদৃশ্য রিরংসার তরল বিন্দু। এতে কী যে আনন্দ আর কী যে প্রাপ্তি তা কেবল তারাই বলতে পারবে। পথিক বা দর্শকের বোধে এসব অর্থবহ হয় না কখনোই। দর্শক শুধু দেখতে পায় তাদের বাইরের বখাটেপনাটুকু। তখন কেউ কেউ হয়তো তাদের জন্মদাতা বা গর্ভধারিণীকে শাপশাপান্ত করে। জন্মের দোষ বাপ-মায়ের চরিত্রের দোষ। আর সে সঙ্গে যোগ হয় মনগড়া আরো কিছু অনুষঙ্গ। এতে অবশ্য বখাটেদের জনক-জননীর কিছু যায় আসে না। তারা তাদের সন্তানের কার্যকলাপ দেখে না, শোনে না। হয়তো বা সে সব নিয়ে তারা মাথাও ঘামায় না।

এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে বুচি রাস্তাটার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গলির মুখে দাঁড়ানো ছেলেগুলোর দিকে একবার আড় চোখে তাকায়। কিন্তু তার কাছে মনে হলো ছেলেগুলো যেন অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশ কিছুটা গম্ভীর। গতকাল পাশের বাড়ির আন্টির মুখে শুনেছে এই ছেলেগুলোর দলের জনি নামের ছেলেটা ইয়াবা কিনতে গিয়ে গতকাল পুলিসের হাতে ধরা পড়েছে। এতেও হয়তো তাদের মন খারাপ হয়ে থাকতে পারে।

সংবাদটা জানার পর বুচি ভেবেছিল, লোফারগুলোর দলটা বুঝি এবার ভাঙলো। গলির মুখের আড্ডাটাও হয়তো সময় অসময়ে আর দেখা যাবে না। কিন্তু এখন সে ওদের দেখতে পেয়ে নিজের ভাবনার জন্যে নিজেকেই তিরস্কার করছিল বারবার। আর ভাবছিল এসব অপদার্থের মাঝখান দিয়ে আরো কতকাল যে তাকে আসা যাওয়া করতে হবে সেটা ভবিতব্যই জানে। অবশ্য অন্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যেমন শুনেছে তার নিজের ক্ষেত্রে বলতে গেলে তেমন মন্দ কিছু ঘটেনি। কেবল মন্টু বলে একটি ছেলে একবার পেছন থেকে বলে উঠেছিল, দশজনের ভিত্রে না থাকতে পারলে খবর আছে।

যার যেমন স্বভাব। এদের ভদ্রতা বোধ এতটুকুই। তা ছাড়া তাদের মতো মানুষের কাছে ভদ্রতা আশা করাটাও এক রকম বোকামি ছাড়া কিছু নয়। দিনের কথাবার্তার অর্ধেক অংশই যাদের খিস্তি খেউরে ভরা থাকে, ভদ্রোচিত ভাষাটা শিখবার সময়টা কোথায় তাদের? তারপরও বলা যায় তার নিজের সঙ্গে খুব একটা মন্দ আচরণ করেনি ছেলেগুলো। হতে পারে সঙ্গে তার মা থাকে বলেই ছেলেগুলো খানিকটা সংযত থাকে। কিন্তু মায়ের শরীরটা আজ খুব বেশি খারাপ বলে সংগে আসতে পারেননি। ভয় থাকলেও কিছুটা দুঃসাহসে ভর করেই সে বেরিয়ে পড়েছিল ঘর থেকে। ভেবেছিল পুলিসি ঝামেলার কারণে দলটা গলির মুখ থেকে দূরে থাকবে কিছুদিন।
গলির মুখটার দিকে এগোতেই ছেলেগুলো খানিকটা সমীহের সঙ্গে পথটা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ায়। দলের চিপ্পুস নামের হালকা পাতলা ছেলেটি বলল, আরো সুন্দর কইরা গাইতে হইব তন্বী। কালকেরটা তেমন ভালো হয়নাই। ভোটের চিন্তা করবা না।

বুচির ভালো নামটা তন্বী। মহল্লার সবাই তার বুচি নামটাই জানে। কিন্তু ছেলেটি তাকে বুচি বললো না দেখে অবাক না হয়ে পারে না। অবশ্য চিপ্পুসের ভালো কোনো নাম আছে কিনা জানা নেই বুচির। এ ধরনের বখাটেরা গানটান নিয়ে মাথা ঘামায় এমন ব্যাপারগুলো বিশ্বাস হতে চায় না। তবু বুচিকে দশজনের ভেতর থাকতে হবে কেন? আর তাতে কী লাভ তাদের?

বুচির ইচ্ছে হয় একবার তাদের জিজ্ঞেস করে তাদের যে, যারা দিনরাত বখাটেপনা করে বেড়ায়, মেয়েদের নানাভাবে উত্যক্ত করে, গানের মর্ম কি তারা বোঝে? কিন্তু তার আগেই বাপ্পি নামের ছেলেটা বলে ওঠে, আমাগো মহল্লার আকবর দেওয়ান বড় ওস্তাদ। তেনার কাছে গিয়া যদি…

কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই বাকি সবাই তাকে ঠেলতে ঠেলতে দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে ফেলে। বুচি সেদিকে আর না তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, কী বলতে চাচ্ছিল ছেলেটি? আর এতে তার দোষেরই বা কী হলো? অবশ্য বাপ্পির মুখ থেকে শুনতে পারলে বোঝা যেত আসলে কী বলতে চাচ্ছিল সে। তবে তাকে ঠেলে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরবার সময় বাকি ছেলেগুলোর মুখে হাসি ছাড়া রাগ বা আক্রোশের চিহ্ন দেখা যায়নি। তাই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলো না। তবে আকবর দেওয়ানের নামটা কেমন যেন জেঁকে বসে থাকে তার ভাবনার ভেতর।

কোচিঙে আর স্কুলে যাবার সময় ছোট্ট একটা নোকিয়া সেট ব্যবহারের অনুমতি পায় সে। অন্য সময়গুলোতে ফোন ব্যবহার করে না সে। মা ছাড়া সেটার নাম্বার আর কেউ জান না। অথচ তার ক্লাসের মেয়েদের প্রায় সবার হাতেই টাচ মোবাইল সেট আছে। লুবনা বলে একটি মেয়ের আছে আইফোন। তাকে ছাড়া সবার ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট আছে। এ নিয়ে ক্লাসে কোচিঙে অনেক কথা শুনলেও ঘরে ফিরে মাকে কিছুই জানাতে পারে না সে।

এমনিতেই মা খুব ব্যস্ত মানুষ। তা ছাড়া তার বাবার মৃত্যুর পর তাদের গার্মেন্টস ব্যবসার বাকি চার অংশীদার প্রস্তাব দিয়েছিল যে, তাদের শেয়ারটা যেন বাকি চারজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু মা সেটা করেননি। অংশীদারীত্বের নিয়ম অনুযায়ী অফিসের কাজ দেখাশুনা, মিটিঙে উপস্থিত থাকা, বায়ারদের সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ রাখা কোনোটাতেই সাহস হারাননি তিনি। ইতিহাসে এমএ পাশ করা মা কাজের ফাকে ফাকে এমবিএ ডিগ্রিটাও করে নিয়েছেন। আজকাল শরীরের কারণে অতটা সময় দিতে পারেন না। ফোনে ফোনেই অনেক কাজ করতে হয় তাকে। অথচ ডাক্তার বলে দিয়েছেন বেশি কথা বলা যাবে না। মায়ের পরে ব্যবসা বুঝে নেবে বলে সে কমার্স নিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু মা শুনে বলেছিলেন, সাইন্স নিয়ে পড় মেয়ে। ইন্টারের পর সব সাবজেক্টের দরজা খোলা থাকবে।

হাঁটতে হাঁটতে কখন সুমনাদের বাড়ির সামনে চলে এসেছে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে যায় বুচি। অতটা পথ সে একা একা চলে এলো? ঘর থেকে বের হলে ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করতে থাকতো। বিশেষ করে বখাটেগুলোর কথা ভেবে শরীর হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করতো। অথচ আজ তেমন কিছুই মনে হয়নি তার।

(শেষ হয় নাই)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৪-০৮-২০১৭ | ১৯:৩৯ |

    বুচি বা তন্বী আর চিপ্পুস। পড়ে কিন্তু অনুমান করতে পারছি একটা টুইস্ট অপেক্ষা করছে।
    এই পর্বেই শেষ হয় নাই জন্য হৃদয়ে অপেক্ষা রাখলাম প্রিয় গল্পকার।

    শব্দনীড় এ স্বাগতম মি. জু. সিদ্দিকী। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • জুলিয়ান সিদ্দিকী : ২২-০৮-২০১৭ | ২৩:৪৮ |

      ধন্যবাদ মুরুব্বী। লেখাটার বাকি অংশ টাইপ করা হয়ে উঠছে না।
      শব্দনীড় তো আগেও ছিলাম।

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ২৩-০৮-২০১৭ | ১৭:৩০ |

        Smile শব্দনীড় এ পুনঃ স্বাগতম প্রিয় গল্পকার।
        টাইপ হাত চলুক দূর্বার।

        GD Star Rating
        loading...