বলা হয় বাংলা সাহিত্যে ধুমকেতুর মতো যার আবির্ভাব, তিনিই হলেন আমাদের জাতিসত্তার প্রধানতম কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ধুমকেতুর সাথে তুলনাটি মোটেই অমুলক নয়। যখন তাঁর লেখালেখির জীবন সবেমাত্র যৌবন ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে, তখন তিনি লেখার ক্ষমতা হারালেন, বাকশক্তি হারালেন। ভাগ্যের এই নিষ্ঠুর পরিহাসে ধুমকেতুর মতো আলো জ্বেলে সহসাই সাহিত্য অঙ্গন থেকে বিদায় নেন। আমরা তথা গোটা বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হলাম ধারালো তলোয়ারের মতো ক্ষুরধার লেখনি থেকে। সাহিত্য প্রেমী সকল মানুষ তখন শোকে কাতর, মুহ্যমান। হয়ত নজরুল সারাজীবন লিখতে পারলে বাংলা সাহিত্য রবি ঠাকুরের পর আরও একটি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির গৌরব করতে পারতো, অহংকার করতে পারতো। নজরুল কে ছিলেন, আসুন আমরা তার নিজের মুখেই শুনি- ১৯২৭ সালে এক সাহিত্য সভায় তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভন্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।’
যে কোনো ভাষাতেই অন্য ভাষার শব্দ আত্মীকরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ঔপনিবেশিক কিংবা অন্য কোনো কারণে এই আত্মীকরণের ঘটনা ঘটে যাকে। তবে আত্মীকরণের এই প্রভাব সকল কবি, সাহিত্যিকের বেলায় সমান নয়। কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রভাব কম আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রভাব বেশি। সম্ভবতঃ বাংলা সাহিত্যে যার লেখায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি তিনিই হলেন আমাদের প্রাণের কবি, বিদ্রোহী কবি, দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুল অভিধান শব্দসূত্রে জানা যায়, মুসলিম সংস্কৃতির মন, মনন ও চিন্তনের দিকেই শুধু নয়, হিন্দু সংস্কৃতির গভীর থেকে গভীরতর এবং বাঙালি সংস্কৃতির দ্যোতনার দিকেও সবাইকে যিনি উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন, তিনিই আমাদের প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দেশি-বিদেশি শব্দের নিত্যনতুন বাহারে কিংবা যথার্থ ব্যবহার দিয়ে তিনি সবশ্রেণির পাঠককে বেঁধে রেখেছেন। কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে,হুঙ্কার দিয়েছেন আবার কখনও মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
তাঁর সাহিত্যকর্মে আরবি-ফারসি শব্দের বেশ ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। যদিও কবি নজরুলের আগেও অনেক কবি এবং লেখক আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তবে তা ছিল নিতান্তই সীমিত, সীমিত মাত্রায়। এখানেই নজরুল সত্ত্বার স্বাতন্ত্র্য। তিনি পদ্য, গদ্য, কিংবা গান সবক্ষেত্রেই বিদেশি শব্দের ব্যবহার করেছেন অন্যদের তুলনায় ঢের বেশি। তবে কেবল আরবি-ফারসিই নয়, তিনি উর্দু ও হিন্দি শব্দের ব্যবহারও করেছেন সমানতালে। যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল, তার ব্যবহৃত এসব শব্দের অধিকাংশই এখন বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। আবার কিছু শব্দ আছে কোনোভাবেই বাংলার সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে অব্যবহৃতই থেকে গেছে।
এ বিষয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর বলেছেন, “নজরুল মোল্লা-মৌলবীদের মতো ভালো আরবি-ফার্সী না জানলেও কাব্যের রস আস্বাদন করতে পেরেছিলেন। তার ব্যবহৃত অনেক শব্দই বাংলা ভাষায় যুৎসইভাবে ঠাঁই নিয়েছে। আবার কিছু আরবি-ফার্সী শব্দ ‘সুকৌশলে’ ব্যবহার করলেও তা বাংলা হয়ে উঠেনি। বরং আরবি-ফার্সীই রয়ে গেছে। ‘হিম্মত, জাহান্নাম, ঈমান, জানাজা, আসমান, ইনসান, আহাদ, মুর্দা-ইত্যাদি নজরুল ব্যবহৃত শব্দ এখন পুরোদস্তুর বাংলা। অবশ্য বাংলার বাগ্বিধিকে নজরুল উপেক্ষা করেননি, বরং সুসামঞ্জস্যভাবে আরবি-ফার্সী শব্দের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। তাই লিখেছেন, ‘নীলিম প্রিয়ার নীলা গুলরুখ লাজুক নেকাবে ঢাকা’, ‘ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ।”
তবে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে অধিক সংখ্যক আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কম হয়নি। বাংলা সাহিত্যে চলিত রীতির প্রথম সার্থক রুপকার প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষার জাতপাত সম্পর্কে বলেছিলেন, “বাংলা সাহিত্য থেকে আরবী-ফার্সী শব্দ বহিষ্কৃত করতে সেই জাতীয় সাহিত্যিকই উৎসুক যারা বাংলা ভাষা জানেন না।” অবশ্য প্রখ্যাত সাহিত্যিক দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়টি গভীরভাবে অনুধ্যান করে বলেছিলেন “গত পাঁচ, ছয়শত বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষাটা হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের হইয়া গিয়াছে। মুসলমানের ধর্মশাস্ত্র ও সামাজিক আদর্শ অনেকটা আরবী ও ফার্সী সাহিত্যে লিপিবদ্ধ। সেই সাহিত্যের জ্ঞান তাহাদের নিত্যকর্মের জন্য অপরিহার্য। আমাদের যেমন সংস্কৃতের সহিত সম্বন্ধ আছে, আরবী ও ফার্সীর সঙ্গে তাহাদের কতকটা তাই।” দীনেশ চন্দ্রের এই উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আমি মনে করি, তিনি যথার্থ বলেছেন।
আমিও গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আরবি ও ফার্সি শব্দ সমূহে মুসলমানদের ধর্মীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিশ্বাসের সাথে গভীর ঐতিহাসিক ও সমন্বয়ের সূত্রটি কাজী নজরুলের ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে। অবশ্য এখানেই নজরুলের বিশেষত্ব। কেননা তিনি একাধারে নিজ ধর্মবিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক চেতনা যেভাবে অন্তরে লালন করেছেন, তেমনিভাবেই তিনি নিজধর্মের বাইরে অন্যান্য সকল ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। নিজের ধর্মের গণ্ডির বাইরে এসে অন্য ধর্মের প্রতি নজরুলের এই যে অসাধারণ উদার মানসিকতা তা এতটা প্রবলভাবে অন্য কোনো কবি সাহিত্যের মাঝে পাওয়া যায় না। এমনকি রবীন্দ্রনাথকে মাঝেও না। নজরুল একাধারে বহুভাষাবিদ, গবেষক ও পণ্ডিত র মতো একদিকে যেমন সংস্কৃত ছন্দ অধ্যয়ন করেছিলেন, তেমনি আরবি-ফারসি ভাষা থেকেও প্রচুর শব্দ ছন্দ ও সুর আনয়ন করে বাংলা কাব্য ও সাহিত্যকে মুসলিম ঢঙ্গে সাজাবার প্রয়াসী হয়েছিলেন।
‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক মিস্টার ওয়ার্ডওয়ার্থ সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেন, “কোন একটা ভাষায় অন্যভাষার শব্দ প্রবেশ করবে কিনা; তা লেখকের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। যে সাহিত্যিকেরা অন্যভাষার শব্দ চয়ন করে নিজের ভাষার মধ্যে মিলিয়ে দিতে পারবেন তিনি ততো বড় শক্তিশালী সাহিত্যিক।” সত্যিকার অর্থেও তাই। কিছু সমালোচক সমালোচনা করলেও আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, নজরুল সাহিত্যে বিদেশি শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।
————————
.
০২/৬/২০২৩। ইনকিলাব সাহিত্য।
loading...
loading...
কিছু সমালোচক সমালোচনা করলেও আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, নজরুল সাহিত্যে বিদেশি শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।
loading...
মাশাআল্লাহ অসাধারণ হয়েছে।। প্রিয় আপনি দীর্ঘজীবী হোন।।
loading...