নিঃসন্দেহে ইসলাম একটি বিশ্বজনীন শান্তি ও প্রগতির জীবন ব্যবস্থা। আর এই ইসলাম পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই ভিত্তি সমূহ যথাক্রমে কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব এবং যাকাত। এদের যে কোনো একটি অস্বীকারকারী কাফির এবং যিনি অস্বীকার করেন না; কিন্তু প্রতিপালনও করেন না… তিনি ফাসিক। তাই উপরোক্ত পাঁচটি মৌলিক ইবাদত যথাযথভাবে পালন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ বা অত্যাবশ্যক। ইসলামের এই মৌল ভিত্তির মধ্যে যাকাত অন্যতম। ইসলামে যাকাত প্রদান ফরজ। কারণ যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ দূর হওয়ার পাশাপাশি বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব।
যাকাত আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হলো- পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। যাকাত সম্পদকে পবিত্র করে এবং বিভিন্ন ক্ষতি ও কৃপণতা থেকে মানুষকে হেফাজত করে। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, কোনো ব্যক্তির কাছে যদি সংসারের যাবতীয় খরচাদি মেটানোর পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ বছর শেষে উদ্ধৃত থাকে, তাহলে তাকে উদ্ধৃত সম্পদের শতকরা ২.৫% আল্লাহকে তায়া’লা নির্ধারিত আটটি খাতে প্রদান করাকে যাকাত বলে। বলা বাহুল্য যে, যাকাত একটি আর্থিক ইবাদত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নিসাব পরিমাণ মাল হল, সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অথবা সমপরিমাণ অর্থ।
যাকাতের ইতিহাসঃ সৃষ্টির সূচনা থেকেই ইসলামে যাকাতের বিধান প্রচলিত ছিল। কারণ মহান রাব্বুল আলামীন যখন পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী হিসেবে তৈরি করেন, ঠিক সেই সময় থেকেই দুনিয়াতে ধনী ও দরিদ্র এ দুই শ্রেণির মানুষ বসবাস করে আসছে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি তাদের পরীক্ষার জন্য যাকাত প্রদানে উৎসাহিত করেছেন। তাই যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এ পর্যায়ে বিভিন্ন যুগে যাকাত প্রদানের ইতিহাস সম্পর্কে জানবো, হযরত ইবরাহীম (আ.) এর যুগে যাকাতের বিধান সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আমি তাদের ইমাম (নেতা) বানিয়েছি। যাতে তারা তাঁর নির্দেশনা মতো আমার বিধান অনুযায়ী চলে এবং আমার জন্য ভালো ভালো কাজ স্বরূপ নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করে। বস্তুত তারাই ইবাদতকারী ছিল।” হজরত ইসমাইল আ. সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘স্বরণ করুন, ইসমাইল আ. এর কিতাবের কথা। নিশ্চয়ই তিনি ওয়াদা সত্য প্রমাণকারী ছিল এবং তিনি নবি-রাসুল। তিনি তার জনগণকে নামাজ পড়ার ও যাকাত দেওয়ার নির্দেশ দিতেন। আর তিনি আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত’।
বনী ইসরাইলদের যুগে যাকাতের চুক্তি বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর স্বরণ করুন আমরা যখন বনী ইসরাইলের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলাম এই বলে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না। পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। নামায কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। হযরত ঈসা (আ.) যাকাত ও নামায সম্পর্কে অসিয়ত করে বলেন, “আল্লাহ তায়ালা আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন নামায ও যাকাত আদায় করতে।
পরবর্তীতে হযরত মোহাম্মদ (স) এর উপর যাকাত প্রদান ফরজ করা হয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ কুরআনের আয়াতসমূহের প্রায় সকল অবস্থায়ই দরিদ্রদের দুঃখ মোচনের আহবান জানানো হয়েছে। আর যারা যাকাত দেয় না তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। তবে ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মুসলমানদের উপর যাকাত ফরয ছিল না। তবে পরবর্তীতে তা ফরজ করা হয়। পবিত্র কুরআন মাজিদের মোট ১৮টি সূরার ২৯ আয়াতে যাকাত শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। তন্মধ্যে ৯টি সুরা মাক্কী আর ৯টি মাদানী।
সুরা আল হজ্জ এ আল্লাহ যাকাতকে ফরজ ঘোষণা করে বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে।’
যাকাতের বিধানঃ তবে যাকাত সকলের উপর ফরজ নয়। স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক ও সম্পদশালী মুসলমানদের উপরই কেবল যাকাত ফরয। এক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে-
১. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া।
২. মুসলমান হওয়া। কাফেরের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৩. বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৪. জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নেসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার উপর যাকাত ফরজ নয়।
৫. নেসাব পরিমাণ মালের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া।
৬. মাল বর্ধনশীল হওয়া।
৭. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর উপর যাকাত ফরজ নয়।
৮. মালের উপর পূর্ণ মালিকানা সাবিত থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার উপর যাকাত ফরজ হয় না।
৯. নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া।
যাকাতের খাতঃ নির্ধারিত খাতে যথাযথ ভাবে যাকাত প্রদান না করলে, তা আদায় হয় না। যাকাতের খাত নির্ধারণ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা করেছেন। সূরা তওবায় যাকাতের আটটি খাতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “যাকাত তো সেসব লোকেরই জন্য- যারা অভাবগ্রস্ত, নিতান্ত নিঃস্ব, যারা তা সংগ্রহ করে আনে, যাদের অন্তরসমূহকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়, ক্রীতদাস মুক্তির ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”
উক্ত আয়াতের আলোকে আটটি খাতে যাকাত বন্টন করার কথা বলা হয়েছে। তা হলো- ১. ফকির (যার নিতান্ত সামান্য পাথেয় আছে), ২. মিসকিন (যার কিছুই নেই), ৩. যাকাত সংগ্রহের কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তি (তার পারিশ্রমিক অনুযায়ী), ৪. দ্বীন ইসলামের প্রতি চিত্তাকর্ষণে কোনো অমুসলিম কিংবা ইসলামে অটল রাখার্থে নও মুসলিম, ৫. দাসদাসীর মুক্তি, ৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণমুক্তি, ৭. একান্ত ও শরিয়ত সম্মত আল্লাহর পথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে এবং ৮. রিক্তহস্ত মুসাফির।
অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় যাকাতের গুরুত্বঃ
ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। যেকোন সময়ের থেকে রমজান মাসে যাকাত আদায়ের গুরুত্ব আরও বেশি। কেননা এ সময় আল্লাহ বান্দার প্রত্যেকটি নেক আমলের সাওয়াব সত্তর গুণ বা আল্লাহ চাইলে অগণিত হারে বাড়িয়ে দিতে পারেন। আমাদের অনেকের ধারণা, যাকাত গরীবদের জন্য ধনীদের একটি দয়া বা অনুগ্রহ। কিন্তু মোটেই তা নয়। বরং যাকাত গরিবের অধিকার। সূরা আয যারিয়াতে আল্লাহ বলেন: ‘তাদের অর্থাৎ ধনীদের ধন-সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” মূলত যাকাত প্রদান না করলে সম্পদ পবিত্র হবে না, পরিশুদ্ধ হবে না। নিজের সম্পদে অন্যের হক থেকে যাবে। ফলশ্রুতিতে সম্পদ অপবিত্র হবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতি কে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য যাকাত প্রদানের তাগিদ দিয়েছেন। কারণ যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে ধনী এবং গরীবের মধ্যে ভেদাভেদ দূর হবে। যথাযথ ভাবে যাকাত আদায় না করলে ধনী ব্যক্তি আরও ধনী এবং গরীব আরও গরীব হতে থাকবে। ফলে মানুষের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। সমাজে শান্তি ও সম্প্রতি নষ্ট হয়ে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাবে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস তার এক গবেষণা পত্রে দেখিয়েছেন, যদি বাংলাদেশের মালে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে, এমন সকল ব্যক্তি যথার্থ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যাকাত প্রদান করেন; তাহলে মাত্র সাড়ে সাত বছর পরে এদেশে যাকাত নেওয়ার মতো একজন লোকও অবশিষ্ট থাকবে না।
তাই পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি ও এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় যথাযথভাবে যাকাত আদায় করা জরুরি। একইভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের পাশাপাশি অন্যকে যাকাত দানে উৎসাহিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। কারণ যাকাত আদায়ের মাধ্যমেই কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন একটি সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব।
—————-
loading...
loading...
পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি ও এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় যথাযথভাবে যাকাত আদায় করা জরুরি। একইভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের পাশাপাশি অন্যকে যাকাত দানে উৎসাহিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
loading...
সুন্দর সাজেশনমূলক পোস্ট।
লেখককে সাধুবাদ জানাই।
loading...