বাংলা সাহিত্যের কথা বললেই যে নামটি সর্বাগ্রে আসে তিনি আর কেউ নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। যিনি “গুরুদেব”, “কবিগুরু” “বিশ্বকবি” ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত। ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ, অসংখ্য গান ও অন্যান্য গদ্য সংকলনই তার আধিপত্য এবং শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর বহন করে। সাহিত্যের এহেন শাখা নেই, যেখানে তার দীপ্ত পদচারনা নেই।
সেই হিসাবে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র প্রভাব খুবই স্বাভাবিক। পাঠ্যবই থেকে শুরু করে গবেষণাকর্ম, এমনকি সাধারণ পাঠকের কাছে এখনও তার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। তবুও আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গল্প, উপন্যাসে তার দুর্দান্ত প্রভাব নিয়ে সামান্য আলোচনার চেষ্টা করব। প্রথমেই কাব্য প্রসঙ্গ। অনেকের মতে, সন্ধ্যা-সঙ্গীত’ কাব্য থেকেই কবি তার নিজস্ব পথ খুঁজে পান। স্তবক রচনা, মিল সম্পাদন, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের নানারীতির প্রবর্তন এবং গদ্যছন্দের আবিষ্কারে তিনি বাংলা কবিতায় বৈচিত্র্য এনেছেন। ভাবের ক্ষেত্রেও তার অনুভূতি বিস্ময়কর। বিশেষ করে গীতি-কবিতা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে সার্থকরূপ পরিগ্রহ করেছে। উনিশ শতকের শেষ পর্যায় থেকে বিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত তিনি অজস্র রচনার দ্বারা পাঠকের রসপিপাসা নিবৃত্ত করেছেন। ভাবের ঐশ্বর্যে, কল্পনার বৈচিত্র্যে, ভাষার মাধুর্যে, প্রকাশের অসাধারণত্বে তার কবিতাগুলি অতুলনীয়। মানসী’ থেকে রবীন্দ্রকাব্যে পরিণতির ছাপ লক্ষণীয়। যদিও তার প্রথমদিকের কাব্যগুলিতে বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রভাব কিছুটা দেখা যায়। অবশ্য এরপরের কাব্যগাঁথা কেবলই রবীন্দ্রময়। এই যে এতো কবিতা লিখেছেন; তবুও শেষ জীবনে নিতান্তই আক্ষেপের সুরে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমার কবিতা জানি আমি.. গেলেও বিচিত্র পথে হয়নি সর্বত্রগামী”! কবিগুরুর এই যে অতৃপ্তি, আক্ষেপ তা তাকে আরও মহিমান্বিত করেছে। তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
একথা অনস্বীকার্য যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটগল্পের প্রথম সার্থক রূপকার। ‘সাধনা’ পত্রিকার মাধ্যমে তার ছোটগল্পের শুরু। তবে বাংলা ছোটগল্প যে পাশ্চাত্য গল্পের কাছে ঋণী, এমন কি রবীন্দ্রনাথ নিজেও এডগার অ্যালান পো-র মতোন বিদেশি সাহিত্যিকের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন, এ তথ্য আজ প্রমাণিত। প্রসঙ্গত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কৃতিত্বের কথা স্মরণ করার পাশাপাশি লিখেছেন, “উপন্যাসের মত, ছোটগল্প জিনিসটাকেও আমরা পশ্চিম হইতে বঙ্গসাহিত্যে আমদানি করিয়াছি।”
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প দু’টি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বের গল্পগুলিতে পদ্মা তীরবর্তী উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ জীবনই প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। সমকালীন জটিল নাগরিক পরিবেশ থেকে এই পটভূমির পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। দ্বিতীয় পর্বের ছোটগল্প মূলত সবুজপত্রে প্রকাশিত গল্প। এগুলোর ভাব, বিষয় ও রূপকল্পে সম্পূর্ণ নতুনত্ব লক্ষণীয়। তবে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের আসল পালাবদলের শুরু ‘ষষ্ঠনীড়’ রচনার কাল থেকে। তার উত্তরবঙ্গের জীবন অভিজ্ঞতা নির্ভর গল্প ৫৯টি আর নতুন জীবনবোধে সিদ্ধ গল্প ২৩টি। যেগুলো পরবর্তীতে গল্পগুচ্ছে স্থান পেয়েছে। অবশ্য এরপরেও রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখেছেন, তবে সেগুলিতে রবীন্দ্রমানসের প্রতিফলন ততটা নেই। তবুও বাংলা ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিঃসন্দেহে পথিকৃৎ।
এবার আসা যাক সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারা উপন্যাস প্রসঙ্গে। কিশোর রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীর প্রেরণায় প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন ‘করুণা’। প্রায় বছর খানেক ধরে ‘ভারতী’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে লিখেছেন ঐতিহাসিক, সামাজিক, স্বদেশ চেতনা, রাজনৈতিক, কাব্যোপম এবং রোমান্টিক উপন্যাস। রবীন্দ্র উপন্যাসের ভাষাশৈলী সন্দেহাতীত ভাবে বাংলা সাহিত্যের চিরস্থায়ী সম্পদ। যদিও প্রথম দিকের ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ ও ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের ভাষায় সাধু গদ্য এবং বঙ্কিমী গদ্যের প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু পরবর্তীকালে তার উপন্যাসে বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখা দেয়। আর এই পরিবর্তন শুরু হয় ‘ঘরে বাইরে’ থেকে। সর্বোপরি, সাহিত্যের যে কোনো শাখার নাম নিলেই চেতনে অথবা অবচেতনে যে নামটি চলে আসবেই… তিনিই আমাদের রবি। যাকে ছাড়া বাংলা সাহিত্যের বিকাশ এবং সমৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব ছিল।।
loading...
loading...
সাহিত্যের যে কোনো শাখার নাম নিলেই চেতনে অথবা অবচেতনে যে নামটি চলে আসবেই… তিনিই আমাদের রবি। যাকে ছাড়া বাংলা সাহিত্যের বিকাশ এবং সমৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব ছিল।।
loading...