চা বর্তমানে বাংলাদেশ তথা সারাবিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়। সকাল-বিকাল কিংবা যে কোনো অবসন্ন সময়ে এককাপ চা মানুষের শরীরে সঞ্চারিত করে নতুন আমেজ। মুহূর্তেই মন-প্রাণ চাঙা হয়ে ওঠে।
তবে এই চা রাতারাতি জনপ্রিয় হয়নি। এর রয়েছে দীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাস। যতটুকু জানা যায়, চীনের অনুকরণেই ভারতবর্ষে প্রথম চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাই পরীক্ষামূলকভাবে চা-বীজ, চারা ও যন্ত্রপাতির পাশাপাশি চীন থেকে দক্ষ শ্রমিক আনে তারা। কিন্তু বিদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে বনাবনি না হওয়ায় অবশেষে শ্রমিক আমদানি বন্ধ করে দেশীয় শ্রমিক দিয়েই চা-বাগানের কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানি। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় চা চাষের পরিকল্পনা শুরু করে। আসামে চায়ের একটি জাত আবিষ্কার করার পর ওই এলাকায় চা চাষে তারা বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে ওঠে। এভাবে দার্জিলিং, আসাম, সিলেটে কয়েকটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা হয়।
আর বাংলাদেশে চায়ের চাষাবাদ প্রথম শুরু হয় ১৮৪০ সালে। চট্টগ্রামে কুণ্ডুদের বাগান নামে সেই চা বাগান অবশ্য সাফল্যের মুখ দেখেনি। এরপর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিন বছর পর সেই বাগান থেকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, পঞ্চগড় এবং চট্টগ্রাম জেলায় ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান রয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কর্মক্ষম চা বাগান।
স্ট্যাটিস্টিক্যাল হ্যান্ডবুক অন বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রি বুক-২০১৯ এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এসব চা বাগানে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন। অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন এবং চা-জনগোষ্ঠীর মোট মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ ৭২ হাজার ১২৫ জন। কিন্তু এই শ্রমিকরা সবসময়ে এই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন না। এখনো স্থানীয় বাঙ্গালিদের সঙ্গে তাদের ভাষা বা সংস্কৃতির দিক থেকে অনেক পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের সর্বশেষ দলটিকে নিয়ে আসা হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর সিলেট ও চট্টগ্রামের চা শ্রমিকরা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। এরপর তাদের বংশধররাই এখনো বাংলাদেশের চা বাগানগুলোয় কাজ করে যাচ্ছেন।
এইসব চা শ্রমিকদের সাম্প্রতিক কর্মবিরতি তথা আন্দোলন দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, শোষণ এবং বঞ্চনার ফল। আধুনিক বিশ্বে দাঁড়িয়ে… সভ্যতা এবং মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো ধনিক শ্রেণীর মুখের উপর এ যেন চপেটাঘাত মাত্র। এখনও চা শ্রমিকরা অনেকাংশে ১৮৪০ সালের মুজুরি কাঠামোয় পারিশ্রমিক পান। এরচেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে? ভাবা যায় দৈনিক ১২০ টাকা! মাসে ৩৬০০ টাকা! তাও আবার শর্তযুক্ত। অর্থাৎ ২০ কেজি চা পাতা তোলার নিরিখ পূর্ণ করতে হবে! অন্যথায় টাকা কর্তন হবে। আবার এই ১২০ টাকাও নির্ধারণ হয়েছে ২০১৯ সালে। তখন বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে আবার মজুরি বৃদ্ধি করা হবে। কিন্তু সেটা করা হয়নি। সেখান থেকেই ক্ষোভ দানা বাঁধতে বাঁধতে আজকের এই অবস্থা, ধর্মঘট ছাড়া শ্রমিকদের আর কোনো পথ খোলা ছিল না। দীর্ঘ আন্দোলনের পর এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ১৭০ টাকা নির্ধারিত হয়েছে।
আমরা মনে করি, এই ১৭০ টাকাও জীবনযাত্রার মানের সাথে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়। যদিও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দোহাই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, এই অন্যান্য সুবিধা কতটা অপ্রতুল। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চা শিল্পের গুরুত্ব এবং ব্যাপকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শিল্পকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, চা শ্রমিকরা বাঁচলে চা শিল্প বাঁঁচবে এবং চা শিল্প বাঁচলে চা বাগান মালিকরা বাঁচবে। আর তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। তাই চা শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা জরুরি।।
loading...
loading...
চা শ্রমিকরা বাঁচলে চা শিল্প বাঁঁচবে এবং চা শিল্প বাঁচলে চা বাগান মালিকরা বাঁচবে। আর তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। ___ সঠিক।
loading...