কবি বলেছেন, “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়?” একেবারেই যথার্থ উক্তি। মানুষ তো বটেই, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ… এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে প্রায় সকল প্রাণি-ই স্বাধীনতা প্রিয়। পরাধীন মানুষ আর খাঁচায় বন্দি সিংহের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আর এই স্বাধীনতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা৷ একটি দেশের ভৌগলিক অখণ্ডতা। সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি। বিশ্বের মানচিত্রে আলদা জাতিসত্ত্বা হিসাবে মানচিত্রের উপস্থিতি এবং সগৌরবে উড্ডীন জাতীয় পতাকা। অত্যন্ত গৌরব এবং অহংকারের জায়গাটি হল, আমাদের এসব কিছুই আছে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সর্বাত্মক সংগ্রামের ইতিহাস আছে। সেজন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা কোনোদিন শেষ হবে না।
তবুও মনের ভেতরে খচখচ করে। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত এবং সঠিক ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পারিনি। আফসোস হয়, যখন দেখি এখনো সভা, সেমিনারে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লাগামহীনভাবে প্রচার করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো এমন একটি সার্বজনীন বিষয়েও আমরা দলীয় সংকীর্ণতা বিসর্জন দিতে পারিনি। প্রতিটি দলের আদর্শগত মত-পার্থক্য থাকবেই। এটি অস্বীকার করছি না। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট অভিমত থাকবে? রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের প্রপাগান্ডা থাকবে? ইতিহাসের বিকৃতি থাকবে? সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যদি আমরা এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিই.. তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস কীভাবে শিখবে, কার নিকট থেকে শিখবে?
শুধু এখানেই শেষ নয়। পরিতাপের সহিত বলতে হয়, এখনো আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাংগ তালিকা করতে পারিনি। পঞ্চাশ বছর পরেও এই তালিকায় সংযোজন- বিয়োজন হচ্ছে। কাটা ছেঁড়া হচ্ছে। কেউ বাদ যাচ্ছেন আর কেউ নতুন করে তালিকায় ঢুকছেন। ভাবতেই ভীষণ অবাক লাগে, এতো বছর পরেও একটি পূর্ণাংগ তালিকা করতে না পারার দায় আমরা কেউ নিই না। একজন আরেকজনের উপর চাপিয়ে দিই। একদল অন্য দলের উপর চাপিয়ে দেয়। অথচ আমার জানা মতে, বিশ্বের কোন দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে এহেন হ-য-ব-র-ল নেই। আমি মনে করি, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার হীন উদ্দেশ্যেই এই অবস্থার তৈরি হয়েছে। যা বহির্বিশ্বে দেশের গৌরব এবং সম্মান বিনষ্ট করছে। আমরা দ্রুত এই অবস্থার অবসান চাই। দলমত নির্বিশেষে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা চাই। জাতির সূর্য সন্তান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যথার্থ মূল্যায়ন চাই। আমরা চাই, ভাষা আন্দোলনের যেমন সর্বজন গ্রহণযোগ্য ইতিহাস আছে, ভাষা শহীদদের তালিকা আছে; মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও তেমনি হোক। যা নিয়ে কোনো বির্তকের অবকাশ থাকবে না। আর এটি করতে পারলে আমি বিশ্বাস করি, নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না। সত্যিকার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই তারা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করবে। বিশ্বের বুকে আমাদের প্রানপ্রিয় বাংলাদেশকে উপস্থাপন করবে।
আমরা ভৌগলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। মানচিত্র, পতাকা, জাতীয় সংগীত পেয়েছি। তবুও আমাকে শিরোনাম লিখতে হয়েছে, প্রকৃত স্বাধীনতার সুঘ্রাণ আর কতদূর.! কিন্তু কেন? এর কারণ হল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনও প্রকৃত স্বাধীনতার সুঘ্রাণ পুরোপুরি পাইনি। এখনও দেশের মানুষের আয়-বৈষম্য চরম পর্যায়ে। ধনী আরও ধনী হচ্ছে। দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। এখনও অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এখনও আমরা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ পারিনি। পারিনি সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, চোরাচালান, মানব পাচার, হত্যা, ধর্ষণ, গুম, মানি লন্ডারিংয়ের মূলোৎপাটন করতে। পারিনি প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে। পারিনি ভারী শিল্পের বিকাশ ঘটাতে। পারিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাঙ্খিত প্রসার ঘটাতে। দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরলেও পরিবেশ, প্রতিবেশ, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং মানব উন্নয়ন সূচক এখনও উচ্চ ঝুঁকিতে। এসব ক্ষেত্রে উন্নয়নসহ সার্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু কাগজে কলমে নয়, প্রকৃত অর্থে আইনের শাসন অত্যন্ত জরুরি৷
তবেই আমাদের গ্রিলকাটা চোরের ভয়ে কুঁকড়ে মুকরে রাত্রি যাপন করতে হবে না৷ দরজা-জানালা খোলা থাকলেও যেদিন বুক ফুলিয়ে ঘুমাতে পারব, সরকারি অফিসে ফাইল জমা দিলে কোনো প্রকার তদবিরের প্রয়োজন হবে না — সেদিনই আমরা প্রকৃত স্বাধীনতার সুঘ্রাণ আস্বাদন করতে পারব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে, দেশের অর্থনীতির চাকা বর্তমানে যে গতিতে ঘুরছে, সেই গতি অব্যাহত থাকলে আমাদের সবার কাঙ্খিত সেইদিন হয়ত খুব বেশি দূরেও নয়।
loading...
loading...
প্রকৃত স্বাধীনতার সুঘ্রাণ … দেশের অর্থনীতির চাকা বর্তমানে যে গতিতে ঘুরছে, সেই গতি অব্যাহত থাকলে আমাদের সবার কাঙ্খিত সেইদিন হয়ত খুব বেশি দূরে নয়।
loading...
সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
loading...