বাঁশের বাশি এবং

কী দুরন্তপনায়ই না কেটেছে আমাদের শৈশব! স্পষ্ট মনে আছে, একবার বাঁশের গুলতির বায়না ধরেছিলাম বাবার কাছে। বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটা হলো, বাঁশ থেকে খাপ বানানো হলো। তিন সূতার পাটের দড়ি পাঁকানো হলো। খাপের দুই পাশে দড়ি টানিয়ে ধনুক আকৃতির গুলতি তৈরি করা হলো। অতঃপর রঙ-বেরঙের মার্বেলের গুলিতে পাখি শিকার বেড়িয়ে পড়া ! আহা কি আনন্দ!

স্কুল থেকে বাসায় যাওয়ার পথে একটা রিকসা ফ্যাক্টরী ছিলো। স্কুল ছুটি হলে এর সামনে দাঁড়িয়ে রিকসা বানানো দেখতাম। সেই বাঁশ কেটে খাপ বানানো, দড়ি টানা দিয়ে বাঁকানো খাপে হুড বানানো, হুডের ঢাকনায় রঙ করা, ব্যাকপ্লেটে নীতিবাক্য লেখা ইত্যাদি। আমার খুব ভালো লাগতো।

তখন বর্ষাকাল। আমরা প্রায় প্রতিদিন ছাতা মাথায় পায়ে হেঁটে স্কুলে যাই। একবার আমার এক সহপাঠী এঁটেল মাটির রাস্তায় পা পিছলে আলুর দম। হাড় দু’টুকরা হয়ে গেলো। আমরা তাকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে গেলাম। কবিরাজের ডাক পরলো। তিনি এসে গাছের শিকড় প্যাচিয়ে পায়ে শক্ত ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। কিছুদিন পর হাড় জোড়া লেগে গেলো। কিন্তু হায়! সে সোজা হয়ে হাঁটতে পারলো না। শহরে বড় ডাক্তারের কাছে নেয়া হলো। এক্সরে করা হলো। দেখা গেলো, জোড়া খাপে খাপ হয়নি, হাড়ের উপর হাড় পাশাপাশি জোড়া লেগে গিয়েছিলো। ব্যাপারটা অপারেশনে গড়িয়েছিলো। তারপরও কি এই পা সেই পা হয়!

আমাদের গ্রামে প্রতি শনি ও বুধবারে হাট বসতো। হাটবারে রাস্তার পাশে একটি কুঁজো ছেলে ভিক্ষে করতো। আমরা স্কুলে যাওয়া আসার সময় দেখতাম, সে সুর করে ভিক্ষা চাইতো। একদিন পাশের গ্রামে ফুটবল খেলতে গিয়ে দেখলাম, আসলে ছেলেটি কুঁজো নয়। কিন্তু সে এই ব্যবসা চালিয়ে গেলো। আমি মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে, কলেজ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। বহুদিন আর ছেলেটির সঙ্গে দেখা নেই। হঠাত একদিন দেখি সত্যি সত্যি সে কুঁজো হয়ে গেছে …

আজ প্রায় শেষ বয়সে উপনীত হয়েছি। চাকুরী থেকে অবসরের প্রস্তুতি নিচ্ছি। হাতে সময় জমা হলে বসে বসে অতীত রোমন্থন করি আর ভাবনার সমুদ্রে হাবুডুবু খাই – টেনে বেঁধে রাখলে কেমন করে বাঁশ বাঁকা হয়ে যায়, হাড় অসমানভাবে জোড়া লাগে, অভ্যাসে পিঠ কুঁজো হয়, এমনি আরো কত কি?

আমাদের শিশুরা বড়ই অনুকরণপ্রিয়। তাদেরকে আপনি যা শিখাবেন তাই শিখবে। শিখন অভ্যাসে পরিণত হবে একদিন। আর তারা যখন পুর্ণাংগ মানব/মানবী হয়ে উঠবে তখন আর অভ্যাস বদলানো যাবে না। তাই আমাদের এখনই ভাবতে হবে, আমাদের সন্তানদের আমরা কি শেখাবো; সত্যি না মিথ্যে? অভিনয় না বিনয়? নির্বিচারে বাঁশ ঢোকানো, বাঁশের কেল্লা বানানো, নাকি বাঁশ দিয়ে বাঁশি বানানো?

আমাদের ছেলে মেয়েরা কি শিখছে ? কি অভ্যাস করছে ? ভালো কিছু শিখলে/ অভ্যাস করলে, আলহামদুলিল্লাহ্। কিন্তু আল্লাহ না করুন, নেগেটিভ কোন অভ্যাস গড়ে উঠলে, সেটা পারমানেন্ট কুঁজে পরিণত হবে – এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৫-০৭-২০২১ | ১১:২৫ |

    স্মৃতি চারণায় যাপিত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। অংশত সমাজ ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল রাখতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। অভিভাবকদের অবস্থানগত দৃঢ়তা এবং সৎ মানসিকতার সাপোর্ট সন্তানদের জন্য আশীর্বাদ। টেক কেয়ার শব্দটি কেবলমাত্র আংশিক কেয়ার হয়ে গেলেই বিপদ। রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। 

    GD Star Rating
    loading...
  2. নিতাই বাবু : ১৫-০৭-২০২১ | ১৪:১০ |

    এখনকার ছেলেমেয়েরা এন্ড্রয়েড মোবাইল নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। ছেলেমেয়েদের মা-বাবা ভাইবোনরাও তা দেখে খুব খুশি হয়। তাহলে আর সমস্যা কোথায়? কিন্তু আমাদের সময়টা ছিলো অন্যরকম।

    লেখকের জন্য শুভকামনা থাকলো।

    GD Star Rating
    loading...
  3. ফয়জুল মহী : ১৬-০৭-২০২১ | ৪:২৯ |

    সুন্দর লিখেছেন l আন্তরিক শুভ কামনা রইল।

    GD Star Rating
    loading...