স্থানঃ মৃত্যু দুয়ার দিয়ে অমরত্বে প্রবেশের দ্বারপ্রান্ত
সময়ঃ মধ্যরাতের পর থেকে সকাল
কুশীলবঃ (এই পর্যন্ত)
১) ১ম প্রহরী
২) ২য় প্রহরী
৩) ৩য় প্রহরী
প্রথম দৃশ্য
বিশাল ধু ধু প্রান্তর- চারিদিকে ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। অতিদূর হতে পোঁ পোঁ ভোতা সাইরেন শোনা যায় ।
(দুজন প্রহরীর একইসঙ্গে প্রবেশ-গায়ে কোন খাকি পোশাক, কান্ধে রাইফেল নেই তবুও এরা প্রহরী, দেখতেই মনে হয় তালপাতার সেপাই)
১ম প্রহরীঃ (২য় জনের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে) তোমার নাম কি ভাই ? কোথা থেকে এসেছো?
২য় প্রহরীঃ ভাই বলছো কেন ? জানো না অন-ডিউটি ঊর্ধ্বতন’কে স্যার ডাকতে হয়। ঠিক করে আবার বলো, নইলে রিপোর্ট ঠুকে দেব।
১ম প্রহরীঃ আপনি আমি দুইজনেই আসছি গার্ড দিতে কেউ যেন অবৈধভাবে ঢুকে যেতে না পারে, আপনার কান্ধেও কোন ব্যাজ নাই- হাতে পিস্তল নাই, র্যাঙ্ক তো বোঝারই উপায় নাই। তবে আপনার গাল ভাঙ্গা, চুল অর্ধেক নাই; মনে হয় বড়ই হবেন বয়সে। সেইখান থেকেই বলতেছি যখন বলছেন, ‘আপনার নাম কি স্যার? নিবাস কোথায়?’
২য় প্রহরীঃ এইতো ! তোমার ভিতরে আদব লেহাজ আছে দেখেই বোঝা যায় তুমি ভদ্র বংশের শুধু একটু ঝালিয়ে দিতে হবে। চিন্তা করো না। আমার সাথে যখন কাজ করতেছো একদম র্যাতের মত সোজা হয়ে যাবে। আমি যখন প্রথম জয়েন করি তখনকার সময় তো আর নাই। আমাদের অফিসার ছিলেন মিঃ অনুপম। আহা ! যেমন নাম তেমনি তার আচার ব্যবহার। কাজও ছিল চমৎকার বিন্যস্ত। যে কথা বলতেন সেইটাই করতেন, কোন নড়চড় নাই। এখন তো আর সেই সময় নাই। আচ্ছা তুমি যেন কোন ব্যাটালিয়নের ছিলে ?
১ম প্রহরীঃ আমি ছিলাম ৮৭(খ) ব্যাটেলিয়ন, কিন্তু আপনার নামটাই তো জানা হলো না। কোথা থেকে আসছেন সেটাও বললেন না। নাম পরিচয় না জেনে একত্রে কাজ করতে কেমন যেন উসখুস করতেছে।
২য় প্রহরীঃ তোমাকে এইখানে আনা হয়েছে গার্ড দেয়ার জন্য। গার্ড মানে বোঝ ? নজর থাকতে হবে বাজপাখির মত, দৃষ্টি থাকতে হবে বাঁদুরের মত আর কান থাকতে হবে কুকুরের মত। তোমার সাথে আছি প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল, আমার বুকের উপরে বাম পাশে দেখতে পাও না খাস বাংলায় আমার নাম লেখা আছে নেইমপ্লেটে ! নাকি পড়তে লিখতে জানো না। টিপসই দাও?
১ম প্রহরীঃ অনুপম স্যারের কথা বললেন বলে, তিনি ছিলেন ৭৭ ব্যাচের। দেখলে মনে হয় না আপনি আমার থেকে দশ বছরের সিনিয়র। আপনার জ্ঞান বুদ্ধি আমার থেকে বেশী সেটা বোঝা যাচ্ছে তবে আপনি যে নজরের কথা বলছেন বাজ পাখির মত, বাদুরের মত; এইখানে যে ঘুটঘুটে অন্ধকার স্বর্গের অপ্সরা দুই হাত দূর দিয়ে হেঁটে গেলেও টের পাওয়া যাব না। আপনার বুকের উপরে লাগানো নেইমপ্লেট দেখা যাচ্ছে না।
২য় প্রহরীঃ হ্যাঁ সেটা অবশ্য মন্দ বলো নি, অন্ধকার বড্ড বেশী। আচ্ছা এই তোমার কাছে কোন টর্চ লাইট টাইট নাই ? থাকলে মারো তো, কাছেই কি যেন খচখচ করে উঠলো।
যাইহোক, আমার নাম অর্জুন। এটা অবশ্য আমার আসল নাম না। তবে সবাই আমাকে এই নামেই চেনে। খুব ভালো তীর মারতে পারতাম বলে আমাকে এই নাম দেয়া হয়েছিল। অনুপম স্যার আবার বেশিই মহাভারত পড়তেন।
১ম প্রহরীঃ টর্চের কোন ব্যবস্থা নেই। এটা একটা বিশেষ অভিযান বলে কোন ধরনের আলো দেয়া হয় নাই। আলোতে নাকি ওদের চোখের জ্যোতি বেড়ে যায় তাই এই মিশনে আলো একদম নিষিদ্ধ। আমার নাম–
২য় প্রহরীঃ (মুখের কথা কেড়ে নিয়ে) তোমার নাম পরে জানা যাবে, দুর্যোধন নিশ্চয়ই নয়। এখান দেখো তো কারও আনাগোনা টের পাও কিনা। রেল লাইনে কান লাগাবার মত শুয়ে পড়ে কান মিশিয়ে দাও মাটিতে, পাখির মত শূন্যে ভাসান দিয়ে কান পাতো বাতাসে – দেখো যদি কিছু শুনতে পাও। নাহলে এইখানে মাছিও নেই যে মারবে।
(বিপরীত দিকে ঘুরে, কিছুটা হেঁটে গিয়ে জোরে চেঁচিয়ে) আমি এইখানেই আছি। একটা লাঠি পুতে যাও। আমি একটু এলাকাটা ঘুরে ফিরে দেখি। আমি উত্তরে যাচ্ছি তুমি দক্ষিণে যাও। পূর্ব পশ্চিমে কেউ মরতে যাবে না। সাবধানে যেও। তুমি আমার যত ছোটই হয় না কেন, তোমাকে তাচ্ছিল্য করা ঠিক না। র্যাংঙ্ক এখন তোমার আমার একই। বেশী সৎ থাকলে যা হয় প্রমোশন পাওয়া যায় না।
১ম প্রহরীঃ কোন সমস্যা নেই স্যার, আপনি বলুন যা ইচ্ছে। আমি এই লাইনে নতুন না।
২য় প্রহরীঃ স্যার বলছ কেন ? নিজের ইচ্ছায় নাকি ভয়ে ? যা ডাকছিলে তাই ভালো। ভাই ডাকো। যেদিকে যেতে বলেছি সে দিকে যাও, কুড়ি মিনিট পরে এসো ঠিক এইখানে। এখন যাও, আমিও যাই। ফ্ল্যাগ পুতে যেতে ভুলে যেও না বুঝেছো দুর্যোধন।
২য় দৃশ্য
( কাঁটাতারের সীমান্ত ভেদ করে পঙ্গপালের মত সবাই কেমন ওইদিক থেকে এইদিকে চলে আস্তে চাইছে। সবাই অসভ্যের মত হাউকাউ করছে। এখানে এত সোরগোল অথচ এতক্ষণ দূরে থেকে কিছুই টের পাওয়া যায়নি। আরও আছে যেতেই শব্দ আরো স্পষ্ট হতে লাগলো। সবাই একেবারে মিছিল দিয়ে আসছে, হাতে ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড-ব্যানার। উদ্ভট সব ব্যানার পোষ্টার। কি লেখা নেই তাতে !
বাঁচতে বাঁচতে মরে গেছি- এবার তবে মরতে দাও
এর নাম বাঁচা হলে মরা তবে কারে কয় ?
জীবন যদি না চাইতেই পাই, মরণ কেন স্বেচ্ছায় নয় ?
টিপিক্যাল রাজনৈতিক স্লোগানের মত সামনে থেকে একজন ইন্ধন দিচ্ছে পেছন থেকে সবাই কোরাস দিচ্ছে-
বাঁচতে বাঁচতে মরে গেছি- এবার তবে মরতে দাও – মরতে দাও- মরতে দাও-মরতে দাও
এর নাম বাঁচা হলে মৃত্যু তবে কাকে বলে – মৃত্যু তবে কাকে বলে- মৃত্যু তবে কাকে বলে।
জীবন যদি না চাইতেই পাই, মরণ কেন স্বেচ্ছায় নয় ?- মরণ কেন স্বেচ্ছায় নয় ?- মরণ কেন স্বেচ্ছায় নয় ?- জবাব চাই ! জবাব চাই !
(মৃত্যুর এত মিছিল দেখে প্রহরীরা ভয় পেয়ে গেল। এত মানুষ মরতে চাইছে। পৃথিবীতে আর কেউ বাঁচতে চাইছেই না ! সবার পাখা গজিয়েছে। এত-বড় মৃত্যুর মিছিল দেখে প্রহরী এক দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আগে পুতে রাখা ফ্ল্যাগের কাছে চলে এলো। এসে দেখে ২য় প্রহরী আগে থেকেই এসে হাজির।)
১ম প্রহরীঃ (হাঁপাতে হাঁপাতে) অর্জুন স্যার ! ওইদিকে কি হাল? এদিকের অবস্থা সুবিধার না। সব একেবারে পঙ্গপালের মত মরণের মিছিলে নেমেছে। এই ঢল একবার কাঁটাতার পেরিয়ে গেলে যমদূত পর্যন্ত পৌঁছে যাবে নিশ্চিত। এদের কেউ আটকাতে পারবে না।
২য় প্রহরীঃ শান্ত হও ! শান্ত হও ! তুমি অনেকটা পথ দৌড়ে এসেছো। কিছুটা বিশ্রাম নাও। বুক ফুলিয়ে ছাতি পর্যন্ত বাতাস ঢুকাও। এখন যা বলি মন দিয়ে শোন।
১ম প্রহরীঃ বলুন স্যার-
২য় প্রহরীঃ তোমার মনে আছে দুই বছর আগে ইলেকশনের সময় বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ইশতেহার কি ছিল ? তারা কি কি ওয়াদা দিয়েছিল ?
১ম প্রহরীঃ মনে আছে বৈকি, ঐ-তো বলেছিল- ‘যার জীবন তার তার, বাঁচতে যখন কষ্ট হয়- মৃত্যুতে বাধা নয়’।
২য় প্রহরীঃ সাব্বাস ! পুরোটাই মুখস্থ আছে দেখছি ! চকচকে মেধা তোমার, সিভিল সার্ভিসে কততম হয়েছিলে ? দশের বাইরে যাওনি নিশ্চয়ই?
১ম প্রহরীঃ একটুর জন্য ফার্স্ট হতে পারি নি স্যার, এমন একটা আন-কমন প্রশ্ন দিয়েছিল যেটা একদম সিলেবাসের বাইরে ছিল; পৃথিবীতে শেষ কবে মানুষ মারা গিয়েছিল তারিখ লিখ?
আপনিই বলেন স্যার ! মানুষ মরেছে সেই কবে কোন আমলে সেই ইতিহাস দিন তারিখ কি মনে রাখা সম্ভব ?
আমার বাপের আমলে না, তার বাপের আমলেও না, তার বাপের আমলে মনে হয় একজন মরেছিল, তাও খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ধরা পড়তে পড়তে মরে যেতে পেরেছিল, ধরা পড়লেই ঢুকিয়ে দিত আজীবন হাজতে।
২য় প্রহরীঃ ইশ ! গাধা তুমি ! দুইশ চারশো বছর আগের একটা তারিখ দিলেই হয়ে যেত, এত আগের ডেট কেউ খুঁজতে যাবে ? শত বছর আগের হিসেব দেখে এগজামিনারও ভেবে নিত ঠিকই লিখেছো ! যাইহোক, পেছনের ইতিহাস বাদ্ দাও, যে ইতিহাস সামনে সৃষ্টি হবে সেটা মনে রাখবো কিভাবে সেটা ভাবো। আন্দোলনের যা অবস্থা, মরতে তো এবার দিতে হবেই—
তৃতীয় দৃশ্য
(ভোরের আলো অল্প-অল্প ফুটতে শুরু করেছে। প্রহরী দুজনেই সারা রাত জেগে জেগে ক্লান্ত হয়ে প্রায় আধো-ঘুম পর্যায়ে। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের শিফট পরিবর্তন হবে। অন্য দুইজন প্রহরী আসবে। এদের ছুটি হবে। বেশী সময় নেই। এরই মধ্যে দিনের রিপোর্ট লিখে কেন্দ্রে জমা দিয়ে সাক্ষর দিয়ে যেতে হবে।
প্রথম প্রহরী ঝুঁকে ঝুঁকে কাগজের উপর রিপোর্ট লিখছে- ঠিক এমন সময়ে দৌড়াতে দৌড়াতে একজন প্রহরীর আগমন। )
৩য় প্রহরীঃ আমি ১৯ ব্যাটালিয়ন-১৭(ল) কেন্দ্রীয় কমান্ড–
২য় প্রহরীঃ পরিচয় দিতে হবে না, দেখে চিনেছি। কি ব্যাপার এক ঘণ্টা আগেই এসে গেছো? আর তুমি একা কেন ? তোমার সাথেরজন কোথায় ?
৩য় প্রহরীঃ আজকের পর থেকে মনে হয় আর কোন চৌকির দরকার হবে না। উপরের আদেশ আছে, যারা যারা মৃত্যুর জন্য আন্দোলন করছে তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যেতে। এমনভাবে ধরে নিয়ে যেতে হবে যেন তারা বুঝতে পারে যে তাদের দাবী মেনে নেয়া হয়েছে। এই কাজের জন্যই আমাকে পাঠিয়েছে আপনাদের খবর দিতে আর সাহায্য করতে।
১ম প্রহরীঃ হাজার হাজার লাখো লাখো মানুষ মিছিল দিচ্ছে, কয়জনকে ধরে নিয়ে যাবেন ?
২য় প্রহরীঃ আহ ! তুমি একদম বে-আক্কেল। কি শিখলে এই কয় বছরে ? সবাইকে ধরে নিতে হবে কেন ? যাদের হাতে ব্যানার-ফ্যানার ছিল তাদের পাঁচ-ছয়জনকে নিয়ে গেলেই হবে।
৩য় প্রহরীঃ একদম ঠিক বলেছেন জনাব, আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। আমিও এমনটাই ভাবছিলাম।
২য় প্রহরীঃ কিন্তু আমি ভাবছি, এদেরকে নিয়ে করবে টা কি ? মেরে তো ফেলবে না, তাহলে কি মিটিং করবে ? পারস্পারিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দ্বি-পক্ষীয় বৈঠক ? বৈঠকে এরা মানবে না। এদের খুন কাঁচা লাল, বড্ড তেজ। মৃত্যু এদের চাইই-ই
১ম প্রহরীঃ এত ভেবে কাজ কি ? চলেন আদেশ যা এসেছে পালন করি তারপর ঘুমাই। সারা রাত জেগে আছি। চোখ লেগে আছে। বাড়িতে আমার বৌ-বাচ্চা আছে।
২য় প্রহরীঃ তোমার বয়স বাড়ছে না কমছে ? কিছুই বুঝতে পার না ! কেবল ঘুমাতে চাও-
১ম প্রহরীঃ বয়স বাড়লেই কি আর কমলেই কি ? জীবনে তো মরতে পারবেন না। বয়সের চিন্তা তাই অনেক আগেই বাদ দিয়েছি।
৩য় প্রহরীঃ সে কিন্তু ঠিকই বলেছে স্যার, আমার পর-দাদু, কিছুই করতে পারে না। খেতে পারে না, কথা বলতে পারে না, হাঁটতে পারে না। একদম অথর্ব হয়ে আছে, সেজন্য গতমাসে মৃত্যুর জন্য আবেদন করেছিল। খারিজ করে দিয়েছে। মরতে যে আমরা পারব না সেইটা তো মেনে নিয়েই আছি স্যার।
১ম প্রহরীঃ এসব ফিলসফি বাদ দিয়ে চলেন, পূব দিকে যাই। বেলা হয়ে যাচ্ছে। ওখান অনেকে স্লোগান দিচ্ছিলো, ওদের কয়েকজনকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাই-
– চলবে————–
জাহিদ অনিক
২১-৮-২০১৮
loading...
loading...
বহুকাল আগে শব্দনীড়ে নাট্যাংশ পড়েছিলাম। আজ আবার ফিরে পেলাম। অভিনন্দন দাদা ভাই।
loading...
হুম ! জানিনা নাটকের ন-ও হচ্ছে কিনা–
ধন্যবাদ দিদিভাই
loading...
নিঃসন্দেহে অসাধারণ আয়োজন। অভিনন্দন মি. জাহিদ অনিক। ঈদ মোবারক।
loading...
অনেক অনেক ধন্যবাদ মুরুব্বী- আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা
ঈদ মোবারাক
loading...