অস্তিত্ব

সন্ধ্যার বেশ কিছু সময় পরের কথা, সারা দিনের খাটাখাটনির পরে বাসে করে বাসায় ফিরছি। সকাল ৭ টায় বের হয়ে বাসায় ফিরছি প্রায় রাত ১০ টার কিছু পরে।

মাঝখানে তিনবার হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি হয়ে গেছে, ভিড়-বাট্টায় কোথায় যেন ছাতাটাও হারিয়ে ফেলেছি। লাঞ্চ ব্রেকফাস্ট কিছুই তেমনভাবে করা হয় নি; সন্ধ্যার পরে খিদেটা বেশ জেঁকে বসেছিল কিন্তু তাড়াহুড়ার কারণে পাত্তা দিতে পারিনি।
যখন মনে পড়ল সারাদিনে প্রায় কিছুই খাইনি চটজলদি একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। ওয়েটার আসলো; হড়বড় করে দুনিয়ার যত খাবার আছে সবগুলোর নাম বলে জিজ্ঞেস করল
-কি খাবেন স্যার ?

স্যার বলে কেউ ডাকলে খুব বিব্রত-বোধ করি। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হোটেল ছেড়ে উঠে গেলাম। পাশের টং দোকানের থেকে এককাপ চা খেয়ে ভাবলাম বেশ হয়েছে, অনেক খেয়েছি। চা খাওয়ার সাথে একটা সিগারেট খাওয়া জরুরী ছিল। কিন্তু সিগারেট খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছি প্রায় কুড়ি দিন। মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করে শেষ অবধি জিতে গেলাম; খেলাম না সিগারেট!

হেড-ফোনটা কানে লাগিয়ে বাসে সিট না পাওয়ার আক্ষেপ ভুলে যেতে ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে দিয়ে রড ধরে ঝুলছি। জ্যাম, বৃষ্টির জল, কাদা প্যাঁ পো হৈ-হুল্লোড় সব ঠেলে নিয়ে এগুচ্ছে বাস। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে একজন যাত্রী নেমে গেলে একটা সিট ফাঁকা হল; ততক্ষণে বাসের ঝাঁকুনি আর হেড-ফোনের গানের তালে তালে বেশ একটা জমে গেছে। সিটে বসে গেলে এই রিদমটা আর থাকবে না তাই পাশেই দাঁড়ানো অন্য একজনকে ইশারা করে সিটটাতে বসতে বললাম।
ধন্যবাদ সূচক মুচকি হাসি দিয়ে তিনি বসে পড়লেন। তার কিছুক্ষণ পরে আরও একটা সিট খালি হল। এবার আর না বসে পারা যায় না। বসে পড়লাম। পাশের সিটে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। বেশ পরিপাটি হয়ে কোথাও যাচ্ছেন হয়ত। শার্ট প্যান্ট চুল সবকিছুই একেবারে টিপটাপ। শার্টের রন্ধ্র রন্ধ্র থেকে বেশ দামী পারফিউমের ঘ্রাণ পাচ্ছি। কেমন একটা মাদকতা লেগে আছে। এমন ভাল সুগন্ধি পারফিউমের ঘ্রাণ অনেকদিন পাই না। ব্যক্তিগতভাবে নিজে কোনদিন পারফিউম ব্যবহার করেছি বলে মনে পড়ে না, খুব একটা ইচ্ছেও হয়নি কোনদিন। কিন্তু আজকে এই এত সুবাস নাকে আসার পর থেকেই ইচ্ছে করছে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ভদ্রলোকের কাছে পারফিউমের নামটা জিজ্ঞেস করি।
কিছুক্ষণ পরেই তাকিয়ে দেখি পাশের সিটে বসা যাত্রী বেঘোরে ঘুমচ্ছেন। নিশ্চয়ই সারাদিনের ক্লান্তিতে উনিও বেশ ক্লান্ত। আহা বেচারা ঘুমানোর ফুসরতই হয়ত পায় নি।

কোনমতে বসে গান শুনছি আর অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই বাসায় ফিরব এই আশায় ঝিম ধরে বসে আছি। মনে মনে একটু খুশিও লাগছে পুরো সপ্তাহ পরে কাল পরশু দুইদিন ছুটি। আহ !

বাস আগাচ্ছে না, বৃষ্টিতে পানি জমে রাস্তা জ্যামে আটকে গেছে। অনেকটা সময় কেটে গেছে। মাঝখানে একবার বাদাম ওয়ালা, পানি ওয়ালা পেয়ারা ওয়ালা ডেকে গেছে। এর পরেই এলো পপকর্ন ওয়ালা। একটা পপকর্ন কিনলাম। শুকনা খাবারের মধ্যে পপকর্নটাই একমাত্র প্রিয়। প্যাকেটটা খুলে কয়েকটা দানা মুখে দিলাম। বেশ ভালই লাগছে। খাচ্ছি। পপকর্নের মচমচ শব্দে শব্দে কখন যে এই তালের সাথে তাল মিলিয়ে ঝুমঝুম বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে টেরই পেলাম না। জানলার কাচ খোলা ছিল, বৃষ্টির ঝাপটা গায়ে লাগতেই পাশে বসা ঘুমন্ত যাত্রী রে রে করে জেগে উঠল। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল- বৃষ্টি হচ্ছে নাকি ভাই !

বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ১২ টা। ক্লান্তিতে চোখ মুখ বুজে আসছে। বিছানার চাদরটা যেভাবে ছিল সেভাবেই রইলো, বালিশের একটা কোনা ধরে টান দিয়ে শুয়ে পড়লাম। পিছনের পকেট হতে মানিব্যাগটা বা হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বালিশের পাশে ফেলে দিলাম। মানিব্যাগের সাইজ ও ওজন বুঝে মনে হল টাকা পয়সা কমে গেছে। মাসের এখনও কয়েকটা-দিন বাকী। টাকা পয়সা যে কিভাবে যাচ্ছে ! ক্লান্তিতে চোখ মেলে রাখা দায় কিন্তু টাকার চিন্তায় ঘুম আসছে না।
যারা বলে টাকা কোন সমস্যা না তাদের সাথে আমি একমত না। টাকাই পৃথিবীর সবথেকে বড় সমস্যা। টাকা ! টাকা! টাকা !

ছোটবেলায় বাবা মাকে দেখতাম তাদের বেতনের টাকা নির্দিষ্ট একটা জায়গায় জমা করে রাখতেন এবং সেখান থেকেই টাকা নিয়ে সাংসারিক খরচ মেটাতেন। দুজনের বেতন-টাকা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে মোট কত টাকা হল সেটা তারিখ দিয়ে ডাইরিতে লিখে রাখতেন এবং যে যখন যত টাকা নিতেন সেটা কোন উদ্দেশ্যে নিচ্ছেন সেটা লিখে সিগনেচার করে রাখতেন। তখন আমি বুঝতাম না, নিজেরদের টাকা নিজেরা খরচ করছেন তাতে আবার এত লেখাজোঁকা সিগনেচার এসবের কি আছে !
এটা যে মাসশেষে একটা হিসেব রেজিস্টারের মত কাজ করত কিছুদিন আগেও সেটা আমি বুঝতাম না ! সত্যি কথা বলতে যতদিন বাপের টাকা উড়িয়েছি ততদিন টাকার হিসেব বুঝি নি। নিজের কামানো টাকা থেকে একটা পয়সা খরচ করতে গেলেও কয়েকবার ভাবতে হয়।

ভাবতে ভাবতে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখি রাত দুইটা ত্রিশ! প্রায় আড়াই ঘন্টা হল ময়লা বিছানার উপরে শুয়ে আছি। শার্ট প্যান্ট কিছুই বদলানো হয়নি। জামাটা শুঁকে দেখলাম বিশ্রী ঘামের গন্ধ! মনে মনে বেশ আক্ষেপ হচ্ছিল, ইশ! কেন যে যে পাশের সিটের ভদ্রলোকের কাছে পারফিউমের নামটা জিজ্ঞেস করলাম না !

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২০-১০-২০১৭ | ০:০৭ |

    আপনার লিখার সাথে সাথে আমিও যেন ঘুরে এলাম কানে হেডফোন গুঁজে।
    চমৎকার মি. জাহিদ অনিক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • জাহিদ অনিক : ২০-১০-২০১৭ | ০:৪৩ |

       আমিও যেন ঘুরে এলাম কানে হেডফোন গুঁজে।  

       

       

      তাহলে তো আপনি নিশ্চয়ই পারফিউমের নামটাও জানবেন ! 

       

      হাঃহাঃ 

       

      অনেক অনেক ধন্যবাদ মুরুব্বী। 

      GD Star Rating
      loading...