আগস্ট এলেই গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়
প্রতি রাতেই ঘুম ভেঙে যায়।
জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি
আঘাত পেয়েছি
অবহেলা পেয়েছি
অল্প শোকে হয়েছি কাতর
অধিক শোকে হয়েছি পাথর
সসীম শোকে হয়েছি নিথর
অসীম শোকে হয়েছি নিষ্ঠুর
আর আগস্ট এর শোকে হয়েছি বিমূঢ়।
আগস্ট এলেই কি যেনো একটা হারিয়ে ফেলি,
হয়ে যাই হতভম্ব, নির্বাক
হয়ে যাই হতবুদ্ধি, হতবাক
আগস্ট এলেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো,
মুয়াজ্জিনের সুমধুর আযানের ধ্বনি
সাথে সাথেই ব্রাশফায়ারের গুলির শব্দ
গুলি আর আযানের ধ্বনির মিশ্রণ
এক অজানা ভয় এবং ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কে যেনো বলে উঠলো,
“এই মাত্র ওরা আমাকে নিচতলার ড্রয়িং রুমে গুলি করলো”
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় আমার জানা ছিলো,
বুঝলাম এটা শেখ কামালের কণ্ঠ।
আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম,
ঘড়িতে এখন ভোর চারটা পঁয়তাল্লিশ।
কত তারিখ আজ?
মোবাইলের ক্যালেন্ডার দেখলাম
আজ ১৫ই আগস্ট
কত সাল এটা ?
আবারো মোবাইলের ক্যালেন্ডার দেখলাম
এটা উনিশ্য পঁচাত্তর সাল।
একটি ভারি নারী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“বিচার করো”
“বিচার করো”
আরে ! এটা কী বঙ্গমাতার কণ্ঠ না?
আবারো মোবাইলের ক্যালেন্ডার দেখলাম
এটা উনিশ্য পঁচাত্তর সাল।
মুয়াজ্জিনের কন্ঠে তখন “হাইয়া আলাস ছলা”
সাথে সাথেই আবারো বিস্ফোরিত বারুদের গোলা।
এবার দুটি কন্ঠ ভেসে এলো,
“আমরা শেখ নাসের এবং শেখ জামাল বলছি”
আমি বললাম, জ্বি বলুন,
“বিচার করো”
“বিচার করো”
আমি কি যেনো একটা হারিয়ে ফেললাম।
আমি হতভম্ব, নির্বাক
আমি হতবুদ্ধি, হতবাক
আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম
বিছানায় পড়ে গেলাম।
একটু তন্দ্রা আসতেই দুটো নারী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আমরা সুলতানা কামাল এবং রোজী জামাল বলছি,
ওরা এই মাত্র আমাদের গুলি করলো”
আজ কত তারিখ?
এটা কী মাস?
কত সাল এটা?
বিছানা থেকে উঠে লাইট জ্বেলে
দেয়ালে ঝোলানো কাগজের ক্যালেন্ডার দেখলাম
১৫ই আগস্ট উনিশ্য পঁচাত্তর সাল।
মুয়াজ্জিনের আযানের শেষ কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে
গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত কে যেনো সিঁড়ি থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে !
আমি কি যেনো একটা হারিয়ে ফেললাম।
আবার বেশ কয়েকটি কণ্ঠ পর পর ভেসে এলো,
“আমি ধানমন্ডি তেরোর এক থেকে শেখ ফজলুল হক বলছি,
এইমাত্র আমার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সহ আমাকে মেরে ফেলেছে”
“মিন্টু রোড থেকে আমি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বলছি
এই মাত্র আমাকে এবং আমার স্ত্রী সহ তেরো জনকে ব্রাশ ফায়ার করেছে”
আমি আর বিছানায় থাকতে পারলাম না
একটু আগেই আযানের সুমধুর ধ্বনি
মিশে হয়ে গেছে অস্ত্রের ঝনঝনানি
উঠে দাঁড়াতেই শৈশব পেরিয়ে আসা এক কিশোরের কণ্ঠ,
“প্রতিশোধ নিন”
“প্রতিশোধ নিন”
আমি নিশ্চিত এটা শেখ রাসেলের কণ্ঠ।
আমি উঠে ওজু করে
ফজরের নামাজ পড়তেই
বুকের ভেতর এক ভয়ঙ্কর আগুনের
লেলিহান শিখা জ্বলে উঠলো
শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেলো
প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেছে আমার শরীরে
একাত্তরের সকল মুক্তিযোদ্ধার সাহস এখন আমার ভেতরে
অদম্য দুর্বার প্রলয়ংকরী এক মহাশক্তির স্পন্দন শরীরের ভেতরে।
না – আমি আর কাঁদবো না
চুয়াল্লিশ বছর বাঙালিরা অনেক কেঁদেছে
চোখের সমস্ত পানি আজ শুঁকিয়ে গেছে
বাঙালিরা এখন আর কাঁদবে না
বাঙালিরা আজ শোককে শক্তিতে পরিনত করেছে
এবার প্রতিশোধ প্রতিরোধ বিচারের পালা
শোক কাটিয়ে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা
এবার জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের পালা
বাঙালিদের এবার সোনার বাংলা গড়ার পালা।
হঠাৎ একটি প্রবল ভারী কন্ঠ – যেখানে বজ্র কণ্ঠের রেশ রয়ে গেছে,
আমি উঠে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, বসো।
আমি বললাম, প্রিয় জাতির পিতা – আপনি কেমন আছেন?
তিনি বললেন, “আমি জানি ২১ বছরে ৪২ বছর পিছিয়ে গেছে আমার সোনার বাংলা কিন্তু আর দেরি করো না- তোমরা আমাকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে- এবার দ্রুত প্রতিশ্রুতি পুরণ করো”
আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম
একটু তন্দ্রা আসতেই আবার সেই কিশোরের কন্ঠঃ “প্রতিশোধ নিন – প্রতিশোধ নিন”
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“প্রতিশোধ নেবো-আমি প্রতিশোধ নেবো-তোমরা আমেরিকা কানাডা লিবিয়া যেখানেই পালিয়ে থাকো আমি আসছি প্রতিশোধ নিতে – আসছি……।”
আমার ছোট মেয়ে কণ্ঠ ভেসে এলো, “বাবা কি হয়েছে?”
আমি চোখ মেলে দেখি আমার ছোট মেয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জানতে চাইলাম, আজ কত তারিখ?
আমার মেয়ে বললো, আজ ১৫ই আগস্ট
এবার জানতে চাইলাম, এটা কতো সাল?
উত্তর দিলো দুই হাজার উনিশ সাল।
loading...
loading...
একাত্তরের সকল মুক্তিযোদ্ধার সাহস এখন আমার ভেতরে
অদম্য দুর্বার প্রলয়ংকরী এক মহাশক্তির স্পন্দন শরীরের ভেতরে।
loading...
অসাধারণ মনোমুগ্ধকর উপস্থাপন।
loading...