ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন বর্তমান প্রেক্ষাপট ও আমাদের দায়

“আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে — কিছুই কি নেই বাকি?’
একটুকু রইলেম চুপ করে; তারপর বললেম, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’
উপরোক্ত কবিতাটি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত “হঠাৎ দেখা” কবিতার কিয়দংশ। এখানে বলে রাখা ভালো এই কবিতার বিষয়বস্তু হঠাৎ দেখা সাবেক প্রেমিকার সাথে প্রেমিকের কিছুটা নস্টালজিক, কিছুটা মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা পুরনো প্রেমের হঠাৎ আলোড়ন।

এবার আসি মূল বিষয়ে, বর্তমান বাজারে ব্যাপক আলোচিত বিষয়, বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা আন্দোলন। আবরার এক টগবগে তরুণ। অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে বুয়েটের মত প্রতিষ্ঠানে এসেছিল পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ার হবে বলে। কিন্তু হঠাৎ অমানিশার মত এক কাল বৈশাখী ঝড়ে যেন সব এলোমেলো। কিন্তু এই ঝড় কেন এলো? যারা আবরারকে নৃশংসভাবে মারল তারাও তো মেধাবী? তারাও সেই একই স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল বুয়েটে। ইঞ্জিনিয়ার হবে। দেশের প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে হয়তো নব উদ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। তাহলে কেন ওরা খুনি হল? এর দায় কি শুধুই খুনিদের? আপাত দৃষ্টিতে বলা যায় খুনিদের কিন্তু, সামগ্রিক অর্থে এ দায় খুনিদের একার নয়। এ দায় আমাদের এই নষ্ট সমাজকেও নিতে হবে। নিতে হবে রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করে আসছে তাদেরও। এমন না যে বুয়েটে এই প্রথম কোন ছাত্রকে মারা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও বহু ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে।

“স্বাধীনতার পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫১ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২ জন করে, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হজরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন করে শিক্ষার্থী খুন হন।”
১৯৭৪-২০১৯ লাশ ও খুনি তৈরি করা ছাত্ররাজনীতি
“সোহরাব হাসান” প্রথম আলো।”

“১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল সূর্য সেন হলের ৬৩৫ নম্বর কক্ষ থেকে ছাত্রলীগের নেতা কোহিনুরসহ চারজনকে ‘হ্যান্ডস আপ’ করিয়ে নিয়ে আসেন মুহসীন হলের টিভিরুমের সামনে। অস্ত্রধারীদের আরেকটি দল ৬৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে আরও তিনজনকে একই কায়দায় সেখানে নিয়ে আসেন। রাত ২টা ১১ মিনিটে ওই সাতজন ছাত্রকে লক্ষ্য করে ‘ব্রাশফায়ার’ করেন তাঁরা। এরপর অস্ত্রধারীরা ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।”
১৯৭৪-২০১৯ লাশ ও খুনি তৈরি করা ছাত্ররাজনীতি
“সোহরাব হাসান” প্রথম আলো।”

“মুহসীন হলে যাঁরা খুন হলেন এবং যাঁরা খুন করলেন, তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের। নিহত শিক্ষার্থীরা আওয়ামী যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির সমর্থক ছিলেন। প্রতিপক্ষ গ্রুপের উসকানিতে শফিউল আলম প্রধান এ কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। পরদিন হত্যার বিচারের দাবিতে যে মিছিল হয়, তাতেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিন দিন পর প্রধান গ্রেপ্তার হন। হত্যাকারীদের মধ্যে যাঁরা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, তাঁদের বর্ণনায় উঠে আসে খুনের ভয়ংকর বিবরণ। আওয়ামী লীগ শাসনামলেই মুহসীন হলের সাত হত্যার বিচার হয়। বিচারে প্রধানের যাবজ্জীবন শাস্তি হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাঁকে ১৯৭৮ সালে মুক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে মাঠে নামান। এরপর ক্যাম্পাসে শুরু হয় ছাত্রদলের তাণ্ডব। মেধাবী ছাত্রদের জিয়া হিজবুল বাহারে নিয়ে গিয়ে কী তালিম দিয়েছিলেন জানি না। কিন্তু গোলাম ফারুক অভিসহ অনেক মেধাবী ছাত্রই সন্ত্রাসীতে পরিণত হন।”
১৯৭৪-২০১৯ লাশ ও খুনি তৈরি করা ছাত্ররাজনীতি
“সোহরাব হাসান” প্রথম আলো।”

একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪ সালে মুহসিন হলে যে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার তার বিচার করেছিল এবং তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সফিউল আলম প্রধানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রধান করেছিল, কিন্তু ৭৫ পটপরিবর্তন প্রধানকে জেল থেকে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে মুক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে মাঠে নামান। সেই থেকে শুরু ছাত্ররাজনীতির কাল মেঘের ঘনঘটা। কিন্তু ইতিহাস তো বলে ছাত্রদের পক্ষে। বাংলাদেশের ইতিহাস তো প্রকারন্তরে ছাত্রদেরই গৌরবের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু ৫৪ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯ আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন, ৭০ নির্বাচন ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ মধ্য দিয়ে রক্তক্ষয়ী তুমুল গণযুদ্ধের আজকের বাংলাদেশ। ৯০ স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দ্বিতীয় জীবন লাভ করেছিল। ২০১৩ শাহবাগের উত্তাল গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন এ সবই সম্ভব হয়েছিল ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এই যে সোনালি ইতিহাস, এ ইতিহাস আপনি অস্বীকার করবেন কি করে? ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় না।

আর যদি কেউ করেও থাকে তাকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। আজকে আবরার ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের একটি হুজুগে দাবী উঠেছে। হুজুগে বললাম এই কারণেই, মাথা ব্যথা হলে মাথা কাটতে হবে কেন? সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধান করাই মুখ্য কাজ। আর এটা করতে হবে জাতীয় নেতৃত্বকেই। কেননা এর দায় তারা এড়াতে পারে না। আজ যারা জাতীয় নেতা তাঁরাই একদিন ছাত্রনেতা ছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি এডভোকেট জিল্লুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজুলুল হক মণি, কমরেড ফরহাদ, আ,স,ম আবুর রব, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আব্দুল কুদ্দুস মাখান, শাহজান সিরাজ, নুরে আলম সিদ্দিকী, কাজী আরেফ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ছাত্ররাজনীতি করেই আজ তাঁরা জাতীয় রাজনীতির পাদপ্রদীপে এসেছেন।
একেকজন যেন একটি জ্বলন্ত ইতিহাস।

কিন্তু একটি কথা মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলো ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে কেন? এটা কি সামগ্রিক দেশের মানুষের কথা? নাকি যারা রাজনীতির নামে ধর্মকে পুঁজি করি একটি উগ্র মৌলবাদী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে তাদের কথা? প্রগতিশীল মহল থেকে শুরু করে সুস্থ ধারার রাজনীতি যারা করেন তাঁরা অন্তত এটাই মনে করে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে ঐ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীরই লাভ হবে প্রকারন্তরে। তাহলে ক্যাম্পাসে তারা অবাধে বিচরণ করে মৌলবাদী রাজনীতির বীজ বপন করতে পারবে নিরাপদে। সাধারণ মেধাবী ছাত্রদের মগজধোলাই করে দেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার সেই হীন চেষ্টায় স্বাধীনতার পর থেকে বারবার করে আসছে। তাই আজ দাবী তুলেছে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কোন সমাধান নিয়ে আসবে না। আগেই বলেছি সমস্যার ভিতরে গিয়ে সমাধান করতে হবে।

আগে তো অনেক ছাত্রকে প্রাণ দিতে হয়েছে তাহলে, আবরার হত্যাকে কেন্দ্র করে কেন এই “বিরাজনীতিকরণ”-এর আন্দোলন? কোথায় এমন কোন আন্দোলন তো আগে চোখে পড়েনি, তাহলে শুধু আবরার ইস্যুকে কেন্দ্র করে কেন এই আন্দোলন? ভেবে দেখার সময় এসেছে, কারা ও কেন এই দাবী তুলছে এবং কেন ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে চায়।

শুরু করেছিলাম কবি গুরুর কবিতার কিয়দংশ দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের ঐ “হঠাৎ দেখা” কবিতার মতোই বলতে ইচ্ছে করছে, যেদিন গেছে একেবারেই কি গেছে আমাদের? কিছুই কি নেই বাকী? না যায়নি, এখনো অনেক বাকী। আমি নিজে একজন ছাত্র রাজনীতির কর্মী হিসেবে বলছি, ছাত্র রাজনীতির অনেক ইতিবাচক দিক আছে। এবং সেই ইতিবাচক দিকটিই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। যা কিছু অন্যায় তাকে বর্জন করতে হবে। তাহলেই আমরা অতীতের মতোই ছাত্র রাজনীতির সুফল ঘরে তুলতে পারবো। ছাত্র রাজনীতির কল্যাণেই আজকে বঙ্গবন্ধু ও আজকের বাংলাদেশ।

ছাত্র রাজনীতির কল্যাণেই বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের অন্যতম মর্যাদা সম্পন্ন ভাষা। বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্র রাজনীতিরই ইতিহাস। এ ইতিহাসকে আপনি কীভাবে অস্বীকার করবেন?

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০২-১২-২০২০ | ১৯:১৯ |

    ছাত্র রাজনীতির কল্যাণেই বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের অন্যতম মর্যাদা সম্পন্ন ভাষা। বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্র রাজনীতিরই ইতিহাস। এ ইতিহাস কোনভাবে অস্বীকারের সুযোগ নেই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • এইচ আই হামজা : ০২-১২-২০২০ | ২০:০৭ |

      অসংখ্য ধন্যবাদ দাদাভাই। আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা নিবেন। 

      GD Star Rating
      loading...
    • মুরুব্বী : ০২-১২-২০২০ | ২০:২২ |

      নিশ্চয়ই মি. এইচ আই হামজা। Smile আমারও ভালোবাসা জানবেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. ফয়জুল মহী : ০২-১২-২০২০ | ২১:১৬ |

    সোহরাব হাসান নিরপেক্ষ সাংবাদিক নয়। ছাত্র রাজনীতিই আমাদেরকে  সবুজ পাসপোর্ট দিয়েছেে

    GD Star Rating
    loading...
    • এইচ আই হামজা : ০৩-১২-২০২০ | ১১:৩২ |

      আমরা কেউই নিরপেক্ষ নই।তবে নিরপেক্ষতার ভাণ ধরি। সে যায় হোক উক্ত লেখকের প্রবন্ধ পড়েই আমার এই প্রবন্ধের উদ্ভব।আপনাকে ধন্যবাদ ভালো থাকুন,সুস্থ থাকুন,নিরাপদে থাকুন। 

      GD Star Rating
      loading...
  3. আলমগীর সরকার লিটন : ০৩-১২-২০২০ | ১০:৩৬ |

    চমৎকার লেখেছেন অনেক শুভ কামনা

    GD Star Rating
    loading...