ছোট গল্প: গল্পটা ভালবাসার নাও হতে পারত

ছোট গল্প : গল্পটা ভালবাসার নাও হতে পারত

এবার শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। একেতো শীতের দিন, তার উপর ওয়েদার খারাপ। এমন মেঘলা দিনে ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে সারাটা বিকেল। সারা দেশে তীব্র শৈত্য প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। হয়ত যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। মাইসা মেঘলা বিকেলে এক চিলতে রৌদ্দুরের আশায় খোলা চুলে ছাদে এসে দাঁড়াল। মাইসার গায়ে একটা কাশ্মীরি শাল জড়ানো।

ঘরের ভিতর অন্ধকার। তার উপর শীতের দিনে ও নিয়ম করে বেশ কয়েক বার লোড শেডিং চলছে। সে জন্য মাইসা ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্ত বাইরেও অন্ধকার। মেঘলা আকাশ সব কিছুই অন্ধকার করে রেখেছে। এমন বিষণ্ন মুহুর্তে মনটা একেবারেই অন্য রকম খারাপ হয়ে আছে মাইসার। ভাল লাগে না ওর কোন কিছুই।

আর একদিন পর ফেব্রুয়ারি শুরু।
মাইসা জানে, ফেব্রুয়ারি মানেই প্রাণের মেলা – বই মেলার আনন্দ উচ্ছ্বাস। বই মেলার জন্য সে বিগত এগারোটা মাস অপেক্ষা করে আছে। মেলা শুরু হলে, মাইসা প্রায় প্রতি বিকেলেই বই মেলায় আসে, এবং প্রিয় লেখকদের অনেক বই সে সংগ্রহ করে। ওর নিজের ঘরে একটা বড় পাঠাগার গড়ে তুলেছে। মাইসারা দুই ভাই- বোন। ও বড়। মাইসা ইকোনমিক্স এ মাষ্টার্স করেছে। ছোট ভাই মিলন ক্লাস নাইনে পড়ছে। মাইসার বাবা- মা দু’ জনই চাকুরি জীবী। বাবা ব্যাংকার মা স্কুল টিচার। মাইসারা দক্ষিণ কাফরুলে থাকে।

—— আজ ডে অফ থাকায় বাবা- মা দু’ জনই বাসায় আছেন। হঠাৎ টুপ,টাপ বৃষ্টি পড়ার শব্দ হয়। মাইসার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল, শীতের বিকেলে বৃষ্টি পড়া দেখে। ওর খুব ইচ্ছে করে শীতল বৃষ্টিতে ভিজতে, জবু থবু হতে। বৃষ্টি বেশ জোরে পড়ছে। সাথে হালকা দমকা হাওয়া বইছে। ওর একটু শীত শীত লাগছে।
মাইসা আম্মুর কথা ভাবতেই ওর মনটা দমে গেল। আম্মু টের পেলে নির্ঘাত বকা দেবেন। ওর একটু ঠান্ডার প্রবলেম আছে।
—— মাইসা হাত বাড়িয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির স্পর্শ নিল, এবং চোখে মুখে ছিটাল। আহ! কী স্নিগ্ধ শীতল অনুভূতি ঢেউ খেলে গেল ওর দেহ মন জুড়ে। ওর মন একটু ভাল হল। আস্তে আস্তে চারদিকে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। মাইসা ছাদের চিলে কোঠায় বসে আছে। রাতে এখানে ওর ছোট ভাই মিলন থাকে। বেশ ছিমছাম একটা রুম। বাইরে তখন জোরে বৃষ্টি হচ্ছে।

রোডের দু’ পাশে ল্যাম্প পোষ্টগুলো একত্রে জ্বলে উঠল। মাইসা হাফ ছেড়ে বাঁচল। উফ্ বিদ্যুৎ চলে এসেছে। মাইসা রুমের জিরো পাওয়ারের নীল বাতি জ্বালাল। বাইরের বৃষ্টি যেন নীল স্বপ্নের মত লাগছিল। ওদের ছাদের টবে অনেক ধরনের ফুল, ফলের গাছ আছে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় গাছ গুলো আরও সবুজ লাগছে। শীতের রাতে ছাদের ঘন সবুজ গাছগুলো একটা ছোট্ট বাগানের মতই লাগল। মাইসার কাছে মনে হল, শীতের এ বৃষ্টি স্নাত মায়াবী রাত ঘন আকাশী নীল চাদর জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে।

—— অনেক দিন পর বৃষ্টি হচ্ছে। চারদিকে ভিজে, ধূলো, মাটির শোধা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এ গন্ধ বড় পরিচিত লাগছে মাইসার কাছে। ওর তখন শিপনের কথা মনে পড়ল। এ গন্ধ শিপনের খুব প্রিয় ছিল। শিপন বৃষ্টি ভালবাসত ভীষণ! মাইসা কেমন নষ্টালজিয়া হয়ে ওঠে। কেমন আছে ও!
——–হঠাৎ সিঁড়ি ঘরে আম্মুর কন্ঠ শুনে চমকে উঠল। এই মাইসা তুই এখানে? আমি তোকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি। একা এখানে কী করছিস? দেখছিস না বৃষ্টি হচ্ছে? ঘরে চল মামণি — । শংকিত হল মাইসা মনে মনে।ওহ আম্মু ! তুমি দেখছ না আমি বৃষ্টি বিলাস করছি ? আম্মু তুমি আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে তো?
—– বড় বিরক্ত হলেন মাইসার আম্মু, ধুস্ স —– তুই বৃষ্টি বিলাস কর, আমি গেলাম।
দেখিস আবার বৃষ্টিতে ভিজিস না যেন। ঠান্ডা লেগে যাবে। দিল আসমা চলে গেলেন নিচেয়।
মাইসা খুশিতে নরম গলায় বলল, ওহ্ আম্মু, তুমি ভীষণ ভাল। মাইসা একবার জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকাল। ভারী মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। ওর মনে হল ——-

আজ রাতে বৃষ্টি থামবে না, সারা রাত ঝরবে। ছাদের সবুজ গাছেরা সব চেয়ে আছে বৃষ্টির দিকে, পাহাড়েরা, নদীরা, সমুদ্ররা সব চেয়ে আছে বৃষ্টির দিকে খোলা চোখে।

আর মাইসা বৃষ্টির ছন্দে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে নতুন করে।
ও চিলে কোঠা থেকে নিজের রুমে চলে আসল। রাত বাড়ছে।ধীরে ধীরে, ওর মন ভারী পাথরের মত হয়ে যায়। বড় কষ্টে রাতটা কাটল। পরদিন সকালে ঝকঝকে রৌদ্দুর বেরিয়েছে, মাইসার মনটাও হেসে উঠল রৌদ্দুরের মত নিমিষেই। অনেক অপেক্ষার শেষে ও বিকেলে বই মেলায় আসল। প্রথম দিনেই মেলা ঘুরে ঘুরে অনেক বই কিনল মাইসা।
উপন্যাস,ছোট গল্প, কবিতার বই আছে বেশ কয়েকটা।
—— রাত্রে ঘুমোতে এসে একটা কবিতার বই হাতে নিল মাইসা। প্রথম পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ও কিছুটা অবাক হল।
ভেতরে ( ৩য়) খালি পৃষ্ঠায় শুধু একটা আর্ট করা হাতে আঁকা ছবি,

রোমিও শিপন…
কেবল এটুকুই।
মোবাঃ 017000000…

ছবি দেখে মাইসা মুগ্ধ হয়ে গেল। ও তখন কাব্যগ্রন্থের নাম দেখার জন্য উদগ্রীব হল। ও আরও আশ্চর্য হল – কাব্যগ্রন্থের নাম
দেখে———–!
মাইসা এবার লেখকের নাম দেখার চেষ্টা করল, কী আশ্চর্য! যেন কত পরিচিত একটা নাম — শাহরিয়ার রোমিও শিপন…।
—- মাইসা প্রথম কবিতাটা পড়তে শুরু করল–

আমার ভালবাসা

তোমাকে বলছি মাইসা
তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না —
এর চেয়ে বড় সত্য আর হয় না,
তুমি মেঘ বালিকা,
আমার জীবনে,
সেকি জান না?
তুমি শ্রাবণ ভেজা বৃষ্টি রাত,
তুমি মায়াবী পূর্ণিমা চাঁদ
তুমি স্নিগ্ধ সকাল বেলা
তুমি উদাসী মধ্য দুপুর,
তুমি ঘাস ফড়িং-এর রোদেলা বিকেল
তুমি শীত, গ্রীষ্ম
বর্ষায় ফোঁটা এক একটি স্বপ্নের নীল গোলাপ !
তুমি এক জীবনে আমার সব —
চাওয়া থেকে পাওয়া!

— কবিতাটা পড়তে পড়তে মাইসা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। ফাল্গুনের মত রাতের আকাশে উজ্জ্বল তারা দেখে খুশিতে ওর মন ভরে উঠল।
—- ও আবার আর্ট করা ছবি দেখল। আর মনে মনে ভাবল, এ ছবিটার মতই দেখতে কবি। ছবিটাকে ঘিরে ওর মনে এক ধরনের ভাললাগা বোধ ছুঁয়ে গেল। মুহুর্তে নিরস হল ও। ভাবল, আমার জীবনে শুধু একজনের জন্য প্রেম, ভালবাসার অনুভূতি আছে। আর কারও জন্য এতটুকু স্বপ্ন নেই। তাহলে? অচেনা কোন এক কবিকে কেন আমার ভাল লাগল? আর কেন ওই কবিকে বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে? এই কবি কি আমার পরিচিত কেউ?
না, না সেটা কিভাবে সম্ভব?
— শিপন আমার জীবন থেকে সাত বছর আগে মাইনাস হয়ে গেছে।
তবু ছবিটাকে স্পর্শ করে মাইসার একবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে এ শিপন।

—-ওর খুব ইচ্ছে করে এমন ভারী রাতে পাখির মত ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াতে। ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে গান গাইতে, ইচ্ছে করে নূপুর পায়ে নাচতে। ও ঢের বুঝতে পারে এই কবিকে সে ভালবাসতে শুরু করেছে। এক ভাললাগা অনুভূতি ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। অনাবিল খুশিতে ভরে উঠে ওর মন। ও বিড়বিড় করে বলে,

এই কবি, একি বাঁধনে বাঁধলে আমাকে। কোন শাসন বারণ মানতে চাইছে না মন। আমার এই চোখকে যদি বলি, এই ছবি দেখিস না, চোখ সে কথা কিছুতেই শুনছে না। যদি মনকে বলি, মন তুই ওই কবির কথা ভাবিস না, মন কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। আমি কি করব বলো কবি ?
আপন মনেই হাসল মাইসা।
এই কবি, আমি তোমার ভালবাসা
তুমি চেন আমাকে? আমি তোমার সামনে দাঁড়াব। তুমি আমার নামের ভালবাসার জোয়ার বইয়ে দিয়েছ প্রতিটা কবিতার শব্দে শব্দে ! মনের অজান্তেই মাইসা আর্ট করা কবির ছবিতে হাত স্পর্শ করতে থাকে অবিরত। এক বার নয়, দু’ বার নয়, অনেক বার।
অবশেষে সেই কাংখিত দিনটি আসল মাইসার জীবনে ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালবাসা দিবসে কবির কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। মাইসা আকাশ নীল শাড়ি পরেছে। সুন্দর করে সেজেছে। ওর হাতে এক গুচ্ছ নীল গোলাপ। মাইসা বই মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তিতে নাম দিল। ও দূর থেকে দেখল, ওর স্বপ্নের কবি স্টেজে বসে আছে। ও হাসল। আর মনে মনে উচ্চারণ করল, অপূর্ব ! কিছুক্ষণ পর মাইসা স্টেজে উঠে আসল কবিতা আবৃত্তি করার জন্য।
“আমার ভালবাসা” কাব্য গ্রন্থের এক গুচ্ছ কবিতা আবৃত্তি করতে যাচ্ছে মাইসা।

একগুচ্ছ কবিতা
কবি শাহরিয়ার রোমিও শিপন
এক.
বহুদিন পর আবেগের আতিশয্যায়
মনের ঘরে কেউ দিয়েছে ডাক
শুন্য হৃদয় পড়ে আছে চোরাবালী চোরাকাঁটায়
ব্যথাটুকু মুছে যাক-
বালি থেকে সরে যাক ঢেউ
কোথাও আর নেই কেউ
তবু নামটুকু শুধু লেখা থাক!

দুই.
এতদিন আকাশ বুকে নিঃসঙ্গ এক
চাঁদ ছিল-
আমার মত ,
পৃথিবীর নীল ঠোঁটে অশান্ত
রাত ছিল-
দেখার মত,
নৈঃশব্দ‍্যতার চিবুক জুড়ে ভালোবাসায়
বাঁধ ছিল,
তারাভরা রাত্রি তবু ছিল বিষণ্ন;
আজ তোমার দেখা পেলাম
ভালবাসার নীল সমুদ্রের বাঁধ
ছুঁটে গেল-
যদি কখন ও তোমায় হারায়,
প্রিয়তম, আমি মরে যাব!

তিন.
“পৃথিবীর সব কোলাহল থেমে গেলে
মনে হয় –
তুমি আসবে কাছে:
একদিন খুব ভালবাসবে…
স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে দেখি
হায় ! তুমি নেই পাশে।”

চার.
কদম সন্ধ্যাটা হারিয়ে ফেলেছি
বহুদিন হয়ে গেল ,
শ্রাবণ বৃষ্টির ফোঁটা হারায়নি :
শব্দগুলো রেখেছি তুলে
বড় যত্ন করে আজও
আমার চোখ নীল সমুদ্র করে রেখেছি,
এ চোখে শ্রাবণ বৃষ্টি জমে জমে
সমুদ্র হয়ে গেছে –
এখন শ্রাবণ বৃষ্টিরা
আমার চোখের আইকোণে ..
টুপ টাপ
বৃষ্টি হয়ে ঝরে ।

কবিতা আবৃত্তি শেষে মুর্হুমুর্হু করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল স্টেজ।
এবার কবিতা আবৃত্তির জন্য স্বয়ং কবির নাম ঘোষণা করা হল। কবি উঠে এল স্টেজে। যথারীতি কবি বলল, আমার এ কাব্য গ্রন্থ “আমার ভালবাসা’র” শেষ কবিতা এটা।

এক চিলতে স্বপ্ন আমার মাইসা —

জান মাইসা,
ভেবেছিলাম নতুন করে
আর কোন কবিতা লিখব না,
কিন্তু মাইসা,
তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর
তোমার স্নিগ্ধ হাসি আমাকে
বড্ড এলোমেলো করে দিয়েছে
আর তোমার সেই রুপক হাসি
আমাকে বাধ্য করেছে
স্বপ্নের আঙিনায় তোমাকে নিয়ে
আবার নতুন করে ভাবতে :
তোমার প্রজাপতি সুখ সুখ মন
আমাকে খুব কাছে টেনেছে —
তোমার দীঘল কালো কেশগুচ্ছ
জীবনানন্দের নাটরের বনলতা সেনকেও হার মেনেছে ;
তোমার হরিণী টানা টানা দু’টি চোখ
বনলতার দু’ চোখ পাখির নীড়কেও হার মেনেছে,
আর আমাকে টেনে নিয়ে গেছে ——
ক্রমেই অনাবিল এক স্বপ্নের রাজ্যে :
আমার সত্ত্বায় ঘুমিয়ে থাকা
দূরন্ত ইচ্ছে গুলো
তোমার ভালবাসার স্পর্শে জাগিয়ে দিলে,
আমার ভালবাসার স্বপ্নিল বাগানে
থোকায় থোকায় মাধবীলতা হয়ে ফুটেছ,
আমার হৃদয়ে সুরভিত উত্তাপ বিলিয়ে দিয়েছ,
তুমি সাদা- গোলাপী থোকায় ফোঁট,
গহন রাত্রি নয়,
আমার বুকের জমিনে,
সুগভীর ভালবাসার প্রচ্ছন্নতায়,
তোমার জন্য নতুন করে আমি
স্বপ্ন দেখছি মাইসা —
আবার আমি কবিতা লিখছি!

—– মুর্হুমুর্হু করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল স্টেজ। মাইসা কবির কণ্ঠের আবৃত্তি শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। কবি সেক্ষণে মেয়েটিকে অপলক চোখে দেখছে। মাইসা একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে কবির সামনে এসে দাঁড়াল।
এক্সকিউজ মি, আপনিই রোমিও শিপন?
আমি মাইসা। এই কাব্য গ্রন্থের প্রচ্ছদে একটা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। আমি কি জানতে পারি মেয়েটি কে? মেলার প্রথম দিনেই এই কবিতার বইটি আমি হাতে পেয়েছি। সেই থেকে কবিকে এক পলক দেখার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। আজ সত্যি ধন্য আমার দু’ নয়ন, আপনার দেখা পেয়ে। মাইসা নীল গোলাপ গুচ্ছ বাড়িয়ে ধরে। এগুলো আপনার জন্য আমার পক্ষ থেকে সামান্য শুভেচ্ছা! গ্রহণ করলে ধন্য হব।
কবি হেসে উঠল —– দারুণ উচ্ছ্বাসে, ওহ্ শিওর!
—- কবি অমলিন হাসল, হাসলে দারুণ লাগে সেটা দৃষ্টি গোচর হল মাইসার।
কবি বলল, মাইসা মনে হয় আর ও বেশি প্রত্যাশা করেছিলে? আমি দেখতে খুব সুন্দর হব, আরও স্মার্ট হব।
এই ইত্যাদি…
হাসল মাইসা, আরে আপনি তো দারুণ হ‍্যান্ডসাম! সত্যি? মিথ্যা কেন বলব, তিন সত্যি ! বলল মাইসা। কবি হাসল, কবি তাঁর ব্যাগ থেকে একটা আর্ট করা ছবির ক্যানভাস বের করে মাইসাকে দেখাল। বলল, এই মাইসা দেখতো চিনতে পার নাকি? মাইসা ছবির ক্যানভাসে নিজেকে দেখে ভীষণ চমকে উঠল। ও বলল, সর্বনাশ এ তুমি কি করেছ? এত আমারই ছবি। সেই কলেজ লাইফের বান্ধবীকে কে কবে মনে রেখেছে বলোতো? কবি দারুণ অভিমানী কণ্ঠে বলল, এই মাইসা আমাকে তুমি চিনতে পেরেছ তাহলে ? আরে আমি তোমার সেই শাহরিয়ার রোমিও শিপন!

শাহরিয়ার রোমিও নাম তুমি আমাকে দিয়েছিলে। এখন আমি এ নামেই পরিচিত বেশি। মাইসা অবাক হয়ে যায়। কি বলছ তুমি? পাগল নাকি? হু পাগলামী সে তো
শুধু তোমাকেই মানায়। তোমাকে আমি একেবারেই যে চিনিনি তা নয়,ঠিকই চিনেছি। তুমি অনেকটা বদলে গেছ। আগের শিপনের সঙ্গে এখন আর মিল নেই। আমাকে ভালবাস অথচ সেদিন পালিয়ে ছিলে কেন অমন করে ?
কবি হালকা গলায় বলল,
শুকনো ভালবাসায় তো আর চিড়ে ভেজে না। আমি তখন চাল চুলো হীন এক বেকার যুবক। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে তোমার খোঁজে গিয়েছিলাম।তোমরা তখন বদলি হয়ে চলে গেছ অন‍্য শহরে। পরে আর তোমাকে খুঁজে পাইনি। তোমাকে হারিয়ে আমার ছন্নছাড়া জীবন শুরু হল। তারপর এই আমি কেমন আছি বুঝতেই পারছ। কখন ও ভাবিনি আবার তোমার দেখা পাব।
——– মাইসা হেঁয়ালি করে, মন থেকে চাইলে সবই পাওয়া সম্ভব।
এখন তো পেলে, হয়ত মন থেকে চেয়েছ।
মাইসা বলল, এখন তুমি একটার পর একটা নবেল লিখছ। চারদিকে তোমার কত নাম ডাক। খুব ফেমাস হয়েছ তুমি। একটা অটোগ্রাফ দাও …!
—– মাইসা ওর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল।
অদূরেই একটা সাদা প্রাইভেট কার এসে থামল। লাল জর্জেট শাড়ি পরা একটা মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে সোজা উঠে এল স্টেজে। শিপনের পাশে এসে দাঁড়াল। শিপন বলল,মাইসা ও রানু। আমার ওয়াইফ। হাত টেনে নিয়ে মাইসা বাঁক ফিরে থমকে গেল। ওর ঠোঁটে ছিল এক চিলতে হাসি। মুহুর্তে মিলিয়ে গেল। মাইসার দু’ চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল! ওর চোখে জল তখন ও চিকচিক করছে। রানু মাইসার হাত ধরে ছবির ক্যানভাসে এসে দাঁড়াল।

ছবি দেখিয়ে বলল, এটা তোমার ছবি। আমার স্বামীর ছবির ক্যানভাস বলো, আর মনের ক্যানভাস বলো, তাঁর সবটা জুড়ে আছ শুধুই তুমি একজন। আমি ওর কোথাও নেই। আছি সংসারে।তুমি কষ্ট পাচ্ছ কেন? এক জীবনে সবার সব আশা পুর্ণ হয় না। তুমি ওর হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা! এই কাব্য গ্রন্থের নায়িকা সে তুমি। ভাগ্য বলতে হয় তোমার। আমি শুধুই ওর স্ত্রী।
আমি ওর লেখা কবিতা হতে পারিনি।
তুমি ওর ভালবাসা। এ কাব্য গ্রন্থের নামকরণ তোমাদের ভালবাসাকে আরও স্বার্থক করে তুলেছে। “আমার ভালবাসা”।

—– শিপন বলল, মানুষের বিবেক হল সবচেয়ে বড় আদালত। আমি সেই বিবেকের কাছে ছোট হয়ে আছি। একটা অপরাধ বোধ আমাকে তাড়া করে ফিরছিল।
শিপন মাইসার দু’ হাত ধরল।আমাকে ক্ষমা কর তুমি। ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,দুঃখ করো না, সব ভালবাসা পূর্ণতা পায় না! হয়ত একেই বলে টেলিপ্যাথি….!
একটু চুপচাপ থেকে শব্দ করে কেঁদে উঠল মাইসা। ওএক ছুটে বই মেলা থেকে চলে গেল। শিপন নিঃশব্দে ওর চলে যাওয়া শূন্য পথের দিকে তাকিয়ে বলল,
——
অভিমানী
স্বপ্ন ভঙ্গের মত কষ্ট এ পৃথিবীতে
আর কিছু নেই,
তোমাকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব প্রায় :
এ পৃথিবীতে আমি বড় একা,
তারপর ও ভাল আছি রানুকে নিয়ে
এখন আমার আর কোন কষ্ট নেই;
আমি এখন মনের কথা লিখতে পারি!
শুধু তোমার জন্য আমি কবি হয়েছি
এটাও কি কম পাওয়া বল ?
ভালবাসার দিনগুলোতে
আমার শাহরিয়ার রোমিও নাম
তুমি দিয়েছিলে…
আজ কোথায় হারালে তুমি,
কোন সে অচেনা শহরে!
কত কাছাকাছি থেকেছি
আমরা দু’জন ;
অথচ ইচ্ছে পূরণের সোনার কাঠি
আমার হাতে ছিল না!
ভাল থেকো..

হঠাৎ বৃষ্টি নামে যে অচেনা শহরে
ভাল থেকো আমার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা!

—— শিপন ব‍্যথাহত কণ্ঠে বলল, রানু .. রানু…
তুমি আমার অভিমানী নিঃশব্দ চাঁদ।
দূরে সরে আছ কেন? কাছে এস। আমাকে ক্ষমা কর। কথাটা কি খুব কষ্ট থেকে বলল শিপন!
—— রানুর কণ্ঠে অনুযোগ নেই। ও মাইসার কথা ভাবে। মেয়েটি কি সত্যিই আজ ও শিপনকে নিয়ে কোন জাল বুনেছে! স্বপ্নের! বড় বেশি আঘাত পেল মেয়েটা। কথাটা ভাবতেই যেন পলকে নিবে গেল রানু।

—– রানু ধীরে ধীরে শীতল অন্ধকারের কাফন ফুঁড়ে এক পা দু’পা করে এগিয়ে এসে বিশ্বস্ত হাত বাড়িয়ে দেই নিঃশব্দ প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা অভিমানী শিপনের দিকে! রানুর অন্তঃপুরে জমে থাকা খন্ড খন্ড মেঘেরা বৃষ্টির জল তরঙ্গের ঢেউ ভাঙ্গছে প্রতিনিয়ত দু’চোখে .. ‌……..

______সমাপ্ত।

01.02.2019

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০১-০২-২০১৯ | ২১:০০ |

    নতুন বছরের মহান একুশের প্রথম প্রহরে ভালোবাসার গল্প উপহার দিয়েছেন। বিষয়টিকে প্রসংশা করলাম। গল্পটি পড়লাম। প্রেমের গল্প হিসেবে খুব আনকমন না হলেও আপনার উপস্থাপনে এর স্বকীয় সৌকর্য বেড়েছে নিঃসন্দেহে। অভিনন্দন প্রিয় গল্পকার। ধন্যবাদ। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • হাসনাহেনা রানু : ০২-০২-২০১৯ | ২০:৫৩ |

      মুরুব্বী: আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনুপ্রাণিত হলাম প্রিয় কবি বন্ধু। প্রীতিময় শুভেচ্ছা সহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি  আপনার সুন্দর উপস্থাপনের জন্য। আপনাকে ও ধন্যবাদ ভাইয়া।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. রিয়া রিয়া : ০১-০২-২০১৯ | ২১:২৩ |

    সময় নিয়ে পড়লাম। লিখায় কবিতার অংশ গুলোন অসাধারণ হয়েছে দিদি ভাই। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • হাসনাহেনা রানু : ০২-০২-২০১৯ | ২০:৫৭ |

      রিয়া রিয়া: অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় কবি বন্ধু রিয়া রিয়া দি' ভাই। শুভেচ্ছা সতত।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০১-০২-২০১৯ | ২১:৩৬ |

    তুমি উদাসী মধ্য দুপুর,
    তুমি ঘাস ফড়িং-এর রোদেলা বিকেল
    তুমি শীত, গ্রীষ্ম
    বর্ষায় ফোঁটা এক একটি স্বপ্নের নীল গোলাপ !
    তুমি এক জীবনে আমার সব —
    চাওয়া থেকে পাওয়া!

    ওহ্ অসাধারণ হাসনাহেনা রানু বোন। অভিনন্দন অভিনন্দন https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • হাসনাহেনা রানু : ০২-০২-২০১৯ | ২১:০০ |

      সুন্দর মন্তব্য প্রকাশ করার জন্য উৎসাহিত হলাম প্রিয় কবি সৌমিত্র চক্রবর্তী দাদা।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...
  4. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ০২-০২-২০১৯ | ৩:৩০ |

    * অনেক সুন্দর একটা লেখা পড়লাম।

    ভালো থাকুন নিরন্তর। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • হাসনাহেনা রানু : ০২-০২-২০১৯ | ২১:০১ |

      মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন: অসংখ্য ধন্যবাদ,কবি বন্ধু।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...