আস্তে আস্তে সব অফিস আদালত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয় সৌদি সরকার। তবে স্কুল কলেজ এবং ধুমপানের দোকান (হুক্কা দোকান) খুলে নাই ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। কারণ এইসবে মানুষ জমায়েত হয় এবং ধুমপান করোনায় মারত্মক প্রভাব ফেলে মানুষের হৃদপিণ্ডে। কিন্তু সিগারেট বিক্রি করা বন্ধ করে নাই এর উপর ভ্যাট বাড়িয়ে দিয়ে দামও দ্বিগুণ করে তারপর ধুমপান একটুও কমেনি। ২০২০ সালে মার্চে প্রথমে করোনা রোগী সনাক্ত হয় তারপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এক পর্যায় প্রতিদিন তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। এইভাবে বাড়তে থাকে/কমতে থাকে চলে বেশ কিছু দিন তারপর কমতে থাকে ২০২০ সালের ডিসেম্বার ৮০/৯০ জনে আসে করোনা রোগী। কিন্তু ২০২১ সালে জানুয়ারিতে আবার বেড়ে হয়ে যায় ৩০০ জনের ভিতর। জানুয়ারিতে ৩০০ এর ভিতরই বাড়তে কমতে থাকে। করোনা ভ্যাকসিন বিশ্বে অনুমোদন পাওয়ার সাথে সাথে সৌদি আরবেও নিয়ে আসে এবং দ্রুত টিকা প্রদান শুরু করে।
প্রথমে টিকা নেন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। এর পরে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। একটা এ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করে টিকা প্রদান চলতে থাকে। টিকা প্রদানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় প্রথম ধাপে টিকা দেয় বয়স্ক ও ভিআইপি লোকদের দ্বিতীয় ধাপে অফিস আদালত ও কর্মজীবি লোকদের তৃতীয় ধাপে দেশী বিদেশী সবাইকে। করোনা শুধু আবুল কালামের নয় সারা বিশ্বের মানুষের জীবন তছনছ করে দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মৃত মানুষ পাশাপাশি জীবিতদেরও জিন্দা লাশ বানিয়ে দেয়। শত শত লোক কর্ম হারিয়ে পড়ে বিপাকে, পরিচিত লোক মরে বেশ কয়েকজন। শরিয়তপুরের এনামের কথা মন পড়বে আজীবন। তাকে দোসারি টাওয়ারে (কমপিউটার মার্কেট ) সবাই মামু ডাকতো হাসিখুশি লোকটা কখনো মন খারাপ করতো না। করোনার প্রথম ধাপে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আর ফিরে আসেনি এনাম। ছোট একটা দোকান ছিলো প্রিন্টার মেরামত করার, এবং কালি রিফেল করতো ক্যাটরিজে ।
সকাল ও বিকাল টাওয়ারের গেইট খোলার সাথে সাথে নিজের দোকান খুলে বসতো গেইট বন্ধ করা পর্যন্ত দোকানে থাকতো। যথেষ্ট সততায় চলাফেরা করতে আমি দেখেছি। মোবাইলের রিচার্জ এবং বিকাশের ব্যবসা করছে বাংলাদেশী লোকের সাথে। মাঝে একবার বউ বাচ্চাও সৌদি নিয়ে আসে ভিজিট ভিসায়। করোনায় এনাম মারা গিয়েছে ভাবতেই যেন মন কালো মেঘে ডেকে যায়। জানি না ছোট বাচ্চাটার জন্য কী সহায় সম্পদ রেখে গিয়েছে। জানি না তার মা ও স্ত্রীর মনের কী অবস্থা, মা কিভাবে সন্তান হারানোর ব্যথা সহ্য করতেছে। প্রিয় স্ত্রী ও সন্তান কোনো দিন দেখবে না এনামের কবর। করোনা কেড়ে নিয়েছে এইভাবে শত শত এনামকে, আমরা অনেকে বেঁচে আছি হতাশা ও ভয়ের ভিতর। মরণ বেদনাময়, কিন্তু ভিনদেশে মরণ তাও আবার করোনা মহামারীতে। এই মরণে কেউ কাছে যায় না, কেউ দেখতেও চায় না।
(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৫২তম পর্ব।
আজ এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে তাই আকাশটা মেঘে ঢাকা। সারা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঢেউ সেটা সৌদিতেও লেগেছে। আগে অক্টোবর মাসে দুই এক বার মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে জানান দিতো শীতের আগমন বার্তা। বাংলাদেশের সাথে মিলে একসাথে শীত আসলেও কিন্তু শীতের প্রকোপ ছিল প্রচণ্ড। ঘরের বাহিরে রাখা পানি কিংবা ট্রাংকির পানি বরফে জমাট হতো। রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধক গাছপালার পাতায় বরফ জমতো এখন সেটা সুদূর অতীত। শীতে ইলেকট্রিক হিটার জ্বালিয়ে দুই তিনটা কম্বলের তলায় ঘুম যেতে হতো। এখন আর বৃষ্টি নেই অক্টোবরে, ডিসেম্বার, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে টিপটিপ বৃষ্টি হয় আবার কখনো কখনো মার্চে দুই একবার অঝোরে কাঁদে উঠে আকাশ। মার্চ ও এপ্রিল মাসে গরম পড়ে যৎসামান্য যেমন অক্টোবর ও নভোম্বরে হয়। মে মাসে গরম আরম্ভ হয় এরপর কয়েক মাস এত গরম যে পড়তো যে মুখের চামড়া পুড়ে যেত এখন সেটাও সুদূর অতীত। আর এই গরমে বাহিরে কাজ করে চামড়া পুড়িয়ে শত শত বাংলাদেশের লোক টাকা রোজগার করে নিজের পরিবারকে দিয়েছে। এই অঙ্গার হওয়া মানুষদের কেউ কেউ সুখ নামক শব্দে সমৃদ্ধি হয়েছে আবার কেউ কেউ দুঃখ নামক শব্দে বিষাক্ত হয়েছে।
আর সেই টাকার সুখে হয়তো স্ত্রী সন্তান রঙ্গীন চশমা পরেছে কিংবা ছোট ভাইরা প্লেনে উঠে ভিনদেশী হয়ে পর হয়েছে। বোনটা স্বামীর সংসারে গিয়ে ভুলে গিয়েছে অতীত, আর মা-বাবা স্বর্গের বাসিন্দা হয়েছে সুখ-দুঃখের মাঝে পড়ে। প্রবাসীদের জীবনের মতই এখন সৌদির আবহাওয়া আগের মত নেই গরম শীত ও বৃষ্টি। কমেছে প্রবাসীদের রোজগার বেড়েছে খরচ বেড়েছে প্রবাসীদের ঘরে অবিশ্বাস। তবুও প্রবাসীরা নিজেদের উজাড় করে দেয় পরিবারের সবার জন্য আর বৃদ্ধ হয়ে ফিরে গৃহে। তখন সন্তানদের কাছে হয়ে পড়ে অপ্রয়োজনীয় ভাই বোনদের কাছে হয়ে পড়ে বোঝা তাই পৃথক হয়ে দুরত্ব বজায় রাখে। তবে আমি আবুল কালামের এমন ঝামেলা নাই কারণ আমি গরিব পিতার একমাত্র ছেলে। মা-বাবা, স্ত্রী ও ছোট ছোট দুই ছেলে নিয়েই আমার সংসার।
এখন আর সন্ধ্যার পর রাস্তায় বাহির হতে ইচ্ছে করে না। নীরব চারিদিকে, লাইটের আলো না থাকলে ভয় লাগতো প্রচণ্ড। আমি এখন গুদামের রাতে পাহারাদার হওয়ায়, সন্ধ্যার পরই দোকানে যেতে হয় সওদা করতে। এখানে আইন মাক্স পরা, না পরলে জরিমানা গুণতে হবে। তবে ভিন দেশী শ্রমিক দেখলে জরিমানা না করে বাসায় ফেরত পাঠায় মাক্স পরতে। মহামারীর লকডাউনে পুলিশ ইকামাও খোজ করেনি, আমি কয়েকবারই পুলিশের সামনে পড়েছি, একবারতো পুলিশ গাড়িতে বসে চা পান করার সময় আমাকে ডেকে চা পান করতে দিয়েছে। দোকানে যাওয়ার পথে হঠাৎ টহলরত পুলিশ এসে যায় তাদের ডাকে ভয়ে আমার কপালে চিকন চিকন ঘামের রেখা, তা হাত দিয়ে মুছে পুলিশের সামনে যাই।
ইকামা বিহীন সৌদির প্রবাস জীবন নাবিক বিহীন জাহাজের মত যে কোন মুহূর্তে ডুবে যেতে পারে। তবে এই করোনা মহামারীতেও ইকামা ছাড়াও যে কাজ পেয়ে কাজ করতেছি তাও বিধাতার অশেষ রহমত। এইটি হয়তো আমার মা-বাপ, বউ-বাচ্চার দোয়া। এক বছরেও করোনা নির্মূল না হওয়ায় অজানা ভয় থেকেই যাচ্ছে, এইটি হয়তো পৃথিবীর মানুষকে প্রকৃতি এক ধরনের সাজা দিচ্ছে কারণ মানুষ প্রকৃতিকে অনেক কষ্ট দিয়েছে যুগ যুগ ধরে। আমি জীবন মরণের এই উত্থান পতনে এখনো ভালো আছি। ভালো থেকেই মা মাটি ও প্রিয় মানুষের মাঝে ফিরে যেতে চাই শ্যামল সবুজ ও অপরূপ বাংলায়।
(শেষ পর্ব)।
loading...
loading...
বেশ ভাল লেখেছেন মহী দা
loading...
আপনার মন্তব্যে আমাকে প্রেরণা যোগায়। একান্ত কৃতজ্ঞতা জানাই।
loading...
প্রাপ্তি এবং বেদনায় হারিয়ে গেলো একটি বছর ২০২০। পৃথিবীর সবাই নিরাপদ হোক এই ২০২১ এ এমনটাই প্রত্যাশার অপেক্ষায় থাকি। শুভেচ্ছা মি. ফয়জুল মহী।
loading...
আপনার মন্তব্যে আমাকে প্রেরণা যোগায়। একান্ত কৃতজ্ঞতা জানাই।
loading...
আপনার লেখা "করোনায় একজন প্রবাসী" মহামারি করোনাভাইরাস নামে এই পৃথিিবীতে ইতিহাস হয়ে
থাকবে। লিখে যান, দাদা। সাথে আছি।
loading...
আপনার মন্তব্যে আমাকে প্রেরণা যোগায়। একান্ত কৃতজ্ঞতা জানাই।
loading...