গুজব, ভাইরালযুদ্ধ ও প্রজন্মের ভবিষ্যত

দেশে কি হচ্ছে, তা সবাই দেখছেন। একজন মধ্যম শ্রেণির মডেলকে ওরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলো! তিনি কি উদ্বেগ নিয়ে অভিনয় করলেন ফেসবুক লাইভে। চোখ তুলে নিয়েছে, মেরে ফেলেছে! কি নিখুঁত তার অভিনয়! ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দলের অফিসের দিকে মারমুখো হলো। কি আজব এই গুজববাজদের মানসিকতা!

আপনারা অনেকেই নিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ফোনালাপ শুনেছেন। একজন অপরিচিত যুবকের সাথে তিনি ফোনে কথা বলছেন। তিনি বলেছেন- ৫/৬ শ’ মানুষ নিয়ে ঢাকা ঘেরাওয়ে শামিল হও। তোমরা ফেসবুকে ছড়িয়ে দাও। কুমিল্লা না- ঢাকা দখল নিতে পারলেই আগুন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এটাই ছিল এই সিনিয়র বিএনপি নেতার মোদ্দাকথা। ছাত্ররা তাদের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করছে। এই দাবিগুলোের সাথে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও একমত। নয়টি দাবিই মানা হয়েছে। তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে। তারপরও ছাত্ররা রাজপথ ছাড়ছে না কেন? তাদের পেছনে কারা? কি ওদের উদ্দেশ্য? দেশে-বিদেশে একটি চক্র সক্রিয়। তারা এই সরকারের পতন চায়। পতন চায় এই আগস্ট মাসেই। আগস্ট মাসটি তাদের খুব প্রিয়। ১৫, ২১ আগস্টের কথা বাঙালি জাতি কি ভুলতে পারবে কোনোদিন?

এই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় নাশকতা চালাতে চায় তারা। এজন্য ভাইরালযুদ্ধে ওরা মেতেছে গত চার-পাঁচদিন থেকে। অনেকভাবেই তারা গুজব ছড়াচ্ছে। ফোন হাতে নিলেই ভাইরাল সব ছবি। ২০০১-২০০৬ সালের ছবি ভাইরাল করেও এই সরকারের উপর চাপানোর অপচেষ্টা চলছে। ফটোশপ করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে এখন ফেকনিউজের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছে।

দাবি মানার পরও ছাত্ররা ঘরে, ক্লাসে ফিরছে না কেন? নিরাপদ সড়কের আন্দোলন থেকে ‘সাহস’ নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ ‘কঠোর’ হচ্ছে জানিয়ে শিক্ষার্থীদের এখন ঘরে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। আছাদুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশ পুলিশ সারা বাংলাদেশে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করবে।

ট্রাফিক সপ্তাহে লাইন্সেস ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি, হেল্পার দিয়ে ড্রাইভিংসহ ট্রাফিক আইনের যে কোনো ব্যত্যয় হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। একইসঙ্গে মোটর সাইকেলে তিনজন চড়া, ট্রাফিক সিগন্যাল ভায়োলেশন করা, উল্টো পথে চলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন, সাধারণ ছাত্রদের তারা স্যালুট করেন। যে কাজটি তাদের আরও আগে করার কথা ছিল, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা পারেননি। আজকে শিক্ষার্থীরা তাদের নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন- ট্রাফিক আইন যুগোপযোগী করার জন্য ‘গণপরিবহন ও ট্রাফিক আইন’ নামে নতুন একটি আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাশ হবে।

তিনি বলেছেন, গোয়েন্দা সূত্রে আমরা প্রমাণ পেয়েছেন, স্কুল ড্রেস বিক্রি ও তৈরির হিড়িক পড়েছে। স্বার্থান্বেষী মহল ছাত্রদের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে অন্যখাতে প্রবাহিত করে ঘোলাজলে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। ডিএমপি কমিশনার বলেছেন- এটা সাধারণ ছাত্রদের দ্বারা হতে পারে না। যারা তাদের উস্কানি দিচ্ছে, তারা নৈরাজ্য তৈরি করে জনগণের পুলিশের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চাইছে। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামতে ভয় পাচ্ছে।

যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে। কাঁচা শাকসবজি, মাছ, মাংসের দাম বেড়ে গেছে। জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মহানগরে এমন জনদুর্ভোগ দীর্ঘ দিন চলতে পারে না। দেশের মানুষ চাইছেন, যারা গুজব ছড়াচ্ছে ওদের আইনের আওতায় আনা হোক।

এর মাঝেই দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- তৃতীয় পক্ষ মাঠে নেমেছে, ঢাকার বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসেছে এখানে। তাদের কাজ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা। যখনই আমি এটা জেনেছি, আমি আতঙ্কিত বোধ করছি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিতে তৃতীয় পক্ষ নেমেছে জানিয়ে আন্দোলনরতদের এখন ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এদের দাবি-দাওয়া যা ছিল, সবই একে একে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। যেখানেই স্কুল, সেখানেই ট্রাফিক থাকবে, রাস্তা পারাপার করিয়ে দেবে। আন্ডারপাস করা হবে। ওভারব্রিজ হবে, তবে তা যেন ব্যবহার করে। রাষ্ট্রপ্রধান বলেছেন- শিক্ষার্থীদের এখন যদি কিছু হয়, তবে এর দায়িত্ব কে নেবে। অভিভাবক-শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, আপনারা তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিন, পড়াশোনা করা তাদের দায়িত্ব।

আমরা দেখেছি ছাত্ররা আন্দোলন করেছে ৫২,৬৯,৭০,৭১ ৯০সালে বিভিন্ন সময়ে। দাবি মানার পর তারা ঘরে ফিরে গেছে। এবার তাদের না যাওয়ার উসকানি কারা দিচ্ছে? সরকার পতনই তাদের মূল উদ্দেশ্য- তা নেপথ্যের নায়কেরা প্রকাশ্যে বললেই পারে। এই বাংলাদেশ তারুণ্যের অনেক অগ্নিশিখা দেখেছে। তাই এই গণ-ছাত্র জাগরণ নতুন নয়। গণজাগরণ মঞ্চ এর সর্বশেষ উদাহরণ। আমরা তো দেখেছি, এই মঞ্চকেও নস্যাৎ করে দেওয়ার পায়তারা করা হয়েছিল, শুধুমাত্র আলবদর-রাজাকারদের বাঁচানোর জন্য। এই কদিনে আমরা দেখেছি, অত্যন্ত অকথ্য ভাষায় পুলিশ বাহিনীকে গালিগালাজ করে ফেসবুকে পোস্টার ভাইরাল করা হয়েছে। এসব কি কোনো মানুষের ভাষা

হতে পারে। সর্বশেষ যে অভিনেত্রী ও মডেল লাইভে কথা বলেছেন তা ছিল এই সময়ের সেরা মিথ্যা। ১ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের লাইভ ভিডিওর শুরুতেই তিনি বলেন, ‘আমি কাজী নওশাবা আহমেদ বলছি, আপনাদেরকে জানাতে চাই, একটু আগে জিগাতলায় আমাদের ছোট ভাইদের একজনের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে, দুজনকে মেরে ফেলা হয়েছে।’

সকলকে এক হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এই অভিনেত্রী বলেন, ‘আপনারা সবাই একসাথে হোন। ওদেও প্রোটেকশন দিন প্লিজ। বাচ্চাগুলো আনসেইফ অবস্থায় আছে। আপনারা রাস্তায় নামেন প্লিজ।’

ছাত্রলীগ এই হামলা করেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘একটু আগে অ্যাটাক করেছে, ছাত্রলীগের ছেলেরা। তারা জিগাতলায় আছে। আপনারা এখনই নামবেন, আপনাদের বাচ্চাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবেন। ট্রাফিক যে পুলিশরা আছেন, প্লিজ আপনারা নিজের দেশের বাচ্চাদের প্রটেকশন দেবেন। কিছু একটা। সরকার যদি দায়িত্ব নিতে না পারে, তবে জনগণ কিসের জন্য আছি আমরা? আমরা ৭১ দেখেছি, বায়ান্ন দেখেছি, আমরা এবারও পারব।’

অথচ দেশবাসী দেখলো-জানলো সেখানে কিছুই হয়নি। এভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে আঁধারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এর অবসান দরকার। ছাত্ররা আমাদের অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন তারা তো স্থায়ীভাবে ট্রাফিকের দায়িত্ব নিতে পারে না। এই বোধোদয় দরকার। এই দেশের মানুষ শান্তি চান। কেউ দেশকে অশান্ত করে তুলুক, তা কেউই মেনে নেবেন না।

__________________
ফকির ইলিয়াস: কলামিস্ট।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৬-০৮-২০১৮ | ২১:৫৫ |

    বাংলাদেশের মানুষ শান্তি চায়। কেউ দেশকে অশান্ত করে তুলবে, তা কেউই মেনে নেবে না। এই ধরণের অস্থিরতা জন জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। আমরা ভীত হই। Frown

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ০৬-০৮-২০১৮ | ২২:৩৮ |

    বাংলাদেশে যা ঘটছে এবং ঘটেছে দুঃখজনক। Frown

    GD Star Rating
    loading...
  3. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ০৭-০৮-২০১৮ | ১৫:০১ |

    অথচ দেশবাসী দেখলো-জানলো সেখানে কিছুই হয়নি। এভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে আঁধারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

    * সহমত…

    GD Star Rating
    loading...