আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি তাদের ভয়ের কারণ আছে। এই কারণ গুলো কী- তা ক্ষমতাসীনদের না জানার কথা নয়। বাংলাদেশে যদি মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটে তবে, এর বেনিফিসিয়ারি কে হবে, তাও জানেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। ভাস্কর্য নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা নতুন নয়। এর আগেও বাংলাদেশে ভাস্কর্য আক্রান্ত হয়েছে। শহীদ মিনার আক্রান্ত হয়েছে। ২০১৬-এর সেপ্টেম্বর মাসে বগুড়া শহরের প্রবেশদ্বার বনানী গোলচত্বরের ‘বিজয় ভাস্কর্য’ ভেঙ্গে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকজন বলছিলেন, এটা স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের পরিকল্পিত নাশকতা।
রণাঙ্গনে যুদ্ধ শেষে বিজয়-সন্ধিক্ষণে কাঁধে রাইফেল নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা ডান হাত দিয়ে শান্তির পায়রা উড়িয়ে দিচ্ছেন, এমন দৃশ্যের এ ভাস্কর্য রড-সিমেন্ট-বালু দিয়ে তৈরি। প্রায় নয় ফুট উঁচু এ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ১৯৯১ সালে বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় স্থাপন করেছিল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় সেটি সরিয়ে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে বনানী গোলচত্বরের পর্যটন মোটেলের সামনে স্থাপন করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিমানবন্দর মোড়ে স্থাপন করা লালনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয় ধর্মীয় গোষ্ঠীর আন্দোলনের মুখে। ওই সময় রাজধানীর মতিঝিলে বিমান অফিসের সামনের ভাস্কর্য বলাকাতেও হামলা হয়। আমাদের মনে আছে, বিমানবন্দরের সামনে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল সরকারের সংশিষ্ট বিভাগের অনুমোদন নিয়েই। বিমানবন্দরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং দেশের লোকায়ত শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি বিদেশিদের আকৃষ্ট করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। মৌলবাদীদের তাণ্ডবের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। এর আগেও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য ভেঙেছে। এর মাধ্যমে মুক্তচিন্তার বিপরীতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী আস্কারা পেয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় ছিল সেই সময়ে একজন মৌলবাদী নেতা ফজলুল হক আমিনী হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে দেশের সব ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হবে। আমরা স্মরণ করতে পারি, সত্তরের দশকের শেষার্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনে শিল্পী আবদুলাহ খালেদ নির্মিত ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাঙারও চেষ্টা চালিয়েছিল জামায়াত সমর্থক ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাডাররা। সে সময় ছাত্র-শিক্ষক তথা সচেতন মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।
একই অবস্থা আমরা দেখেছি ২০১৭ সালেও। সুপ্রিমকোর্টের সামনে স্থাপন করা ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানানো ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবি আরো সুদূরপ্রসারী। তারা চার বছর আগেই দেশের সব ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তুলেছে। সে দাবি এখনো বহাল আছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা।
গত ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায়বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে স্থাপন হয় ভাস্কর্য। এটি স্থাপনের পরপর ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো এটি অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামে। আর রমজান মাস শুরুর আগেই এটি অপসারণ না হলে পরিণতি ভালো হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। হেফাজতে ইসলাম এই যে হুকমি দিয়ে যাচ্ছে এর নেপথ্য কারণ কী? তারা কি সরকারকে কোনো টোপে ফেলতে চাইছে?
হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় লেখক, অধ্যাপক ও সংস্কৃতিকর্মী। এ বিষয়ে প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘কোনোভাবেই সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য অপসারণ করা ঠিক হয়নি। ভাস্কর্য যেমন একটি প্রতীক, এর অপসারণও একটি প্রতীক। এর ফলে তাদের চাপ আরো বাড়বে এবং হেফাজত রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করবে। এটা করতে দেওয়া ঠিক হবে না। তারা দর কষাকষি করতেই থাকবে। এক দলের কাছ থেকে সুযোগ নিয়ে, আরেক দলের কাছ থেকেও সুযোগ নিতে চাইবে। তারা এভাবেই নিজেদের শক্তি সংহত করছে। এ ভাস্কর্য অপসারণ করা গ্রহণযোগ্য নয়, এটা দুঃখজনক।’
বরেণ্য বুদ্ধিজীবী কামাল লোহানী বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ দাবি করা সরকার এখন মৌলবাদী, সা¤প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে আপস করছে। আমরা কোন পথে যাচ্ছি, সেটা ভাবতে হবে। বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা রেখেছিলেন, সেটির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ সরকার ফিরিয়ে আনেনি। হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রেক্ষিতে এই ভাস্কর্য অপসারণের পূর্বে পাঠ্যপুস্তকেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, ‘কাজটা তো করেছেন প্রধান বিচারপতি। তার নির্দেশনা ছাড়া তো সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্যের গায়ে হাত দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। তিনি কেনইবা এটা বসালেন কেনইবা এটা সরালেন? এটা সরিয়ে তিনি যেটা করলেন হেফাজতের দাবির কাছে নতি স্বীকার করলেন। হেফাজত ভবিষ্যতে দাবি করবে শরিয়া আইন চালু করতে হবে। হিন্দু প্রধান বিচারপতি থাকতে পারবে না। প্রধান বিচারপতি কি তাহলে এরপর তার পদ থেকে পদত্যাগ করবেন? এটাও তো তাদের দাবি। কেন তিনি এটা করতে গেলেন? রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক মতলবে বিভিন্ন সময় মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে আপস করে- বিএনপি করেছে, এখন আওয়ামী লীগও করছে। সেটার জন্য তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি যদি হেফাজতের দাবির কাছে নতি স্বীকার করেন, তাহলে আমরা যাবো কোথায়?’
ভাস্কর্য নিয়ে এই বিতর্কের পাশাপাশি অনেক কথা বেরিয়ে এসেছে ভাস্কর মৃনাল হকের ব্যাপারেও। জানিয়ে রাখি, আমি যে শহরে থাকি সেই নিউ ইয়র্কে একসময় পরবাসী ছিলেন এই মৃনাল হক। ৯০-এর দশকে বেশ কয়েক বছর তিনি এখানে ছিলেন। তিনি যে বিএনপি ছাত্রদলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন- তা আমাদের অনেকেরই জানার সুযোগ হয়নি। কিংবা তিনি তার কর্মকাণ্ডেও কখনো রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ ঘটাননি। নিউ ইয়র্কে থাকতে তিনি কিছু কাজও করেছিলেন ভাস্কর্যের। একজন দন্ত চিকিৎসক মীনা ফারাহ’র (যিনি আগে মীনা সাহা ছিলেন) কেনা একটি বাণিজ্যিক ভবনের দেয়ালেও তিনি কিছু সিরামিকের কাজ করেন। যাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহ্য ফুটে উঠেছিল। পরে তা অযত্নে ভেঙে ভেঙে পড়ে যায়।
মীনা ফারাহ নিউ ইয়র্কে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। মেজর জিয়াকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে একটি বইও লিখেছিলেন। এই সেই মীনা ফারাহ, যিনি একাত্তরের ঘাতক রাজাকার শেরপুরের মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রথমে সাক্ষী দিতে তৈরি থাকলেও পরে অজ্ঞাত কারণে সাক্ষী দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এই মীনা ফারাহ’র সঙ্গে মৃনাল হকের সখ্য গড়ে উঠেছিল নিউ ইয়র্কে। চলমান সময়ে এই মীনা ফারাহ বাংলাদেশের মৌলবাদী মিডিয়াগুলোর অন্যতম লেখিকা।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল ইসলামী দলগুলোকে একাট্টা করতে চাইছে। তাদের ভোট চাইছে। এটাই এখন মূলত রাজনীতির বহিরাঙ্গন। কিন্তু ভেতরে কী ঘটছে? আপনাদের মনে আছে- আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী, বিচারপতি বদরুল হায়দার জামায়াত নেতা আলবদর গোলাম আযমের সঙ্গে দেখা করে দোয়া চেয়েছিলেন। তাতে কি কোনো কাজ হয়েছিল? না- হয়নি।
আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি, বর্তমান সরকার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের ফসল এবং ধারাবাহিকতা। একাত্তরের পরাজিত মৌলবাদীরা বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে মন্ত্রিত্ব পেয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগের ঘাড়ে যদি সেই একই কালো মুদ্রার ওপিঠ সওয়ার হয়, তাহলে পরিণতি কী হতে পারে- তা কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভেবে দেখেছেন? যারা একাত্তরে মহান স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল- তারাই আজ ভাস্কর্য তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। মিলে-মিশে রাজনীতি করা ভালো। কিন্তু যারা এই দেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়, যারা মৌলবাদী হুংকার দেয় তারা কেমন বাংলাদেশ চায়- তা কি অনুধাবন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা?
আমাদের আরেকটি চুক্তির কথা মনে আছে। সেটি হলো- ২০০৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মধ্যে স্বাক্ষরিত পাঁচ দফা নির্বাচনী চুক্তি। এ নির্বাচনী সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এবং খেলাফত মজলিসের পক্ষে মহাসচিব মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী। এই চুক্তির পর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে খেলাফত মজলিস আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোটের’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পাঁচ দফা নির্বাচনী চুক্তিতে বলা হয়েছিল- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হচ্ছে যে, নিম্নবর্ণিত ৫টি বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে আসন্ন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সমঝোতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করবে এবং মহান আল্লাহ তা’আলা বিজয় দান করলে এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে-
১. পবিত্র কুরআন সুন্নাহ ও শরিয়ত বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না।
২. কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
৩. নিম্নবর্ণিত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা হবে। হযরত মোহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী।
৪. সনদপ্রাপ্ত হক্কানী আলেমগণ ফতোয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। সনদবিহীন কোনো ব্যক্তি ফতোয়া প্রদান করতে পারবে না।
৫. নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা ও কুৎসা রটনা করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
এভাবেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক কৌশল চলছে। কে জিতে কে হারে, তা দেখার জন্য জনগণ তৈরিই থাকেন। সবশেষে, আমি যে প্রশ্নগুলো করে লেখা শেষ করতে চাই তা হলো- ভাস্কর মৃনাল হক প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে লিখিত টেন্ডার পেয়ে কাজটি করেছিলেন কি? তিনি গ্রীক দেবীর আদলে যে ভাস্কর্যটি বানিয়েছিলেন তা বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের অনুমোদিত ছিল কি? আমাদের ভয়ের কারণ হচ্ছে- কোনো কালো শক্তি পেছন থেকে দাবার গুটি চাল দিচ্ছে কি না। আমাদের শংকা হচ্ছে, এসব দেখে শুনে বাংলাদেশে মৌলবাদীরা তাদের ফণা দেখাচ্ছে চাচ্ছে কি না। এই বিষয়গুলো পরিষ্কার হওয়া দরকার। এই সুযোগে আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাস্কর্যগুলো যেন অপমানিত না হয়।
________________________________
দৈনিক খোলাকাগজ। ঢাকা। ৫ জুন ২০১৭ সোমবার।
loading...
loading...
শংকাযুক্ত একটি সময় পার করছি আমরা। আমরা শংকিত।
loading...
সুখপাঠ্য, তথ্যবহুল ও পরিচ্ছন্ন বিশ্লেষণ ধর্মী লেখার ধন্যবাদ ফকির ইলিয়াস ভাই । মুরুব্বীর মতই বলতে চাই, আমরা শংকিত !!!
loading...