শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত-এঁর প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা

তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তিনি একজন শিক্ষক। তাঁর দুর্ভাগ্য তিনি বাংলাদেশের এমন একটি এলাকার শিক্ষক, যেখানে তাঁর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী তাঁর পক্ষে দাঁড়াতে পারছে না। তাদের দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। কেউ প্রতিবাদ করল না। করতে পারল না। মানুষ একটি রাষ্ট্রে কি অসহায় হতে পারে! মানুষকে কীভাবে জিম্মি করা যায়!

নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে একটি ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের একটি আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরে তিনি আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। যে মামলাটিতে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, সেখানে মামলার বাদী অভিযোগ করেছেন যে, চাকরি এমপিওভুক্ত করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে শ্যামল কান্তি ভক্ত তার কাছ থেকে এক লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা নিয়েছেন। মামলার বাদী অভিযোগ করেন, তার চাকরি এমপিওভুক্তি হয়নি এবং তিনি টাকাও ফেরত পাননি। এ মামলাটি পুলিশ তদন্ত করার পর শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। সে অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে ২০১৬ সালের ২৭ জুলাই শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন বন্দরের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মোর্শেদা বেগম। আর ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে শ্যামল কান্তিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের নির্দেশে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় গত বছরের মে মাসে। এর দুই মাস পর মামলাটি করেন ওই শিক্ষিকা। মামলাটি করা হয় গত বছরের ২৭ জুলাই। অন্যদিকে, শ্যামল কান্তি ভক্ত তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, তাঁকে চাপে রাখতেই প্রভাবশালী এক ব্যক্তির নির্দেশে ষড়যন্ত্রমূলক মামলাটি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি আজ বলেন, ‘আমি এখানে ন্যায়বিচার পেলাম না। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে আমাকে ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পিতভাবে এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে যে ঘুষের অভিযোগ আনা হয়েছে, আমি কখনো এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। যে সময় ঘুষ নেয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন শীতকালীন বন্ধ ছিল বিদ্যালয়।’

এর আগের ঘটনাবলি আমাদের মনে আছে। ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবোস করানোর একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সে ঘটনা তদন্তের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সে কমিটি শিক্ষক শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিও একই কথা বলেছিল।

শ্যামল কান্তি ভক্তকে নতুন করে ফাঁসানোর চেষ্টা চলেই আসছিল। এ বিষয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘আমাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিতাড়িত করার নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নতুন করে হুমকিও দিচ্ছে ওসমান পরিবার। শামীম ওসমান তো আমাদের মামলা তুলে নিতেও বলেছেন। এর মধ্যে লোকও পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমি তাকে বলেছি, মামলার বাদী সরকার। আমি কী করতে পারি? তারপরও তিনি আমার সঙ্গে বসতে চান। আমার নিরাপত্তার জন্য একজন পুলিশ সদস্য আছেন। তিনি আমার কথা শোনেন না। কোথায় থাকেন, ডাকলেও আসেন না। ফলে আমাকে হত্যা করা হতে পারে এমন শঙ্কার মধ্যে আমি দিন পার করছি।’

ঘুষের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হারুনুর রশিদ গত ১৪ এপ্রিল শ্যামল কান্তি ভক্তকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছিলেন। ২৪ মে এর শুনানি ছিল। হারুনুর রশিদ ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমি তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। ফলে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছি। চারজন সাক্ষীও আছে। অভিযোগকারী ছাড়াও তার স্বামী ও স্কুলের একজন অভিভাবক প্রতিনিধি এই মামলার সাক্ষী হয়েছেন। এখানে অভিযোগকারী শিক্ষক মোর্শেদা বেগমের সঙ্গে এমপি সাহেবের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি নিরপেক্ষভাবে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছি।’ প্রবীণ এই শিক্ষকের গ্রেপ্তারে ফুঁসে উঠছে দেশবাসী। সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে তোলপাড়। ঘুষগ্রহণ ও প্রদান দুটিই প্রচলিত আইনে অপরাধ দাবি করে শ্যামল কান্তি ভক্তের আইনজীবী এড. শাখাওয়াত হোসেন খান বলেছেন, ঘুষ প্রদানের ঘটনাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। লাঞ্ছনার মামলাটিকে ধামাচাপা দিতে পুলিশ দিয়ে মিথ্যা তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। শ্যামল কান্তি ভক্ত ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছেন।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী এড. মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেছেন, যদি আমরা ধরে নিই ‘ঘুষ’ আদান-প্রদানের ঘটনাটি ঘটেছে, তাহলে শ্যামল কান্তি ভক্তের মতো একই অপরাধে অপরাধী শিক্ষিকা মোর্শেদা আক্তারও। তাই প্রশ্ন তুলছি, একই অপরাধে অপরাধী হয়ে মোর্শেদা কেন কারাগারে নন? একই সঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির উচিত এ ব্যাপারে মোর্শেদা বেগমের বিরুদ্ধেও আইনগত প্রদক্ষেপ নিতে আদালতে প্রার্থনা করা। আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আলোচনা করব। মোর্শেদা আক্তার যদি ঘুষ দিয়ে থাকেন, তবে তিনিও অপরাধী। তার বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে। আমাদের মনে আছে, স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে কান ধরে উঠবোস করানোর ঘটনায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কান ধরে দাঁড়িয়ে’ প্রতিবাদ জানিয়েছিল একদল শিক্ষার্থী। তারা আধা ঘণ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনের সামনে হালকা বৃষ্টির মধ্যে তাদের এই অভিনব প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, এভাবে হয়রানির শিকার হলে শিক্ষকদের মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা আজ ভাববার বিষয়। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করবে। তারা বলেছিলেন, মানবিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে শ্যামল কান্তি ভক্ত স্যারের প্রতি সহমর্মিতা জানাতেই এ কর্মসূচি। সংশ্লিষ্ট সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তারা।

এই ঘটনায় গত বছরই কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ। শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় জড়িত সংসদ সদস্য সেলিম ও তার সহযোগীদের বিচার চেয়ে তাদের ব্যানারে লেখা ছিল, ‘শুধু একজন শিক্ষক নয়, যেন কান ধরে উঠবোস করছে বাংলাদেশ!’ সমাবেশে মানবাধিকার কর্মী থেকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রায় তিনশ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। সমাবেশের বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছিলেন, ‘দেশে অনাচারের রাজত্ব চলছে। যেখানে সংবিধান লঙ্ঘন করে, আমাদের যে আইনকানুন, রীতিনীতি ও নৈতিকতা আছে তার সবগুলোর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিছু মানুষ তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কাজ করছে। তারা এ ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র লজ্জিত কিংবা বিব্রতবোধ করছে না।’ এ ধরনের নেতা ও আইন প্রণেতাকে প্রত্যাখ্যান করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একজন আইন প্রণেতা নারায়ণগঞ্জে যেটা করলেন সেটা আমাদের আইন অনুযায়ী অবৈধ কাজ। আমাদের উচ্চ আদালত এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না।’ ‘জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য’ ওই শিক্ষককে কান ধরানো হয়েছে বলে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সে প্রসঙ্গ তুলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেছিলেন, ‘যদি নেতার এমনই ব্যক্তিত্ব হয়, জনগণকে কথা বলে অন্যায় থেকে বিরত রাখতে পারেন না, আরেকটি অন্যায় তিনি করেন, তাহলে সেই নেতার ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি এবং কথা বলতেও আমি দ্বিধাবোধ করি না, এরা ওই ধরনের আচরণকে সমর্থন করে। আমি মোটেও আশ্চর্য হব না, যদি দেখা যায় ওই ঘটনার পেছনে এই ভদ্রলোকেরও হাত ও উসকানি ছিল।’

অনেক কিছুই ঘটে গেছে এই নারায়ণগঞ্জে। অনেক কিছুই ধামাচাপা পড়েছে। প্রশ্ন আসছে, রাষ্ট্রের ভেতরে কি এক একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন কেউ কেউ? আচ্ছা দেখলে কি মনে হয় এই লোকটি ঘুষ নিতে পারেন? তাঁকে দেখলে কি মনে হয় না তিনি কত আতঙ্কিত? ওই ন্যক্কারজনক অপমানের দুই মাস পরে মামলা হয়েছিল। এর আগে বাদী মামলা করেন নি কেন? জানি এসব বিষয় নিয়ে তর্ক করে জেতা যাবে না। একটি কথা বলতে চাই, এই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দরকার। তিনিই পারেন এই সমস্যার সমাধান করতে। কোনো বলবানের ভয়ে কেউ তো দেশ ছাড়তে পারেন না। একজন প্রবীণ শিক্ষকের কাছে আমি আবারো ক্ষমা চাইছি। এর চেয়ে একজন শব্দশ্রমিক হিসেবে আমার আর কি করার আছে!

VN:F [1.9.22_1171]
রেটিং করুন:
Rating: 0.0/5 (0 votes cast)
VN:R_U [1.9.22_1171]
Rating: 0 (from 0 votes)
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৫ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মনা পাগলা : ০২-০৬-২০১৭ | ১৬:০৭ |

    তিনি আজ বলেন, ‘আমি এখানে ন্যায়বিচার পেলাম না। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে আমাকে ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পিতভাবে এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_wacko.gif

    VN:F [1.9.22_1171]
    Rating: 0 (from 0 votes)
  2. আনিসুর রহমান : ০২-০৬-২০১৭ | ১৭:৩৩ |

    একজন প্রবীণ শিক্ষকের কাছে আমি আবারো ক্ষমা চাইছি। এর চেয়ে একজন শব্দশ্রমিক হিসেবে আমার আর কি করার আছে!

    VN:F [1.9.22_1171]
    Rating: 0 (from 0 votes)
  3. মুরুব্বী : ০২-০৬-২০১৭ | ১৭:৫১ |

    ‘একজন প্রবীণ শিক্ষকের কাছে আমি আবারো ক্ষমা চাইছি। এর চেয়ে একজন শব্দশ্রমিক হিসেবে আমার আর কি করার আছে!’ Frown

    VN:F [1.9.22_1171]
    Rating: 0 (from 0 votes)
  4. অমিত রায় : ০২-০৬-২০১৭ | ২০:০৯ |

    আপনার লেখাতেই উত্তর আছে “প্রশ্ন আসছে, রাষ্ট্রের ভেতরে কি এক একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন কেউ কেউ?”

    VN:F [1.9.22_1171]
    Rating: 0 (from 0 votes)
  5. সাইয়িদ রফিকুল হক : ০৩-০৬-২০১৭ | ১৪:০০ |

    দুষ্টচক্র সবকিছু দখল করে নিচ্ছে।
    রাষ্ট্র কি এদের কাছে আজ অসহায়?

    VN:F [1.9.22_1171]
    Rating: 0 (from 0 votes)